বনের রাজা বাঘ
বনের রাজা বাঘ। বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত। এখন আর আগের মতো গায়ে শক্তি নেই। চোখের জ্যোতিও ধীরে ধীরে কমে আসছে। কিন্তু তার এই দুর্বলতার কথা কাউকে বলতেও পারছে না। অন্য পশুপাখিরা জানলে তারা বাঘকে আর আগের মতো সমীহ করবে না। বাঘ খুব চিন্তায় পড়ে গেল। এভাবে চলে গেল অনেকদিন। চোখে ঝাপসা দেখায় শিকার ধরতেও বেশ সমস্যা হচ্ছে। ঠিকমতো শিকার ধরতে না পেরে পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে বাঘ দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে।
একদিন গহীন জঙ্গলে বিশাল বড়ো একটা গাছের নিচে মন খারাপ করে বসে আছে বাঘ। ঐ গাছেই ছিল একটা ইঁদুর। অনেকদিন আগে যে বনের রাজা বাঘকে উপকার করার প্রতিজ্ঞা করে অপরাধের বড় শাস্তি থেকে রেহাই পেয়েছিল। ইঁদুর সবিনয়ে রাজার মন খারাপের কারণ জানতে চাইল। রাজা মনে করলো ইঁদুরকে বলে আর কি হবে! কিন্তু ইঁদুরের কাকুতি-মিনতির কারণে রাজা সব খুলে বলল। রাজাকে উপকারের এমন মোক্ষম সুযোগ ইঁদুর হাতছাড়া করতে চাইল না। বললÑ রাজামশাই, আমার জানামতে জঙ্গলের সবচেয়ে বড় চিকিৎসক শেয়ালী ‘ডাক্তার ভিক্সেন আমাজন’।
চিকিৎসা সেবার ওপর রয়েছে তার বড় বড় ডিগ্রি এবং বিস্তর অভিজ্ঞতা। আমাজন জঙ্গলে বহু বছর ধরে অসংখ্য জটিল রোগী সুস্থ করে শেয়ালী আমাদের এই জঙ্গলে তার জন্মভূমিতে ফিরে এসেছে। তার নামের শেষে ‘আমাজন’ মূলত ঐ জঙ্গলের পশুপাখিরা ভালোবেসে যুক্ত করেছে। আশা করি আপনি তার কাছে গেলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন।
ইঁদুরের কথায় বাঘ কিছুটা ভরসা পেল। বলল, তাহলে কিভাবে সেই ডাক্তার ভিক্সেন আমাজনের চিকিৎসা নেওয়া যায় সেই ব্যবস্থা কর। ইঁদুরের খুব ভালো বন্ধু এক কাকের সঙ্গে আবার ঐ ডাক্তারের বেশ ভালো সম্পর্ক। তাই ইঁদুর ছুটে গিয়ে কাককে ধরলো ডাক্তারের সঙ্গে বাঘের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিতে। বন্ধুর অনুরোধে কাক ছুটে গেল ডাক্তার ভিক্সেন আমাজনের কাছে। কাকের কাছে রোগীর কথা শুনে ডাক্তার বলল, আমিতো সব রোগীরই চিকিৎসা করি কিন্তু বাঘের চিকিৎসা করতে গেলে সে তো আমাকেই খেয়ে ফেলতে পারে!
কাক ফিরে এসে ইঁদুরকে সঙ্গে নিয়ে বাঘকে ডাক্তার ভিক্সেন আমাজনের সব কথা খুলে বলল। বাঘ বুঝতে পেরে বলল, ডাক্তার ভিক্সেন আমাজনকে বল জঙ্গলের পাশের পাহাড়ে, পাথরের সরু কোনো গর্তে বসে একটু দূরত্বে থেকেই আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। যাতে ইচ্ছে করলেও শেয়ালীর কোনো ক্ষতি করতে না পারি। এজন্য যা খরচ হবে পুরোটাই আমি বহন করব। কাক তখনই দ্রুত উড়ে গিয়ে বাঘের প্রস্তাবের কথা জানাল। নরম মনের ডাক্তার ভিক্সেন আমাজন বাঘের প্রস্তাবে রাজি হলো।
অল্প সময়ের মধ্যে পাথরের সরু গর্তে চেম্বার প্রস্তুত করল। বাঘ আসার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করল। চোখের পরীক্ষার জন্য স্বরবর্ণ ও ব্যাঞ্জনবর্ণের এলোমেলো একটা চার্ট দেখিয়ে কোনটা কোন বর্ণ জিজ্ঞেস করে। কিন্তু রাজামশাই তো হা করে তাকিয়ে আছে। তারপর ক্ষীণ স্বরে বলে আমি তো পড়াশোনা জানি না। কিভাবে বলবো! পড়াশোনা না জানার কারণে অনেক লজ্জায় পড়ে গেল বাঘ। ডাক্তার তো পড়ে গেলেন মহা বিপদে। বললেন, আজ তাহলে চলে যান, দু’দিন পরে আবার আসবেন। এর মধ্যে আমি বিকল্প ব্যবস্থা করে রাখব। বাঘ ফিরে যাওয়ার সময় মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল সে তার উত্তরসূরিদের অবশ্যই পড়ালেখা শেখাবে যেন তাদের কখনো তার মতো লজ্জিত হতে না হয়। কারণ শিক্ষার মূল্য অনেক বেশি।
দু’দিন পরে আবার যথাসময়ে ডাক্তারের চেম্বারে বাঘ হাজির হলো। ডাক্তার এবার একটা ইংরেজি ‘ই’ বর্ণের মতো জিনিস দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা বলুন তো রাজামহাশয় এর তিনটা মাথা কোনদিকে আছে? বাঘ উত্তর দিল ডানদিকে। ‘ই’সদৃশ বস্তুটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, কাছে দূরে নিয়ে বিভিন্নভাবে জিজ্ঞেস করলেন। এভাবে বাঘের দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করলেন। শেষে একটা আই ড্রপ দিয়ে বললেন, দিনে তিনবার দুই ফোঁটা করে দুই চোখে দিতে। আর একটা চশমা দিলেন নিয়মিত ব্যবহার করার জন্য।
চশমা পড়লে বাঘ সবকিছু আগের সুস্থ অবস্থার মতোই দেখতে পায়। এতে বাঘ খুব খুশি হয়।
একদিন বাঘের প্রচ- ক্ষুধা পায়। জঙ্গলের পথে পথে খুঁজতে থাকে শিকার। দূর থেকে একটা হরিণ দেখতে পায়। ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে আস্তে আস্তে নিঃশব্দে হরিণের দিকে এগুতে থাকে বাঘ। হরিণ আনমনে গাছের পাতা খাচ্ছে। বাঘের উপস্থিতি সে টেরই পায়নি। আরও একটু কাছে গিয়ে ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে হরিণকে টার্গেট করে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘ। কিন্তু বুনোলতায় আটকে যায় বাঘের চশমা। বাঘ তখন সবকিছু ঝাপসা দেখে। আর হরিণ ততক্ষণে দেয় ভোঁ দৌড়।
শিকারটা তার হাতছাড়া হয়
বোঝেন নিজের ভুল
নিজেই বাঘ টেনে ছেঁড়েন
নিজের মাথার চুল।
তখন বাঘের ব্যর্থতা দেখে মজা পায় চারপাশের অত্যাচারিত সব পশুপাখি।