.
সুন্দরবনের দক্ষিণে দুবলার চরে এখন চলছে শুঁটকির ভরা মৌসুম। বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী এই চরে প্রায় ২০ হাজার মৎস্যজীবীর পদচারণা। টানা ছয় মাস তারা সাগরে মাছ ধরে শুঁটকি তৈরির কাজ শুরু করেছে।
দুবলার চরে চলে মহাজনদের সীমাহীন আধিপত্য। এখানে সরকারি শাসন যেন অচল। সাগর, বন সবখানেই তাদের নিয়ন্ত্রণ। এই মহাজনদের খেয়াল-খুশিতে চলে ২০ হাজার জেলের জীবন-জীবিকা। তাই হাড়ভাঙা খাটুনির পরও অভাবের সাগরে কূল খুঁজে পান না মৎস্যজীবীরা।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মৎস্যজীবীরা মাছ ধরা ও শুকানোর কাজে নেমে পড়েছেন। টানা পাঁচ মাস এই কাজ করেন তারা। প্রতি মৌসুমে এই পল্লিতে শত কোটি টাকার লেনদেন হলেও শুঁটকি শিল্পে নেই সরকারি কোনো বড় উদ্যোগ। এ সময় জেলেরা নিজ উদ্যোগে অস্থায়ী ঘর ও মাচা তৈরি করেন। এই ছয় মাসের বাণিজ্যে মহাজনরা হচ্ছেন কোটিপতি। জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরে মাছ ধরেন কিন্তু দারিদ্র্য তাদের পিছু ছাড়ে না। বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে জেলেরা মাছ ধরে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করেন বটে তবে তা নিজেরা বিক্রি করতে পারেন না। এমনকি সমুদ্রের মাছও তারা বিক্রি করতে পারেন না। মহাজন অথবা ‘সাহেবদের’ কাছে বিক্রি করতে হয়। এভাবে নিজেদের খাওয়া-থাকার খরচ মিটিয়ে সামান্য কিছু টাকা হাতে নিয়ে পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরতে পারেন জেলেরা। ‘সাহেবরা’ বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে মাথাবিহীন কাঁচা চিংড়িমাছ সংগ্রহ করেন। তারাই মূলত বন বিভাগ থেকে সাগরে জেলেদের মাছ ধরার অনুমতির ব্যবস্থা করে আসছেন যুগ যুগ ধরে।
এবারও এই চরে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণে ১৫ জনের নামে লাইসেন্স দিয়েছে বন বিভাগ। সেই ঘুরেফিরে এখনো আগের ‘সাহেবদের’ দখলেই রয়ে গেছে দেশের
অন্যতম শুঁটকিপল্লি হিসেবে খ্যাত ‘দুবলার চর’। এখানে নেই কোনো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। কেউ অসুস্থ হলে ১২০ কিমি পথ পেরিয়ে তবে মংলা বন্দরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় এই পল্লিতে দস্যুতা কমে গেলেও যুগ যুগ ধরে ‘বড় সাহেব’ হিসেবে পরিচিত কামাল উদ্দিনের রয়েছে একচ্ছত্র আধিপত্য। তার নিয়ন্ত্রণে অন্তত ১৫ জন সেকেন্ড ইন কমান্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে দুবলার চরের জীবন-জীবিকা। এজন্য মহাজন ও জেলেরা তাদের ওপর নির্ভরশীল। অনেকেই তাদের জুলুম-নিপীড়ন মুখ বুজে সহ্য করেন, মুখ খুলতেও সাহস পান না। শুক্রবার সুন্দরবনের দুবলার চর ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণে সুন্দরবনের কটকার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং হিরণ পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি দ্বীপ হলো এই দুবলার চর। এই দ্বীপটির আয়তন ৬৬.৫ বর্গ কিমি। এটি বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত। দুবলার চর সুন্দরবনের ৪৫ এবং ৮ নম্বর কম্পার্টমেন্টে অবস্থিত। খুলনা শহর বা বাগেরহাট জেলার মোংলা বন্দর থেকে ট্রলার কিংবা লঞ্চযোগে যেতে হয় দুবলার চরে। এটি সুন্দরবনের একটি পর্যটন কেন্দ্রও বটে। মাছ ধরার মৌসুমে এখানে পাঁচ থেকে ছয় মাস বসবাস করেন জেলেরা। আলোরকোল, কোকিলমনি, হলদিখালি, কবরখালি, মাঝেরকিল্লা, অফিসকিল্লা, নারিকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া, মেহেরআলির চর এবং শ্যালারচর নিয়ে গঠিত দুবলার চর। কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে এটি একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। দুবলার চর মূলত জেলে গ্রাম হিসেবেই পরিচিত। মাছ ধরার সঙ্গে চলে শুঁটকি তৈরির কাজ। বর্ষা মৌসুমের পর বহু জেলে পাঁচ মাসের জন্য সুদূর কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা থেকে এসে ডেরা বেঁধে সাময়িক বসতি গড়েন এখানে।
এই দ্বীপটিতে প্রতি বছরের কার্তিক মাসে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাসমেলা এবং পুণ্যস্নানের আয়োজন হয়। প্রায় ২০০ বছর ধরে এ রাসমেলা হয়ে আসছে। জানা যায়, ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে কোনো এক বনবাসী ভক্ত, নাম হরিভজন (১৮২৯-১৯২৩), এই মেলা চালু করেন। প্রতিবছর অসংখ্য পুণ্যার্থী রাসপূর্ণিমা উপলক্ষ করে এখানে সমুদ্রস্নান করতে আসেন। দুবলার চরে সূর্যোদয় দেখে ভক্তরা সমুদ্রের জলে ফল ভাসিয়ে দেন। কেউবা আবার বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ভজন-কীর্তন গেয়ে মুখরিত করেন চারপাশ। দুবলার চরের রাসমেলায় স্থানীয় লোকজন ছাড়াও দূর-দূরান্তের শহরবাসী এমনকি বিদেশী পর্যটকেরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়ে থাকেন। গত ১২ অক্টোবর তিনদিনব্যাপী এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অনেক বিদেশী পর্যটকেরও সমাগম হয়।
দুবলার চরে ধু ধু বালুচরে টেলিটক ছাড়া আর কোনো মোবাইল অপারেটর কোম্পানির নেটওয়ার্কের সংযোগ নেই। এখান থেকে আহরিত শুঁটকি চট্টগ্রামসহ দেশের পাইকারি বাজারে মজুত ও বিক্রয় করা হয়। সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের সদর দপ্তর বাগেরহাট থেকে মাছ সংগ্রহের অনুমতিসাপেক্ষে বহরদার ও জেলেরা দুবলার চরে প্রবেশ করেন।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে জেলেরা বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনের সংলগ্ন নদী থেকে ধরে এনে এই চরে প্রচুর পরিমাণে শুঁটকি মাছ তৈরি করেন। রূপচাঁদা, লইট্যা, ছুরিসহ প্রায় ৮৫ রকমের মাছ এবং বিভিন্ন ধরনের চিংড়ি সুন্দরবনে শুকিয়ে শুঁটকি করা হয়। চরে জেলেদের থাকার জন্য বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে আলোরকোলে ৮২৫টি, মাঝেরকেল্লায় ৪০টি, নারিকেলবাড়িয়ায় ৯৫টি এবং শ্যালারচরে ৭৫টি অস্থায়ী জেলেঘর নির্মাণ করেছে। ছন দিয়ে এসব ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। আলোরকোলে ৯০টি দোকান, ৫১টি মাছের ডিপো, মাঝেরকেল্লায় দুইটি দোকান, পাঁচটি মাছের ডিপো, নারিকেলবাড়িয়ায় দুইটি দোকান, চারটি ডিপো এবং শ্যালারচরে দুইটি দোকান ও চারটি মাছের ডিপো বসানো হয়েছে। সাগরতীরে জেলেদের অস্থায়ী থাকার ঘর, মাছ শুকানোর চাতাল এবং মাচা বানাতে সুন্দরবনের কোনো গাছপালা ব্যবহার না করার জন্য বন বিভাগের নির্দেশনা আছে। এসব বানাতে জেলেরা গ্রামের গাছপালা সঙ্গে নিয়ে যান সেখানে।
সাতক্ষীরা, ফরিদপুর, খুলনা, যশোরসহ বিভিন্ন জেলার মানুষ সেখানে বছরে টানা পাঁচমাস কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই পাঁচমাসের আয়-রোজগারের টাকায় চলে তাদের সারা বছরের হিসাব। নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে মার্চ মাস পর্যন্ত এই পাঁচ মাসের সময়কালে তারা দুই-একমাস পর ৪-৭ দিনের জন্য ছুটিতে বাড়িতে পরিবারের কাছে যাওয়ার সুযোগ পান। প্রায় ২ হাজার ট্রলার ও নৌকা নিয়ে এখানে আগত জেলেরা নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এই পাঁচমাস সাগরে মাছ ধরেন। ধরে আনা মাছ জেলেরা মাচায় শুকিয়ে শুঁটকি করেন। এদের ১০-১২ জনের একটি গ্রুপ ১০ দিন পর্যন্ত নদীতে থেকে জাল ফেলে কেবল মাছ ধরেন। অপর একটি গ্রুপ ট্রলারযোগে বিভিন্ন জেলের জাল থেকে ধরা মাছ সংগ্রহ করে দুবলার চরে পৌঁছে দেন। আরেকটি গ্রুপ সেই মাছ ট্রলার থেকে বিভিন্ন ড্রামে তুলে চাতালে আনেন। এরপর চাতালে থাকা আরেকটি গ্রুপ শুঁটকির কাজ করেন। পরে অন্য একটি দল তা শুকানোর জন্য মাটিতে বিছানো নেট বা বাঁশের মাচায় ঝুলিয়ে রাখেন।
বাগেরহাট রামপালের শুঁটকি ব্যবসায়ী ইমরান ফরাজী জানান, তার বাবা কুদ্দুস ফরাজী ৫০ বছর আগে এই চরে শুঁটকি ব্যবসা করেছেন। তার অপর ভাই মুতাচ্ছিন ফরাজীও এই ব্যবসায় জড়িত। তিনি জানান, এই খাত থেকে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব পেলেও নেই সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা। তারা এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে এই ব্যবসা করে আসছেন। তিনি বলেন, মূলত ‘সাহেবরা’ বন বিভাগ থেকে তাদের মাছ ধরার অনুমতির ব্যবস্থা করে থাকেন। তারা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন জেলে-মহাজনদের কাছে। সাহেবরা কোনো সুদ না নিলেও বিনিয়োগের বিপরীতে কাঁচা চিংড়ি মাছ নিয়ে থাকেন। চিংড়ি মাছ ধরার পর মাথা কেটে রাখা হয়। সাহেবরা এসব মাছ ১২-২৫ হাজার টাকা মণ দাম ধরে কিনে থাকেন মহাজন জেলেদের কাছ থেকে। তারা সেগুলো বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করেন। যা পরে বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। তবে মহাজনদের নির্দেশ ছাড়া একটি মাছও বিক্রির সুযোগ নেই এখানে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুবলার চরের একাধিক জেলে ও মহাজন জানান, কামাল উদ্দিন, খুলনার পিন্টু কমিশনার, খোকন, হক, হাকিম বিশ্বাস, জাহিদুল সাহেব তাদের এখানে বিনিয়োগ করেন। ‘সাহেবরা’ বিনিয়োগ করলেও সেই টাকা পর্যাপ্ত না হওয়ায় মহাজনরা এনজিও থেকে শতকরা ১৪ টাকা হারে সুদে টাকা নেয়। পাঁচমাসের জন্য এক লাখ টাকা নিলে বাড়তি ২০ হাজার টাকা সুদ গুনতে হয়। তবে অর্থ বিনিয়োগ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তার কারণে তারা ‘সাহেবদের’ আশীর্বাদ মনে করেন। তারা জানান, র্যাব ও কোস্ট গার্ডের তদারকি এবং নজরদারির কারণে দুবলারচরে দস্যুতা অনেকটাই কমে গেছে। তবে পুরো দুবলার চর নিয়ন্ত্রণ করেন কামাল উদ্দিন। তিনি যুগ যুগ ধরে দুবলার চরে একক আধিপত্য বিস্তার করে চলছেন।
দুবলার চরে বসবাসরত ৩০ থেকে ৫০ হাজার জেলের সব কর্মযজ্ঞ ১৫ জন ‘সাহেব’ নিয়ন্ত্রণ করেন। আর এসব সাহেবের ‘সাহেব’ দুবলার চর ফিশারম্যান গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ। জেলেদের অনেকে তাকে ‘বড় সাহেব’ বা ‘কামাল মামা’ বলে ডাকেন। জেলেদের অভিযোগ, মূলত জেলেরা বন বিভাগ থেকে মাছ ধরার জন্য লাইসেন্স বা অনুমতিপত্র পান না। এই লাইসেন্স নিয়ন্ত্রণ করেন এই কামাল উদ্দিনসহ ‘সাহেবরা’। কোন জেলে কোথায় মাছ ধরবেন, কার কাছে বিক্রি করবেন, সবকিছুই কামাল সাহেব নিয়ন্ত্রণ করেন। দুবলার চরে চারটি সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে। এর মধ্যে মেহেরআলী সাইক্লোন শেল্টার দখল করে কামাল উদ্দিন গড়ে তুলেছেন নিজের সুরম্য প্রাসাদ। মৌসুমের ৫ মাস কামাল উদ্দিন রাজার হালে এখানেই থাকেন এবং চরের সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজের আখের গোছান। দুবলার চরের আলোরকোলে গড়ে ওঠা নিউ মার্কেট পুরোটাই এককভাবে কামাল উদ্দিনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ৯৬টি দোকানের কেউই ভয়ে কামালের বিরুদ্ধে কথা বলতে চান না। জেলেরা আরও অভিযোগ করেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র থেকে মাছ ধরি, কিন্তু ‘সাহেবদের’ যন্ত্রণায় মাছের সঠিক মূল্য পাই না। কামাল উদ্দিন এই চরের মাছ ও শুঁটকির দর নিয়ন্ত্রণ করেন। এ ছাড়া চিংড়ি মাছের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই। অনেক সময় জেলেরা নদী বা সমুদ্র থেকে চাকা চিংড়ি ধরেন, কিন্তু সেগুলো কামালের লোকজন নিয়ে যায়। আবার জেলেরা কম মূল্যে কামালের কাছেই চিংড়ি বিক্রি করতে বাধ্য হন। বড় কোনো মাছ জেলেদের জালে ধরা পড়লে সেই মাছও চরে আনা হয় না। জেলেদের নৌকা থেকে কামাল উদ্দিনের লোকজন সেগুলো নিয়ে যায়। জেলেরা জানান, কামাল উদ্দিন খুবই চতুর ও ভয়ংকর লোক। তার সঙ্গে যারা ব্যবসা করতে গেছেন তারাই নিঃস্ব হয়েছেন। তার আক্রোশের কারণে অনেক জেলে সর্বস্বান্ত হয়েছেন, অনেক জেলেই দুবলার চরে ঢুকতে পারেন না। কামালের অনুসারীরাই ছয় মাসের বাণিজ্যে কোটিপতি হচ্ছেন। অন্য জেলে বা মহাজনেরা বড় বিনিয়োগ করেও নিঃস্ব হয়ে মৌসুম শেষ করছেন।
৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে দুবলার চরে মাছ ধরতে আসা জাহাঙ্গীর হোসেন নামে এক জেলে জানান, দিনে রোদে পুড়ে আবার রাত জেগে সাগরে মাছ ধরতে হয়। অনেক কষ্ট। এরপর সাহেবদের কাছে সেই মাছ বিক্রি না করলে গালাগাল করে, নির্যাতন করে।
এদিকে শীত মৌসুমে দুবলার চরে জেলে ও অন্যান্য কর্মী মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার লোক বাস করেন। কিন্তু সেখানে নেই কোনো মেডিক্যাল ক্যাম্প, নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থাও। এ বিষয়ে জেলে নাহিদুল ইসলাম মৃধা বলেন, এখানে সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। চরের কুয়া থেকে পানি উঠিয়ে সেই পানি খেতে হয়।
পিরোজপুরের প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) জিয়া উদ্দিন আহমেদ ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে তার ছোট ভাই কামাল উদ্দিন আহমেদ, ভাগ্নে শাহানুর রহমান শামীম এবং অন্য কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে দুবলার চরে আসেন। বনদস্যু বাহিনীগুলোর হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত সুন্দরবনের জেলেদের সংগঠিত করে শুঁটকি মাছের ব্যবসা শুরু করেন। ২০১৩ সালে পূর্ব সুন্দরবনের চরপুঁটিয়ায় বন্দুকযুদ্ধে জলদস্যু মোর্তজা বাহিনীর চার সদস্য নিহত ও মেজর জিয়া গুলিবিদ্ধ হন। ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই অসুস্থ হয়ে মারা যান জিয়া। এরপর কয়েকজন সাহেবকে নিয়ে ভিন্নভাবে দুবলার চরের নিয়ন্ত্রণ নেন কামাল উদ্দিন। সেখানে দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপ সমিতি নামে একটি অফিস গড়ে তোলেন কামালউদ্দিন। তিনি কয়েক যুগ ধরে সাধারণ সম্পাদকের পদ আঁকড়ে রাখায় কোনো জেলে অভিযোগ দিতে সাহস পায় না। জেলেদের বিস্তর অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপ সমিতির সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন আহমেদ জানান, এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি জেলে, বাওয়ালি, মৌয়ালী ও শুঁটকি ব্যবসায়ীদের সার্বিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছি। এখানে জেলেরা নিরাপদে এখন মাছ আহরণ করতে পারে। কোনো চাঁদা দিতে হয় না। আমার কারণে এসব সম্ভব হয়েছে। আর জেলেরা চাইলে সমিতিতে অভিযোগ দিতে পারেন। এরপর এর সুষ্ঠু সমাধান করা যেতে পারে।
বন বিভাগের সূত্র ও মৎস্যজীবীরা জানান, মৌসুমে মাছ ধরার জন্য ১০ হাজার টাকা ফি দিয়ে বন বিভাগ থেকে লাইসেন্স সংগ্রহ করা হয়। ওই লাইসেন্স প্রতিবছর নবায়ন করতে খরচ হয় ৭০০ টাকা। এই মৌসুমে দুবলার চরে ১৫ জন মাছ ধরার অনুমতি পেয়েছেন। তারা হলেন কামাল উদ্দিন আহমেদ, আফিয়া বেগম, খান শফিউল্লাহ, শেখ মইনুদ্দিন আহমেদ, আরিফ হোসেন, রেজাউল শেখ, এবি এম মুস্তাকিন, ইদ্রিস আলী, হাকিম বিশ্বাস, জালাল উদ্দিন আহমেদ, সুলতান মাহমুদ, বেলায়েত সরদার, কামরুন নাহার, শাহানুর রহমান ও আসাদুর রহমান সরদার। কিন্তু দুবলার চরে যারা কামাল সাহেবের তালিকাভুক্ত জেলে তারা দুবলার চরে আধিপত্য বিস্তার করছে। তারাই বন বিভাগের কর্মকর্তা এবং জেলে ও মহাজনদের কাছে তিনি ‘সাহেব’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন।
সুন্দরবনের দুবলার চর বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রহ্লাদ চন্দ্র রায় জানান, ঘর নির্মাণসহ মাছ প্রক্রিয়াজাতের জন্য ১৫ জনের নামে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। তাদের লোকজন নিয়ে তারাই সব নিয়ন্ত্রণ করে। তবে কোনো বিচ্যুতির বিষয়ে আমাদের কাছে এখনো কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান বন বিভাগের এই কর্মকর্তা।
মাছ শিকার আর শুঁটকির মৌসুমে কথিত সাহেবদের অত্যাচার-নির্যাতনের বিষয়ে জেলেরা লিখিত অভিযোগ দিলে দুবলার চরকে সাহেবমুক্ত করা হবে জানিয়ে পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মো. নুরুল করিম জানান, দুবলার চরে দীর্ঘদিন সুপেয় পানির সমস্যা ছিল। কিন্তু এবার জেলেদের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তিনি জানান, স্বাস্থ্যসেবার জন্য সম্প্রতি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে আলোচনা হয়েছে। এ সময় দুবলার চরে অন্তত একজন চিকিৎসক এবং পর্যাপ্ত ওষুধের ব্যবস্থা করতে সিভিল সার্জনকে অনুরোধ করা হয়েছে। সিভিল সার্জন বিষয়টি নিশ্চিত করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।