ছায়ানটের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে শনিবার রমেশ দত্ত স্মৃতি মিলনায়তনে সংগীত পরিবেশন করেন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা
ছয় দশকের বেশি সময় ধরে আপন সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে ছায়ানট। শিল্প-সংস্কৃতিকে হাতিয়ার করে মানবিক সমাজ বিনির্মাণে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। এবার প্রতিষ্ঠানটির সেই কর্মধারায় যুক্ত হচ্ছে নতুন মাত্রা। আরও বেশি মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার লক্ষ্যে মিলনায়তন কিংবা উন্মুক্ত মঞ্চের পাশাপাশি এবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত হচ্ছে ছায়ানট। আঁধার থেকে জেগে ওঠার প্রত্যয়ে জাগরণী শীর্ষক কর্মসূচির মাধ্যমে ফেসবুক, ইউটিউব চ্যানেল, এক্স ও ইনস্টাগ্রামে প্রতিদিন সকাল নয়টায় কনটেন্ট প্রকাশ করবে ছায়ানট।
আজ রবিবার বিজয়ের মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু হবে নতুন এই কর্মধারা। এদিন রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে হাজার শিল্পীর কণ্ঠে গাওয়া জাতীয় সংগীতের কনটেন্টটি প্রকাশ করা হবে। ছায়ানটের সমমনা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন নালন্দা, রবীন্দ্র্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, কণ্ঠশীলন ও ব্রতচারীর সহযোগিতায় হাজারো মানুষ এই পরিবেশনার দৃশ্য ধারণে অংশ নিয়েছে ও কণ্ঠ মিলিয়েছে। ডিসেম্বর মাসজুড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশাত্মবোধক গানের কনটেন্ট প্রকাশ করবে ছায়ানট। পরবর্তীতে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে গানের সঙ্গে আবৃত্তিসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কনটেন্ট প্রকাশ করা হবে। পরবর্তীতে সংগীতের প্রশিক্ষণমূলক কনটেন্টসহ সংস্কৃতি সম্পৃক্ত নানা বিষয়ক প্রকাশ করা হবে।
শনিবার ছায়ানটের রমেশচন্দ্র স্মৃতি মিলনকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। শুরুতে ‘বিজয় কেতন উড়ছে ওই’, এবং সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা থেকে সংগীতে রূপান্তরিত ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন’ পরিবেশন করে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। গান শেষে বক্তব্য দেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী, যুগ্ম সম্পাদক পার্থ তানভীর নভেদ ও যুগ্ম সম্পাদক জয়নত রায়। নতুন কর্মসূচি সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা।
ডা. সারওয়ার আলী বলেন, সংস্কৃতির মাধ্যমে চিরকালই বাঙালির জাতিসত্তাকে ধারণ করেছে ছায়ানট। এবার ছায়ানটের সেই কার্যক্রমে যুক্ত হচ্ছে নতুন মাত্রা। মিলনায়তন বা উন্মুক্ত স্থানের পরিবেশনার পাশাপাশি ছায়ানটের পরিবেশনাসমূহ ছড়িয়ে দেওয়া হবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এতে করে আর বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে ছায়ানট। বিশ্বায়নের যুগে জাতীয় সংস্কৃতি রক্ষায় আমরা ইন্টারনেটের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাব। এতে করে চলমান অসহিষ্ণুতা ও বিভাজন থামিয়ে সম্প্রীতির সমাজ বিনির্মাণের পথটি সুগম হবে। এ সময় তিনিা জানান, ছায়ানটের এবারের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের পরিবর্তে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে অনুষ্ঠিত হবে।
লিখিত বক্তব্যে লাইসা আহমদ লিসা বলেন, বাঙালিকে আপন সংস্কৃতি ও দেশীয় বৈশিষ্ট্যে স্বাধীনসত্তায় বিকশিত হতে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে ১৯৬১ সালে ছায়ানটের জন্ম। সংগীত-সংস্কৃতি ও সংস্কৃতি-সমন্বিত সাধারণ শিক্ষা নিয়ে কাজ করে চলেছে এই প্রতিষ্ঠান। সাধনা ও চর্চার যথোচিত প্রসার ও বিকাশের মাধ্যমে একটি মানবিক সমাজ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে ছায়ানটের সকল কার্যক্রম। ছয় দশকের এই পথচলায় ছায়ানট হাজার হাজার গানের সম্ভার গড়ে তুলেছে। সে সব গানের অডিও এবং সাম্প্রতিককালের ভিডিও থেকেই মূলত কনটেন্টগুলো তৈরি হবে।
তবে এই পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে করতেই সকল অনুষ্ঠান-আয়োজন ফেসবুকে লাইভ করতে শুরু করেছে ছায়ানট। লাইভ আয়োজনগুলোও একযোগে প্রচার করা হবে পরিকল্পিত সকল নতুন মাধ্যমে। নিয়মিত নতুন কনটেন্ট প্রকাশ প্রতিদিন সকাল ৯টায়। প্রাথমিক এই আয়োজনের নাম ‘জাগরণী’। ছায়ানট বিশ্বাস করে, মানবজীবনের সকল আঁধার থেকেই জাগরণের প্রয়োজন। আমরা সৎ-সুন্দর আলোর অভিযাত্রী। সকলকে আহ্বান জানাইÑ জেগে উঠি জেগে থাকি, দেশের টানে, জীবনের টানে, প্রাণের গানে।
লাইসা আহমদ লিসা আরও বলেন, ছায়ানটের আদর্শ, আত্মপরিচয় অটুট রেখে এবং যথার্থ শিক্ষায় বিকশিত হয়ে বিশ্বমানব হওয়ার পথে স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা। মতাদর্শ বা বিশ্বাসে মানুষে মানুষে, সমাজে সমাজে যতই মতভেদ থাকুক, দ্বন্দ্ব থাকুক আজ এ পৃথিবীটা ছুটছে বিশ্বায়নের পথে। তবে ছায়ানট যেমন বিশ্ব সমাজের বিচিত্র সংস্কৃতির সুরভি আস্বাদন করে তার অংশী হতে চায়, তেমনই চায়, আপন সামাজিক গ-ি পেরিয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ুক বাঙালি সংস্কৃতির সুবাতাস। প্রতিটি ক্ষণে অগ্রসরমান অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে, এই বিবর্তনের কালে, নিজের মাধুর্য ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম মাধ্যমÑ সোশ্যাল মিডিয়া।
রমনা বটমূলে বাংলা ১৪২৪ বর্ষবরণের আয়োজনে ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন আহ্বান জানিয়েছিলেন, বিশ্বায়নের জোরালো প্রচারে নতুন প্রজন্ম আজ আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। সেই ক্ষেত্রটিতে তো আমরাও বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরতে পারি। আসুন, বিশ্বায়নকে স্বীকার করেই বাঙালির সাংস্কৃতিক অর্জনের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলো আমরা ছড়িয়ে দিই ইন্টারনেটে। এভাবে সব সংস্কৃতির পাঠই পাক আমাদের সন্তানরা। ওই মাধ্যমকে তো আমরাও ব্যবহার করতে পারি দেশীয় সংস্কৃতির প্রচারের জন্য। চলতি দশকের ঘটনাপুঞ্জ অনুসরণ করলে প্রমাণ মেলে, সে বাণী চিরন্তন।
সেই উপলব্ধি থেকে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি, আমাদের যা ভালো, যা মনের মধ্যে মানবপ্রেম-প্রকৃতিপ্রেম বিকশিত করে, সম্পীতির সমাজ গড়ে দেয় তা সকলের কাছে মেলে ধরব। এর নির্যাসের কণাটুকুও মানুষের মনে আশ্রয় পেলে এবং তা দিয়ে মানুষকে মঙ্গল-কল্যাণের পথে ধরে রাখাই হবে ছায়ানটের পরম সার্থকতা।