.
উত্তরের জনপদ ঠাকুরগাঁওয়ে মৌসুমি বায়ু বিদায় নিয়েছে। দিনের ভ্যাপসা গরম শেষে রাতের শেষ ভাগ থেকে শুরু হয় মৃদু বাতাস, সঙ্গে হাল্কা কুয়াশা। ভোরে টিপটিপ বৃষ্টির মতো কুয়াশা জানান দেয় শীতের আগাম বার্তা। অগ্রহায়নে গুটি গুটি পায়ে এসে গেছে শীত।
ঠাকুরগাঁওসহ আশপাশের জেলায় কুয়াশায় লাল সূর্য ওঠার দৃশ্য আর শীত-গরমের মিষ্টি হাওয়া মন ভুলিয়ে দিচ্ছে বিরাজমান আবহাওয়া। ভোরে টিনের চালের শিশির পড়ার শব্দ, কুয়াশায় ঢাকা ধানখেত, ঘাড়ে লাঙ্গল-জোয়াল আর হাতে জোড়া গরু, ঘাসের ডগায় মুক্তা দানার মতো শিশির বিন্দু, পাখির ডানায় সোনা রোদের ঝলকানি আর শিউলি ভেজা ফুল কুড়াতে শিশুদের জটলা দেখে বোঝা কঠিন নয় যে ঋতুর রানী হেমন্ত এসেছে। নতুন ধানের পিঠা-পুলিতে রসনাবিলাসি কৃষকের মন।
শহরের শান্তিনগর মহল্লার বাসিন্দা তন্ময় ও বন্ধু ইমন চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকেন। বাড়িতে বেড়াতে এসে সকালে বের হয়েছেন কুয়াশাচ্ছন্ন লাল সূর্য দেখার জন্য। তারা জানান, হেমন্তকাল তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি উপভোগ্য সময়। এ সময় দিনে হাল্কা-পাতলা গরম অনুভব হলেও রাতে থাকছে না শীত না গরম।
সাহিত্যিক রাজা সহিদুল আসলাম বলেন, হিমালয়ের নিকটবর্তী হওয়ায় ঠাকুরগাঁওয়ে শীত নেমে আসে আগে ভাগেই। সারাদিনের ভ্যাপসা গরমের পর ভোরে প্রকৃতিতে শুরু হয় শীতের হিমেল পরশের গা শির শিরে বাতাস। অপরূপ হেমন্তের সকাল মানুষের মনে জাগিয়েছে ফুরফুরে আমেজ। শিশির সিক্ত মাটিতে ঝরা শিউলি ফুল আর ঘাসের ডগার শিশির বিন্দু ঝিকমিকিয়ে উঠছে। দেখে মুগদ্ধতায় ভরে ওঠে মন। হাল্কা কুয়াশায় ছেয়ে থাকছে রাস্তাঘাট। মানুষে মানুষে ঐকতান সৃষ্টিতে নবান্ন আসে হেমন্তে। নানান রঙের ফুলে হেমন্ত সেজেছে অপরূপ সৌন্দর্যে।
শিক্ষাবিদ জালাল উদ-দীন বলেন, নতুন ধানের চালে পিঠা-পুলি যেন আলাদা সুখের আস্তরণ। টিনের চালে শিশিরের শব্দ আর ধান কাটার সৌন্দর্য নিয়ে আসে হেমন্ত। এই কারণেই অন্য সব ঋতুর চেয়ে আলাদা হেমন্ত। তাই একে ভিন্নভাবে উদযাপনও জরুরি।
রসের সন্ধানে গাছিরা ॥ খেজুর পাতার ফাঁকে সূর্যের উঁকি চোখ ধাঁধিয়ে দেয় রস সংগ্রহকারী গাছিদের। তবুও, আপন মনে গাছ পরিচর্যায় করে যাচ্ছেন তারা। চারদিকে শীতের আগমনী বার্তা। আর কয়েকদিন পরেই শুরু হবে রস আহরণ। তাই এখন ব্যস্ততাও বেড়েছে গাছিদের।
ঠাকুরগাঁও সদরের নারগুন গ্রামে স্থানীয় সুগার মিল খামারের জমিতে রয়েছে প্রায় আটশ’ খেজুর গাছ। শীতের শুরুতে রস সংগ্রহের জন্য গাছ প্রস্তুত করছেন গাছিরা। দুই সপ্তাহ পর এসব গাছে বাঁধা হবে রসের হাঁড়ি। এ থেকে প্রতিদিন রস পাওয়া যাবে প্রায় এক হাজার লিটার। পরে সেগুলো বিশেষ কায়দায় জাল দিয়ে তৈরি করা হবে সুস্বাদু গুড় ও পাটালি।
গাছিদের কেউ বংশপরম্পরায় আবার কেউবা নয়াশ্রমিক। তারা জানান, শীত আসতে দেরি নেই। রস আহরণের জন্য গাছ পরিচর্যায় তাদের ব্যস্ততা বেড়েছে।
নারগুন গ্রামের বাসিন্দা মনিরুজ্জামান মনির খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য একটি বাগান বর্গা নিয়েছেন। তিনি বলেন, কাকডাকা ভোর থেকে গাছ প্রস্তুত করার কাজ শুরু হয়। আর কয়েকদিন পরে গাছে মাটির হাঁড়ি বাঁধা হবে। বাদুর যাতে রস নষ্ট করতে না পারে সেজন্য গাছে জাল দেওয়া হবে। প্রাকৃতিকভাবে নির্ভেজাল গুড় তৈরি হওয়ায় এখানকার রস ও গুড়ের চাহিদা অনেক বেশি।
সদরের সালান্দর এলাকার কৃষক সেলিম শিকদার বলেন, প্রতিদিন ১০-১২টি খেজুর গাছ চাছা-ছোলা ও নলি বসানোর কাজ করি। এসব গাছ রাস্তার পাশে, পুকুর পাড়ে বেড়ে ওঠা। শীতে আহরণ করা রস বিক্রি করে প্রতিদিন হাজার খানিক টাকা আয় হয়।
শীতের তীব্রতা রাড়লে রসের চাহিদা বাড়ে এবং রসও ভালো থাকে বলে জানান গাছি হাবিবুল। তিনি বলেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে খেজুরের রস ও গুড় বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি। বংশপরম্পরায় এই পেশাই এখন আমার জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম। সিঙ্গিয়া গ্রামের রইছ উদ্দিন বলেন, শীতের শুরুতে বাজারে খেজুরের কাঁচা রসের ব্যাপক চাহিদা থাকে এবং দামও ভালো থাকে। তিন-চার মাস পরিশ্রম করলে ভালো টাকা আয় করা যায়।
নারগুণ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক পয়গাম আলী বলেন, ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি খেজুরের রস ও গুড়ের ব্যবসাকে লাভজনক করতে সরকারকে নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খেজুরের বাগান করা গেলে সেটি হয়ে উঠবে লাভজনক ও সম্ভাবনাময় খাত।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে গ্রামীণ সড়কগুলোর দুই পাশে গাছ লাগাতে স্থানীয়দের উদ্বুদ্ধ করছে কৃষি বিভাগ। এ ছাড়া নিরাপদ রস, গুড় উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।