ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

ঝুঁকির মুখে কিশোরী ও নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য

স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম নাগালের বাইরে

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২১:৪০, ২২ নভেম্বর ২০২৪

স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম নাগালের বাইরে

.

রাজধানীর মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচে দুই মেয়েকে নিয়ে কাপড় দিয়ে ঘর বানিয়ে বাস করছেন সালমা আক্তার। বিয়ের তিন বছরের মাথায় দুই মেয়ে জন্ম হওয়ার পর স্বামী ছেড়ে চলে যায় তাকে। বাসা-বাড়িতে কাজ করে কিছুদিন দুই মেয়েকে নিয়ে মধুবাগ বস্তিতে থাকলেও অপুষ্টি আর কম বয়সে বিয়ের খেসারত হিসেবে শরীরে বেঁধেছে নানান রোগ। এখন আর বাসা-বাড়ির ভারি কাজ করতে পারেন না। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। বস্তির এক রুমের ভাড়াও যোগাড় করতে পারেননি টানা তিন মাস। পরে বেছে নেন ভিক্ষাবৃত্তি। বসবাসের জন্য ফ্লাইওভারের নিচে বানালেন কুড়ানো কাপড় আর কাঠের টুকরো দিয়ে একটা ঘর। সারাদিন মগবাজার, মালিবাগ এলাকায় ভিক্ষা করেন। সন্ধ্যার পর এসে দুই মেয়েকে নিয়ে ঘুমান এই কাপড়ের টুকরোর ঘরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় হচ্ছে মেয়ে দুটোও। এখন আর একসঙ্গে ভিক্ষা না করে তিনজন তিন দিকে যান। বড় মেয়ের কয়দিন আগেই প্রথম ঋতু¯্রাব হয়েছে। এ সময় কি করতে হবে না জেনে রাস্তা থেকে কুড়ানো কাপড় ব্যবহার করেই কাটিয়েছে সাত দিন। ছোট মেয়েটাও দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দুই মেয়ের জন্য কিছুই করতে না পারার আক্ষেপ তার চোখেমুখে। হতাশাভরা দৃষ্টি নিয়ে বলেন, নিজের তো বিয়া হইছে সেই ১৩ বছর বয়সে। মাইয়াগো জন্ম হওনের লগে লগেই জামাই আরেকজনরে বিয়া কইরা চইলা গেছে। দুই মেয়ের লইয়া আমি যেন গাঙে ভাইসা রইছি। ভিক্ষা কইরা যা পাই তা দিয়া তিনজনের পেটই চলে না আর অন্যকিছু। অনাদর আর অবহেলায় নিজে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হইছি, এখন মাইয়ারা মাসিকের সময় রাস্তার কুড়ানো কাপড় ব্যবহার কইরা না আবার কোনো অসুখ বাধায় হেই আতঙ্কে থাকি। কিন্তু এত টাকা খরচ কইরা প্যাড কেনা কি আমাগো পক্ষে সম্ভব! কন আপনি!
কুড়ানো কাপড় বা বাবার পুরনো লুঙ্গি বা মায়ের পুরনো শাড়ির টুকরা দিয়ে মাসিকের সাত দিন কাটায় রাজধানীর পান্থপথ, বাংলামোটর (সোনারগাঁও রোড) এলাকার পথকন্যারাও। ফুটপাতে চায়ের দোকানে চা বানাতে বানাতে আক্ষেপের সুরে সদ্য কৈশোর পার হওয়া শিউলি আক্তার (ছদ্মনাম) বলেন, গরিবের আবার মাসিক! আমরা ৪ বইন, ১ ভাই। বাপে আমাগোরে এইখানে রাইখা কই চইলা গেছে। এখন আমি চায়ের দোকান করি। বাকি বইনেরা মাদ্রাসায় যায়। ভাইটা কিচ্ছু করে না। আম্মা বাসাবাড়িতে টুকটাক যে কাম করে তা দিয়া এতবড় সংসার চলে। বাজারে জিনিসপত্রের যেই দাম। হের মইধ্যে যদি মাসে মাসে খালি প্যাডই কিনা লাগে ৫ প্যাকেট কইরা তাইলে খামু কি? মাসিকের সময় নিজের পুরান জামা পরিষ্কার কইরা ব্যবহার করি। মাসিকের সময় পুরাতন-নোংরা কাপড় ব্যবহারের কারণে ইউরিন ইনফেকশনে আক্রান্ত হচ্ছে এসব পথকন্যাদের অনেকেই। এদেরই একজন এফডিসি এলাকায় কাপড়ের ছাউনি দিয়ে বানানো এক ঘরে বসবাস শাবানা ও তার মায়ের। কাওরানবাজার এলাকায় ভিক্ষা করে দিন যায় তাদের।

গত কয়েকদিন যাবত তলপেটের তীব্র ব্যথার জন্য ভিক্ষা করতে যেতে পারছে না শাবানা। ফলে একা মায়ের রোজগারের টাকার উপর নির্ভর করেই পেট চলছে তাদের। আক্ষেপ করে শাবানার মা মুক্তা বেগম বলেন, বাপে শখ কইরা নাম রাখছিল মুক্তা। কিন্তু জীবনডা কয়লার চাইতেও কালা। সারাজীবন কপালে কষ্টই রইল। বিয়ার পরই স্বামী ছাইড়া গেছে। একমাত্র মাইয়া তারও আজ শরীরে এই রোগ, কাল ওই রোগ। কয়দিন থেইক্কা পেটের ব্যথায় কাতরাইতাছে। ফার্মেসি থেইক্কা ওষুধ আইন্না খাওয়াইছি। কিন্তু এহন যে অবস্থা। হাসপাতালে নেওন ছাড়া গতি নাই। সে এবং তার মেয়ে মাসিকের সময় কি ব্যবহার করেন জানতে চাইলে কিছুটা ক্ষেপেই বলেন, গরিবের আবার মাসিককাল কি? হাতের কাছে যা পাই তাই দিয়া লজ্জা ঢাকি। তায় আবার মাসিক! সালমা, শিউলি বা শাবানা মাসিককালে কোনো ধরনের প্যাড বা পরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করতে পারে না রাজধানীর অধিকাংশ পথকন্যারা। দিন আনে দিনে খাওয়া এসব কন্যাশিশুদের অনেকেই প্যাড কি জিনিস তাও চিনে না। মাসিকের সময় কোনোমতে লজ্জা নিবারণে ব্যস্ত থাকা রাজধানীর রমনা পার্কে ফুল বিক্রি করে সংসার চালানো ১৫ বছরের কিশোরী সীমা জানায়, ১২ বছর বয়সেই তার পিরিয়ড হয়। তখন পিরিয়ড কি-না জানলেও পরে পার্কে ফুল বিক্রি করা অন্য মেয়েদের কছে জানতে পারে। তারা তাকে পিরিয়ডের সময় কাপড় কীভাবে ব্যবহার করতে হবে শিখিয়ে দিলেও দিনের বেশিরভাগ সময় পার্কে কাটানোর কারণে ব্যবহৃত কাপড় ঠিকমতো পরিষ্কার করার সময় পায় না। কয়দিন পেটের ব্যথায় বিছানায় পড়ে থেকে আবার ফুল বিক্রি করতে পার্কে এসেছে জানিয়ে সীমা বলে, আমার জন্মের সময়ই মা মারা গেছে। বাপে আরেকটা বিয়া কইরা কই যে থাকে জানি না। আমি ছোটবেলায় রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করছি। এখন ফুল বিক্রি করি। যে টেকা পাই তা মহাজনরে দিয়া কিছুই থাকে না। খামু কি আর পরমু কি? তায় আবার প্যাড! এত দাম দিয়া কিননের কি সাধ্য আছে আমাগো?
নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের জরুরি এই পণ্যে সরকারি বা বেসরকারি কোনো পক্ষ থেকেই মিলে না কোনো প্রণোদনা। ফলে খরচ তুলতে একটু বাড়তি দামেই বিক্রি করতে হয় জানিয়ে ব্যবসায়ীদের দাবি, এর কাঁচামালের দাম এত বেশি যে কোনোভাবেই কমদামে বিক্রি করা যায় না। এক্ষেত্রে সরকার থেকে কোনো ভর্তুকিও দেয় না। ফলে বাড়তি দামে বিক্রি না করে উপায় নেই বলে দাবি তাদের।
স্যানিটারি প্যাডের ঊর্ধ্বমূল্যই মূলত স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার না করার অন্যতম কারণ বলে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। এই অভিযোগ রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব এলাকার নিম্ন-মধ্যবিত্ত, থেকে মধ্যবিত্তদেরও। এক পরিবারে একাধিক নারী সদস্য থাকলে সেই চিত্র আরও ভয়াবহ। প্রজনন স্বাস্থ্যে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করার অন্যতম প্রধান উপাদান হলেও উচ্চমূল্যের কারণে অনেক অভিভাবককেই তাদের মেয়ে সন্তানদের জন্য এটি কিনতে বেগ পেতে হয়। 

×