ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বিপন্নপ্রায়

চশমাপরা ও মুখপোড়া হনুমান এখনো দেখা মেলে

মো. মামুন চৌধুরী, হবিগঞ্জ

প্রকাশিত: ২১:৫০, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

চশমাপরা ও মুখপোড়া হনুমান এখনো দেখা মেলে

সাতছড়ি বনে চশমাপরা হনুমান ও মুখপোড়া হনুমান

চুনারুঘাটের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে ও রেমা-কালেঙ্গায় মহাবিপন্ন হনুমান ঝুঁকিতে রয়েছে। হবিগঞ্জের সাতছড়িতে আইইউসিএন’র তালিকায় বাংলাদেশে মহাবিপন্ন চশমাপরা হনুমান ও মুখপোড়া হনুমানের মধ্যে সংকরায়ন ঘটেছে। এর ফলে জন্ম নেওয়া মিশ্র প্রজাতির এমন ২টি হনুমানের সন্ধান পেয়েছেন গবেষক দল। দীর্ঘ ৬ বছর এ উদ্যানে গবেষণা কাজ শেষ করে জার্মানির প্রাইমেট সেন্টারে জীনগত পরীক্ষায় সংকরায়নের বিষয়টি নিশ্চিত হন গবেষণা দলটি।
গবেষণা দলটি মনে করছে, সংকরায়নের ফলে এ উদ্যানে এখনো টিকে থাকা ১১ থেকে ১২টি দলে বিভক্ত মহাবিপন্ন হনুমান প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়েছে। এ নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব প্রাইমেটলজি প্রিঞ্জার নেচারে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।
বিশ্ববিখ্যাত জার্মান প্রাইমেট সেন্টারের পিএইচডি শিক্ষার্থী ও আইইউসিএন প্রাইমেট বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য তানভির আহমেদ জানান, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তারা সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
আইইউসিএন এর তালিকায় বাংলাদেশে মহাবিপন্ন চশমাপরা হনুমান ও বিপন্ন মুখপোড়া হনুমানের ১০ থেকে ১২টি দল সাতছড়িতে রয়েছে। প্রত্যেকটি চশমাপরা হনুমানের দলে ৪ থেকে ২৬টি এবং মুখপোড়া হনুমানের দলে ৪ থেকে ১৭টি করে চলাচল করে। উভয়েই মূলত বৃক্ষচারী প্রাণী এবং প্রয়োজনে মাটিতে নামে। বন্য লতাপাতা, ফুল-ফল, কীটপতঙ্গ এদের খাবার।
এরা খাদ্য গ্রহণ ও মলের মাধ্যমে বিভিন্ন ফলের বীজ বনের ভেতরে ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যা প্রকৃতিগতভাবে বনকে নতুন জীবন দান করে। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানটি অত্যন্ত ছোট (২৪৩ হেক্টর) হওয়ার কারণে এদের চলাফেরা ও বসবাস সংকুচিত হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, আমরা সাতছড়িসহ সিলেটের ৬টি বনে মিশ্র প্রজাতির হনুমানের ৯৮টি দলকে পর্যবেক্ষণ করি। এতে দেখা যায় ৪১টি দল চশমাপরা হনুমান এবং ৪৯টি মুখপোড়া হনুমানের দল। বাকি ৮টি ছিল মিশ্র প্রজাতির হনুমানের দল। গবেষকরা শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ৩টি সংকর হনুমান চিহ্নিত করেন।
এর মধ্যে দুইটি সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান এবং একটি উপজেলার রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যের। ৩টির মধ্যে একটি পূর্ণবয়স্ক মহিলা এবং দুটি বাচ্চা। যা নিয়মিত দুধ পান করে। কিন্তু সংকরায়ন নিশ্চিত হওয়ার জন্য গবেষণা দলটি সাতছড়ি থেকে তাদের মল সংগ্রহ করে পাঠায় জার্মান প্রাইমেট সেন্টারে। সেখানে মল পরীক্ষা করে গবেষণায় উঠে আসে সংকরায়নের প্রকৃত তথ্য। সাতছড়িতে মিশ্র দলে জন্মানো সম্ভাব্য হনুমানের পিতা চশমপরা হনুমান এবং মাতা মুখপোড়া হনুমান।
গবেষণায় বলা হয়, সংকর হনুমানের উপস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। কারণ এটি ইঙ্গিত দেয় যে, এই দুই বিপন্ন প্রজাতির মধ্যে জেনেটিক প্রবাহ তাদের ভবিষ্যৎ জেনেটিক অপরিবর্তনীয় প্রভাব ফেলতে পারে।
গবেষক দলের সদস্য তানভির আহমেদ বলেন, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়কে ঘন ঘন যান চলাচল এবং বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া বিদ্যুতের তার দুই প্রজাতির হনুমান কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে। কারণ গত কয়েক বছরে গাড়ি চাপায় এবং বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অনেকগুলো হনুমান মারা গেছে। তিনি এ সড়কে যান চলাচল সীমিত এবং গতি কমিয়ে আনার কথাও জানান। তিনি বলেন, গাছ কাটা, বন দখল, চাষাবাদ, বাড়ি তৈরি ও উঁচু গাছ কমে যাওয়ার কারণে হনুমান কমে যাচ্ছে। সিলেটের বিভিন্ন বনে এখন পর্যন্ত যথাক্রমে চশমাপরা ৫শ ও মুখপোড়া ৬শ হনুমান এখনো টিকে আছে। রক্ষা করা না গেলে দ্রুত বিলুপ্তি ঘটবে এই প্রাণীর।  
জার্মান প্রাইমেট সেন্টারের সিনিয়র বিজ্ঞানী ও লেখক অধ্যাপক ড. ক্রিস্টিয়ান রোস বলেন, এটি শুধু স্থানীয় সমস্যা নয়, এটি বৃহত্তর বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের অংশ। যখন আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যায়, প্রাণীরা এমনভাবে মিশ্রিত হয় যা প্রকৃতিগতভাবে ঘটত না। তার ফলস্বরূপ সেখানে সংকরায়ন ঘটতে পারে, এমনকি এক বা একাধিক প্রজাতিকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিতে পারে।

×