.
কারও কাছে অদ্ভুত মনে হতে পারে। চমকেও উঠতে পারেন অনেকে। ভুল দেখছেন মনে করে চোখ কচলে পরিষ্কার করে তাকালেও একই দৃশ্য চোখে পড়বে। জমির খেত যেন উঠে এসেছে রাস্তার ধারে, বাড়ির আঙিনায়। মাটি থেকে উঁচুতে ঝুলছে বাঁধাকপি, বেগুন, মরিচ, শীতের শাক-সবজি। তবে পাল্টেছে খেতের নাম। নতুন পরিচয়ে এর নাম হয়েছে ঝুলন্ত সবজি বাগান। যমুনার তীরে বগুড়ার ধুনট উপজেলার ভা-ারবাড়ি গ্রামে গেলেই চোখে পড়বে নানা শাক-সবজির এই ঝুলন্ত বাগান। কাঁচামরিচ থেকে লালশাক, কপি থেকে বেগুন, টমেটো-সব ধরনের সবজিই রয়েছে ঝুলন্ত সবজি বাগানে। এই সবজি বাগান এলাকাকে দর্শনীয় করে তোলার সঙ্গে পাল্টে দিয়েছে সেখানকার পুরাতন দৃশ্য। ব্যক্তি উদ্যোগ ও বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) সহযোগিতায় চাষাবাদ অযোগ্য জায়গায় বস্তা ও প্লাস্টিকের পাত্রে মাটি ভরে তাতে চারা লাগিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই মনোলোভা সবজি বাগান। সর্বগ্রাসী যমুনার হাত থেকে জনপদকে রক্ষায় তৈরি হওয়া মাটিরবাঁধ শুধু চলাচলের রাস্তাই নয়, এই বাঁধ-রাস্তার ধারে এখন ঝুলছে সবজি বাগান। যমুনার ভয়াল থাবা থেকে বাঁচতে অন্যত্র চলে যাওয়া মানুষের পরিত্যক্ত বাড়ির জায়গাতেও ঝুলন্ত সবজি বাগানের দৃশ্য চোখে পড়বে।
ধুনট উপজেলা সদর থেকে যমুনার তীরঘেঁষা ভা-ারবাড়ি ইউনিয়নের একপ্রান্তের পাকা সড়ক ছেড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। এই মাটির তৈরি বাঁধের রাস্তায় উঠলেই চোখে পড়বে বাঁধঘেঁষে থাকা বাড়িঘরের সামনে বাঁশের খুঁটি পুঁতে রশি দিয়ে ঝোলানো বস্তায় ঝুলন্ত সবজি বাগান। একটু এগিয়ে বাঁধের উঁচু থেকে নিচের দিকে তাকালে থমকে দাঁড়াতে হয়। বাড়ির আঙিনার সীমানা ধরে ঝুলন্ত সবজি বাগান। এটি সানজিদা আক্তার পলি- জাহিদ হাসান সাগর দম্পতির বাড়ি। বাড়ির প্রবেশমুখ থেকে ছোট্ট আঙিনার দু’ধারে তিনস্তর পর্যন্ত ঝুলন্ত সবজি বাগান। বাঁশ ও বাঁশের চরাট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ঝুলন্ত সবজি বাগান। বাঁশের সঙ্গে ঝুলছে নানা জাতের শাক-সবজির চারা। এই দম্পতির কথা, তারাই এলাকাতে প্রথম ঝুলন্ত সবজির বাগান তৈরি করেন। জানালেন, শখ থেকে এ ধরনের সবজি বাগান তৈরির কথা চিন্তায় এলেও পরিবারের চাহিদা মেটানোর বিষয়টিও তাদের সবজি বাগান তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করে। তবে সবজি বাগান করার শখ থাকলেও তা করে টিকিয়ে রাখা সহজ ছিল না। কারণ যমুনা লাগোয়া ও বাঁধঘেঁষে বাড়ি হওয়ায় একটুতেই পানি ওঠে উঠোনে। বাড়িতে ছাগলও পালেন তারা। ছাগল ও পানি থেকে সবজি বাগান রক্ষা করা কঠিন। অনেক ভেবে-চিন্তে অবশেষে তারা ঝুলন্ত বাগান তৈরির পরিকল্পনা বের করেন। সাগর কেবল টিভি নেটওয়ার্কের ব্যবসা করেন। স্ত্রী পারুলের আগ্রহে সবজি বাগান তৈরি করতে দু’জন এক সময় লেগে পড়েন। এটি ৫/৬ বছর আগের কথা। মাঝে তারা মুরগির খামার করেন।
এখন আবার শুরু করেছেন ঝুলন্ত সবজি বাগান। উঠোনের সীমানার তিনদিকে তাদের বাগান। বাঁশের ওপর তৈরি বলে বাড়ির সামনের অংশে ছোট্ট উঠোনে সীমানার জায়গা বাগানের কারণে কমেনি। ঘরের দরজা খুললেই তাদের ঝুলন্ত সবজি বাগান। বাঁশের সঙ্গে মাটির বস্তায় সবজিগাছ। চট ও প্লাস্টিকের বস্তা ছাড়াও প্লাস্টিকের বিভিন্ন ধরনের পুরাতন বোতল ও পাত্র কেটে সেখানে মাটি ও জৈবসার মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছে ঝুলন্ত বাগানের জমি। তাতেই চাষ করছেন সবজি। লাউ, মরিচ, টমেটো, বেগুন, ঢেঁড়শ, পটলসহ বিভিন্ন ধরনের শাক রয়েছে বাগানে। পারুল জানালেন, এই বাগান করে যেমন সময় কাটে তেমনি পরিবারের সবজির চাহিদা এখান থেকেই মেটে। সাগর-পলি দম্পতি জানালেন, আগামীতে এই বাগান আরও বড় করার ইচ্ছে রয়েছে। ঝুলন্ত বাগানের চিত্র শুধু পলি-সাগর দম্পতির বাড়িতে নয় সেখানকার আরও কয়েটি বাড়ির সামনেও দেখা গেল এমন বাগান। বাঁধ থেকে যমুনার দিকে চলে যাওয়া রাস্তার দু’পাশে দেখা মিলল ঝুলন্ত কপির বাগান। এর পরেই পরিত্যক্ত এক বাড়ির উঠোনে কয়েকস্তরের চমৎকার ঝুলন্ত বাগান। এর মালিক মেরিনা খাতুন জানালেন, তাদের এই বাগানে কোনো খরচ হয়নি। একটি এনজিও তাদের করে দিয়েছে। এনজির সহায়তায় তিনি বাগানটি করছেন। বন্যা ও নদী ভাঙনের কারণে তারা বাড়ি ছেড়ে পাশেই বাঁধের ধারে আরেকটি টিনের বাড়ি করেছেন। পুরাতন বাড়িঘর পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকলেও এর উঠোন এখন ভরে উঠেছে ঝুলন্ত সবজি বাগানের নানা সবজিতে। সবচেয়ে উপরের স্তরে (থাক) শীতের বেগুনের গায়ে সূর্যের আলো পড়ে আড়মোড়া ভাঙছে ঝুলন্ত সবজিখেত আর প্রথম থাকে (স্তরে) একেকটি বাঁধাকপি বাগানকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। মেরিনা জানালেন, তাদের আর বাইরে থেকে সবজি কিনতে হয় না। সব ধরনের সবজি তার ঝুলন্ত বাগানে রয়েছে। বাড়ি থেকে এসে তার ঝুলন্ত সবজি বাগানের পরিচর্যা করতে কোনো সমস্যা হয় না। মেরিনা পলি খাতুনদের ঝুলন্ত সবজি বাগান এলাকার পরিবেশ পাল্টে দিয়েছে। পলি জানালেন, অনেকেই তাদের ঝুলন্ত সবজি বাগান দেখতে আসেন।
এনজিও কর্মকর্তা আবুল বাশার জানিয়েছেন, তাদের একটি প্রকল্পের আওতায় যমুনাতীরবর্তী ভা-ারবাড়ি ও শহরাবাড়ি ইউনিয়নের বেশ কয়েটি গ্রামে ঝুলন্ত সবজি বাগান করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ভা-ারবাড়ি গ্রামে ৪৫ টি ঝুলন্ত সবজি বাগান এখন রয়েছে। পাশের গোসাইবাড়ি ইউনিয়নেও একই ধরনের ঝুলন্ত সবজি বাগান করে দেওয়া হয়েছে। তারা কাজ করছেন ২০২১ সাল থেকে।
গোবিন্দগঞ্জে আগাম শিমের ভালো দামে চাষির মুখে হাসি, মাচায় আগ্রহ ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা থেকে জানান, উত্তরাঞ্চলে সবজি চাষে অগ্রসর গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এবার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আগাম শিমের আবাদ বাড়ছে। লাভজনক এই সবজি চাষে দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে এখানকার কৃষকের মাঝে। মাচা পদ্ধতিতে চাষ করায় আগাম সবজি হিসেবে ভালো দাম পেয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ায় প্রতিবছর সম্প্রসারণ ঘটছে এই শিমের আবাদ। নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে এই এলাকায় জমিতে মাচা করে শিমের আবাদ করছেন চাষিরা। আগাম শীতকালীন শিম চাষে রোগবালাই প্রবণতার কারণে বাড়তি পরিচর্যার কারণে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও ফলন এবং বাজারদর ভালো পাওয়ায় আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন তারা।
কয়েক বছর ধরে উপজেলার কামারদহ, গুমানীগঞ্জ, কোচাশহর, শালমারা, শিবপুর, মহিমাগঞ্জ, রাখালবুরুজ, হরিরামপুর, নাকাইহাট, তালুককানুপুর, দরবস্ত, সাপমারাসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে অন্যান্য শাক-সবজির পাশাপাশি শিম চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। সবজি হিসেবে বাজারে শিমের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় শুরু হয় কৃষক পর্যায়ে বাণিজ্যিক শিম চাষের সম্প্রসারণ। এক সময় বসতবাড়ির আশপাশে স্বল্প পরিসরে শিম আবাদ হলেও এখন উপজেলার অনেক এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে শিম করা হচ্ছে। রবি মৌসুমে কৃষকরা খেতে মাচা পদ্ধতিতে ব্র্যাক-১ ও বারি-১,২,৩ ও ৪ জাতের শীতকালীন শিম চাষ করছেন তারা। সবচেয়ে বেশি শিম উৎপাদনকারী উপজেলা হিসেবে জেলার অন্যান্য উপজেলার মধ্যে গোবিন্দগঞ্জের নামও রয়েছে।
শীতের শুরুতেই যাতে বাজারে শিম সরবরাহ করা যায় এজন্য আগাম শিম চাষে কৃষকরা শ্রাবণ মাসের শুরুতেই জমিতে শিমবীজ বপণ করেন। তিন মাস পার হলে কার্তিকের শুরুতেই শিম ওঠানো শুরু হয়। চলতি মৌসুমে ভারি বর্ষণের কারণে আবহাওয়া প্রতিকূল থাকায় শিমের রোগবালাইয়ের কারণে বাড়তি পরিচর্যা করতে হচ্ছে চাষিদের। তবে উৎপাদনের শুরুতেই আগাম শিমের বাজারদর ভালো পাওয়ায় আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা।
গুমানীগঞ্জ ইউনিয়নের ঘুগা গ্রামের শিম চাষি আব্দুল বাছেদ বলেন, উৎপাদনের শুরুতেই বাজারে প্রতিমণ শিম ৫ হাজার ২শ’ টাকা দরে বিক্রি করেছি। তবে এখন জাতভেদে হাট-বাজারে প্রতিমণ শিম ৩ হাজার ৮শ’ থেকে ৪ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ভাল দামে বেচতে পেরে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান জানান, শীতকালীন সবজি হিসেবে বাজারে শিমের চাহিদা থাকায় বাণিজ্যিকভাবে কৃষক পর্র্যায়ে শিম আবাদেও ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটছে। এতে চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। শিম চাষে উন্নত জাত, রোগবালাই ও আবাদের পদ্ধতিসহ নানা বিষয়ে চাষিদের প্রযুক্তিগত পরামর্শ-সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এবার উপজেলায় কৃষক এবং পারিবারিকভাবে প্রায় ২০ হেক্টর জমিতে শিমের চাষ হয়েছে।