ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১১ মার্চ ২০২৫, ২৭ ফাল্গুন ১৪৩১

বাদ্যের অধিক শঙ্খবাদ্য

শত সহস্র বছর ধরে একই সুরে বাজলেও বিচিত্র ব্যবহার

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:১৬, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

শত সহস্র বছর ধরে একই সুরে বাজলেও বিচিত্র ব্যবহার

চমৎকার নকশা করা শঙ্খবাদ্য

যতভাবেই বাজানো হোক না কেন, অভিন্ন সুর। প্রায় একই রকম শোনায়। এর পরও শত সহ¯্র বছর ধরে বেজে চলেছে। কারণ শঙ্খবাদ্য বাদ্যের অধিক। শঙ্খ বা শাঁখের সুর এক হলেও বিচিত্র ব্যবহারের জন্য এটি বিখ্যাত। পূজাম-প, সঙ্গীতাসর থেকে শুরু করে যুদ্ধক্ষেত্রÑ কোথায় নেই এর ব্যবহার! ভালো কিছুর সূচনার মুহূর্তে শঙ্খে ফুঁ দেওয়া হয়। প্রার্থনার সময় এবং উৎসব পার্বণে বাজানো হয় শঙ্খ। 
হ্যাঁ, সমুদ্রে ভেসে বেড়ানো শামুকের শক্ত খোলস থেকেই প্রস্তুত করা হয় শঙ্খ। এটি কম্বু নামেও পরিচিত। গায়ের রং দুধের মতো সাদা। আকৃতি-প্রকৃতি বিবেচনায় শঙ্খের আলাদা আলাদা নাম হয়। এই যেমন: গোমুখ শঙ্খ, ধবল শঙ্খ, পানি শঙ্খ ও পঞ্চমুখী শঙ্খ। সাধারণত শঙ্খের মুখ বক্রাকার ছিদ্রবিশিষ্ট হয়। ভেতরের ছিদ্রপথও বক্রাকার। সামনের অংশে মুখ লাগিয়ে ফুঁ দিলে বিশেষ এক ধরনের শব্দ হয়। একেক জায়গায় শব্দের একেক মানে। পূজার সময় শঙ্খে সুর না তুললেই নয়। কারণ সুরটিকে মাঙ্গলিক জ্ঞান করা হয়।  
দেশীয় বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বিভিন্ন সময় লেখালেখি করেছেন ড. আবদুল ওয়াহাব। প্রয়াত লেখকের বর্ণনা অনুযায়ী, শঙ্খ বাংলা তথা ভারতের বহু প্রাচীন শুষির শ্রেণির বাদ্যযন্ত্র। আদি বাংলার সংগীত আসরগুলোতে শঙ্খতরঙ্গ বাজানো হতো। পুরাণেও শঙ্খবাদ্য বাজানোর নানা তথ্য পাওয়া যায়। মহাভারত, রামায়ণ ও অন্যান্য পুরাণে এ সংক্রান্ত কাহিনীর উল্লেখ আছে। মহাভারতে পাওয়া বর্ণনা অনুযায়ী, কৃষ্ণ শঙ্খ বাজাতেন। তার শঙ্খের নাম ছিল পাঞ্চজন্য। যুধিষ্ঠিরের শঙ্খের নাম অনন্ত বিজয়। বিষ্ণুও হাতে শঙ্খ রাখতেন। সমুদ্র মন্থনকালে শঙ্খে বিষ নিয়ে তা পান করেছিলেন শিব। ভগীরথ শঙ্খনিনাদের মাধ্যমে গঙ্গাকে মর্তে এনেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়।  
যুদ্ধক্ষেত্রে শঙ্খবাদ্য ব্যবহারের বিষয়টিও স্বীকৃত। ড. আবদুল ওয়াহাবের তথ্য, একসময় যুদ্ধের ময়দানে প্রবলভাবে শোনা গেছে শঙ্খবাদ্য। অস্ত্রের ঝনঝনানির মধ্যে সৈন্যরা যখন কেউ কারও কথা শুনতে পেতেন না তখন শঙ্খবাদ্য বাজিয়ে শত্রুর ওপর আক্রমণের নির্দেশ দেওয়া হতো। রণেভঙ্গ দেওয়ার ঘোষণাও আসত এই প্রক্রিয়ায়। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অনেক সংকেত দেওয়ার কাজে ব্যবহার হতো শঙ্খবাদ্য। রাজধানীতে শঙ্খ তৈরি ও বিক্রির মূল জায়গা শাঁখারিবাজার। শ্রীলঙ্কাসহ বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে শামুক আসে এখানে।

সমুদ্র থেকে কুড়িয়ে পাওয়া শামুকগুলোকে ব্যবহার উপযোগী করেন শাঁখারিরা। শামুকের গা কেটে অনেকটা রিলিফ আর্ট ওয়ার্কের মতো করে পৌরাণিক গল্পগাথা তুলে ধরেন তারা। একই প্রক্রিয়ায় দেব-দেবীর প্রতিকৃতি, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ইত্যাদি পৌরাণিক কাহিনী উপস্থাপন করা হয়। অনেকে আবার শাঁখে সোনা ও রূপার পাত বসিয়ে অলঙ্কৃত করেন। যে শাঁখের গায়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজ তার দাম বেশি। উৎসব পার্বণে বা বিয়ে- শাদীতে নকশা করা শঙ্খ বেশি ব্যবহৃত হয় বলে জানা যায়। 
এভাবে যুগ কাল নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেলেও, শঙ্খ আছে অত্যাবশ্যকীয় হয়েই। শঙ্খের প্রয়োজন আজও ফুরোয়নি।

×