টিএসসির স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে রবিবার বিজয় মাসের প্রথম প্রভাত শীর্ষক অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশনা
সেই অর্থে তখনো জেগে ওঠেনি শহর ঢাকা। পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠলেও ছড়ায়নি সূর্যের আলো। হালকা শীতমাখা হেমন্তের সেই সকালে শিল্পের আশ্রয়ে উচ্চারিত হলো বাঙালির বীরত্বগাথার কীর্তিকথা। কবিতার পঙ্ক্তিমালায় প্রকাশিত হলো স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা। গানের সুরে ব্যক্ত হলো পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বিজয় ছিনিয়ে আনার বারতা। উল্টোদিকে নাচের মুদ্রায় মূর্ত হলো শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া স্বদেশের কথা।
এভাবেই শিল্পের বর্ণিলতাকে আশ্রয় করে উদ্যাপিত হলো বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের প্রথম দিনটি। রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় ‘বিজয় মাসের প্রথম প্রভাত’ শীর্ষক আয়োজনটি। বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় শিল্পের বহুমাত্রিক পরিবেশনায় সজ্জিত অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে পদক্ষেপ বাংলাদেশ।
আলোচনায় ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় সাজানোর অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করার পাশাপাশি ঘোষণাপত্র পাঠ করেন সংগঠনের সভাপতি বাদল চৌধুরী।
সাংস্কৃতিক পর্বের শুরুতেই শিল্পিত উপস্থাপনায় স্মরণ করা হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ গানের সুরে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যদল নৃত্যাক্ষ। এর পর সমবেত কণ্ঠে উচ্চারিত হয় সবুজ শ্যামলে আবৃত রূপময় বাংলাদেশের বন্দনা। মন্দিরা সাংস্কৃতিক পাঠশালার শিল্পীরা গেয়ে শোনায় ‘রাঙামাটির রঙে চোখ জুড়ালো’। পদক্ষেপ বাংলাদেশের শিল্পীরা সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশন করে ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’। সুরনন্দন নজরুল সংগীত চর্চা কেন্দ্রের শিল্পীরা পরিবেশন করে ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি’ এবং ‘আমার দেশের মতো এমন দেশ’ শিরোনামের দুটি গান।
একক কণ্ঠের পরিবেশনা পর্বে মারুফ হোসেন গেয়ে শোনান ‘সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যান্তেও তুমি’। নূর মো. রাজু পরিবেশন করেন ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে’। কবিতার শিল্পিত উচ্চারণে আবৃত্তি পরিবেশন করেন করেন নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলি, সৈয়দ ইফতেখার আলী, তছলিম উদ্দিন সৌরভ ও ফরিদুজ্জামান। দলীয় আবৃত্তি করে পরিবেশন করে কথা আবৃত্তি চর্চা কেন্দৃ, ঢাকা স্বরকল্পন, মুক্তধারা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র ও কণ্ঠ শীলনের বাচিকশিল্পীরা।
অনুষ্ঠানের ঘোষণাপত্রে বলা হয়, বহু ত্যাগ, সংগ্রাম আর প্রত্যাশার ফসল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এ শুধু পতাকা আর জাতীয় সংগীত বদল নয়, খোল-নলচে সব পাল্টে নতুন এক আদর্শকে রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্নের নবযাত্রা। এই স্বপ্নের প্রধান এবং একমাত্র উপজীব্য মানুষ। মানুষের কল্যাণ, মানুষের মুক্তি, মানুষের মর্যাদা এবং মানুষের স্বাধীন ভূমিই শেষ কথা। কত মাতা, কত ভগ্নি, কত জানা-অজানা নারী তাঁর সম্ভ্রম হারিয়েছে শুধু এই মানুষকে মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। মানুষ কল্পনাবিলাসী কিন্তু নিজে তো সে কাল্পনিক নয়-এ ভূমিতেই তার সৃষ্টি, বেড়ে ওঠা, ভালো-মন্দের স্বাদ নেওয়া, অতঃপর ভূমিতেই মিলিয়ে যাওয়া। এ ভূমির প্রতি তার প্রচণ্ড ভালোবাসা।
মাতৃক্রোড়ে যেমনিভাবে শিশু বেড়ে ওঠে; একইভাবে কাদা-মাটি গায়ে মেখে আলো-বাতাসে অবগাহন করে এই ভূমিকেই মাতৃক্রোড় ভেবে একদিন চিরবিদায় নেয় প্রতিটি মানবশিশু। জন্ম আর মৃত্যুতে যে ভূমিকে কখনো আলাদা করা যায় নাÑতারই অমার্যাদা করবে ভিনদেশী তস্কর! তা কি করে মেনে নেয় ধুলো-বালি গায়ে মেখে বেড়ে ওঠা এ জনপদের মানুষেরা। এ ভূমিরই সাহসী-ত্যাগী- পোড় খাওয়া এক নামÑশেখ মুজিব। মাটি আর মানুষের সঙ্গে ছিল যাঁর আজন্ম সখ্য, ভিনদেশী হায়েনার হিংস্র থাবায় বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তাঁর হৃদপি-; তবু ভূমি আর মানুষের স্বাধীনতায় অবিচল থেকেছেন তিনি।
তাঁরই অঙ্গুলী হেলনে সাড়ে সাত কোটি মানুষ পরিণত হয়েছে এক একজন নেতাজী সুভাষ বসু, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, তিতুমীর, বাঘা যতিন, লক্ষ্মীবাই, ভগৎসিং, রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, সালাউদ্দিন, বরকত, আসাদ, মনুমিয়া’য়। এ গাঙ্গেয় বদ্বীপের তেরোশত নদীর জোয়ার আর পাখিদের কলতানে উচ্চারিত হয়েছে ভিনদেশী হায়েনার বিনাশ- ধ্বনি। লাঙলের ফলা থেকে তৈরি উর্বর মাটির প্রতিটি চাকা পরিণত হয়েছে শত্রুবিনাশী আনবিক বোমায়। বাঁশঝাড় উজাড় করে তৈরি হয়েছে চকচকে বেয়নেট।
নিঃশঙ্ক চিত্তে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার অগ্নিপুরুষ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সঞ্চারিত হয়েছে সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিটি রক্ত কণিকায়-বিজয় অর্জিত হয়েছে মানুষের সংগ্রাম আর আত্মদানের। বিজয় মাসের সূচনালগ্নে আমরা নতুন করে উদ্দীপ্ত হতে চাইÑমাটি আর মানুষের কল্যাণ কামনায়। আমরা বিনাশ চাই সেই নরপশুদের যারা মাটির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ভিনদেশী হায়েনাদের সঙ্গী হয়েছিল মনুষত্বের বিনাশ সাধনে। সেই সঙ্গে চাই আজকের এই দিনটিকে ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’-এর সরকারি স্বীকৃতি। মাটি আর মানুষের জয় হোক, জয় হোক শুভ চিন্তা আর আদর্শের।