ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বারোভূঁইয়ার বীরত্বের গল্পকথা

প্রকাশিত: ১৮:০৭, ২২ নভেম্বর ২০২৪; আপডেট: ১৮:২১, ২২ নভেম্বর ২০২৪

বারোভূঁইয়ার বীরত্বের গল্পকথা

সোনারগাঁয়ে অবস্থিত বারোভূঁইয়াদের বড় সর্দার বাড়ি। এখান থেকেই বারোভূঁইয়ারা মোগল সম্রাটদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন ছবি : প্রীতম মাহমুদ

বারোভূঁইয়া বাংলার স্থানীয় প্রধান ও জমিদার, যাঁরা আকবর ও জাহাঙ্গীর এর রাজত্বকালে মুঘলবিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। ভূঁইয়া শব্দের অর্থ হলো ভৌমিক বা ভূস্বামী- যিনি প্রচুর জমির অধিকারী। তবে কারা ছিলেন এ বারোজন ভূঁইয়া তা বহুদিন পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়নি। প্রকৃতপক্ষে বাংলায় আফগান শাসনামল ও মুঘল শক্তির উত্থানের মধ্যবর্তী সময়ে এদেশের বিভিন্ন এলাকা বহু সামরিক প্রধান, ভূঁইয়া এবং জমিদারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তারা কখনো যৌথভাবে এবং বেশিরভাগ সময় পৃথকভাবে মুঘল আগ্রাসন প্রতিহত করেছিলেন এবং স্বাধীন বা অর্ধ-স্বাধীন শাসকরূপে তাঁদের নিজ নিজ এলাকা শাসন করেছিলেন। সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না, কিংবা থাকলেও সেটা ছিল নামমাত্র। এ অবস্থায় বহু ভূঁইয়া বিদ্রোহ করেছিলেন। সমগ্র বাংলাকে বিবেচনায় নিলে ভূঁইয়াদের সংখ্যা বারোর চেয়ে অনেক বেশিও ছিল।
অনেকেই মনে করেন যে, বারোভূঁইয়া শব্দটি নির্ভুলভাবে বারোজন ভূঁইয়া বা প্রধানকে বোঝায় না; বহু সংখ্যক বুঝাতে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। হিন্দুদের কাছে বারো সংখ্যাটি ছিল পবিত্র। কোন কোন ক্ষেত্রে বারো সংখ্যাটি ব্যবহৃত হয়েছিল তা খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে পণ্ডিতগণ ধর্মশাস্ত্রের কাহিনীগুলো পরীক্ষা করেন। তারা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য যারা যুদ্ধ করেছিলেন তাদের বোঝাতে বারো ভূঁইয়া শব্দটি ব্যবহার করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের মুক্তিকামী যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল বারোর চেয়ে অনেক বেশি। পরবর্তীকালে অবশ্য এ মতবাদ সংশোধন করে বলা হয় যে, যাঁরা মুঘলদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন শুধু তাঁরাই বারোভূঁইয়া নামে পরিচিত। তাহলেও মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াইকারীদের সংখ্যা ছিল বারোর অধিক। ফলে এ দলও বারো ভূঁইয়াদের শনাক্ত করতে ব্যর্থ হন।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বারো ভূঁইয়ার পরিচয়ের প্রশ্নটি সতর্কতার সঙ্গে নতুনভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং মোটামুটি সন্তোষজনকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। আধুনিক পণ্ডিতগণ লক্ষ্য করেন যে, আফগান শাসনের গোলযোগপূর্ণ সময়ে মুঘল সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের বাংলা বিজয়ের প্রক্রিয়াকালে বারোভূঁইয়াগণ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। ফলে আকবরনামার রচয়িতা আবুল ফজল এবং বাহারিস্তান-ই-গায়েবীর রচয়িতা মির্জা নাথানের মতো মুঘল ঐতিহাসিকদের দ্বারা বারো ভূঁইয়াগণ যথাযথভাবে আলোচিত হয়েছেন। তাঁরা উভয়েই বারোভূঁইয়াদের বোঝাতে সংখ্যাসূচক ইছনা-আশারা (বারো) শব্দটি ব্যবহার করেছেন; এর থেকে বোঝা যায় যে, বারো ভূঁইয়া শব্দটি কোনো নাম নয়, বরং এটি ভূঁইয়াদের সঠিক সংখ্যা নির্দেশ করে। তারা স্পষ্টভাবে এও বলেন যে, বারোজন ভূঁইয়া (বারো ভূঁইয়া) ছিলেন ভাটি এলাকার লোক এবং ভাটিতেই তাঁদের উত্থান ঘটেছিল।
ইউরোপীয় লেখকদের বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের কারণে পূর্বতন পন্ডিতরাও ভাটির শনাক্তীকরণ নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলেন। বারোভূঁইয়ারা সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং জাহাঙ্গীরের সিংহাসনারোহণের কয়েক বছরের মধ্যেই তারা আত্মসমর্পণ করেন। কাজেই মুঘল ইতিহাসের, প্রধানত আকবরনামা, আইন-ই-আকবরী এবং বাহারিস্তান-ই-গায়েবীর সাহায্য নিয়ে (বারো ভূঁইয়াদের) ভাটির শনাক্তীকরণ করা যেতে পারে। বাংলায় ভাটি শব্দটি সাধারণত নিম্নাঞ্চলকে বোঝায় এবং এ বিবেচনায় বাংলার সমগ্র নিম্নাঞ্চলই ভাটি।


সুতরাং আধুনিক পণ্ডিতগণ বাংলার বিভিন্ন নিম্নাঞ্চলকে ভাটিরূপে শনাক্তীকরণের প্রস্তাব করেন। কারও কারও মতে  ভাগীরথী থেকে মেঘনা পর্যন্ত সমগ্র নিম্নাঞ্চলই হচ্ছে ভাটি। আবার কেউ কেউ হিজলি, যশোর, চন্দ্রদ্বীপ, বাকেরগঞ্জ ইত্যাদি অঞ্চলকেও ভাটির অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বারো ভূঁইয়া ও মুঘলদের মধ্যকার রণাঙ্গনের কথা মনে রাখলে এবং আকবরনামা ও বাহারিস্তান-ই-গায়েবীতে প্রদত্ত যুদ্ধবিগ্রহের বিস্তারিত বিবরণের ভিত্তিতে বারো ভূঁইয়াগণ যে অঞ্চলে সমৃদ্ধি লাভ করেছিলেন এবং শক্তিশালী হয়েছিলেন সেই ভাটির সীমানা নির্ধারণ করা যায়। এ ভাটি অঞ্চল পশ্চিমে ইছামতী নদী, দক্ষিণে গঙ্গানদী, পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য এবং উত্তরে আলপসিংহ পরগনার (বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা) উত্তর-পূর্ব দিক থেকে বানিয়াচং (বৃহত্তর সিলেট) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সুতরাং তিনটি বড় নদী গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা ও তাদের অসংখ্য শাখানদী বিধৌত ও বেষ্টিত ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা এবং সিলেটের নিম্নাঞ্চল নিয়ে আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলে ভাটি অঞ্চল গঠিত ছিল। বারো ভূঁইয়াগণ এ এলাকায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন এবং জাহাঙ্গীরের আমলে ইসলাম খান চিশতি কর্তৃক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হওয়া পর্যন্ত তাঁরা মুঘলদের প্রতিহত করেছিলেন।
মুঘল ঐতিহাসিক আবুল ফজল ও মির্জা নাথান উভয়েই ভূঁইয়াদের সংখ্যা বারো বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এটি মনে রাখতে হবে যে, মধ্যবর্তীকালে তাঁদের কারও কারও মৃত্যু হওয়ায় আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলের বারো ভূঁইয়াগণ সকল ক্ষেত্রে একই ছিলেন না। উদাহরণস্বরূপ আকবরের বিরুদ্ধে লড়াইরত ঈসা খান তাঁর রাজত্বকালেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং তাঁর পুত্র মুসা খান তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে জাহাঙ্গীরের আমলে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ইতোমধ্যে কিছু পরগনার মালিকানাও বদল হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, আকবরের রাজত্বকালে চাঁদ রায় ও কেদার রায় ছিলেন বিক্রমপুর ও শ্রীপুরের জমিদার, কিন্তু জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে সম্ভবত এ পরিবার বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এবং এ কারণে এ পরগনাগুলো মুসা খানের দখলে দেখতে পাওয়া যায়। বারো ভূঁইয়া নামে পরিচিত এই সকল জমিদাররা হলেন, (১) ইশা খাঁ, (২) মুসা খাঁ (৩) মাসুম খাঁ কাবুলী (৪) বাহাদুর গাজী, (৫) ফজল গাজী, (৬) কেদার রায় ও চাঁদ রায় (৭) সলিম খাঁ, (৮) খাজা উসমান খাঁ লোহানী, (৯) মুকুন্দরাম রায়, (১০) বায়েজিদ কররানী, (১১) প্রতাপাদিত্য, (১২) সুলতান গাজী।

ইতিহাস থেকে জানা যায়
বাংলায় তখন আফগান সুলতানরা বহু বছর ধরে অনেকটা স্বাধীনভাবে রাজত্ব করে আসছিলেন। বহু বছর ধরে এই অঞ্চলে থাকার কারণে এই শাসকরা অনেকটা এদেশের বাসিন্দা হয়ে উঠছিলেন। সেই সময় দিল্লির মসনদে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। বেশ কিছু বছর আগে অর্থাৎ ১৫২৬ সালে প্রথম পানিপথের যুদ্ধে আফগান শাসক ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে দিল্লির ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল মুঘলরা। বাবরের ছেলে হুমায়ুনের মৃত্যুর পর অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় ক্ষমতায় আসেন মুঘল সম্রাট আকবর। কিন্তু তার সময়কালকেই বলা হয় মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সোনালি সময়।
পুরোপুরি রাজ্যভার গ্রহণ করার পর আকবর নজর দেন বাংলার দিকে। এজন্য অবশ্য বড় কৃতিত্ব দেওয়া হয় আকবরের অর্থমন্ত্রী টোডরমলকে। বলা হয়, তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন যে, বাংলা অঞ্চল ফসলি আর উর্বর হওয়ায় এই এলাকা থেকে বিপুল রাজস্ব আহরণ করা সম্ভব।
বাদশাহ আকবর তাকে ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নবাব করে পাঠান। দায়িত্ব নেওয়ার পরেই তিনি চেষ্টা শুরু করেন, কীভাবে বঙ্গদেশ থেকে আয় বৃদ্ধি করা যায়। সেজন্য সবার আগে পুরো বঙ্গ অঞ্চলে মুঘলদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দরকার ছিল। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টায় সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাংলার বারো ভূঁইয়ারা।

বারভূঁইয়া বা বারোভূঁইয়া কারা
‘বাংলার ইতিহাস’ গ্রন্থে সুনীতি ভূষণ কানুনগো লিখেছেন, ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘল বাহিনীর হাতে দাউদ খান কররানীর পরাজয়ের ফলে বাঙ্গালায় দীর্ঘ আড়াইশত বছরের স্বাধীন সুলতানতের পতন ঘটে। রাজধানীতে কররানী শাসনের পতনে ঘটিলেও বাঙালা রাজ্যের আঞ্চলিক শাসনকর্তারা এবং প্রতিপত্তিশালী ভূস্বামীরা কেবল স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াই ক্ষান্ত হইলেন না, তাঁহারা এককভাবেই হোক আর সম্মিলিতভাবেই হোক মুঘল সম্প্রসারণ প্রতিরোধ করিতে তৎপর হইয়া উঠেন। এই প্রতিরোধকারী নেতারা সমসাময়িককালের দেশী-বিদেশী ইতিহাস গ্রন্থে বারভূঁইয়া নামে পরিচিত।’ সুলতান দাউদ খান কররানী পরাজিত হওয়ার পর বাংলা অঞ্চল একক কোনো শাসকের অধীনে ছিল না। সেই সময় ছোট ছোট অংশে ভাগ করে বাংলার বিভিন্ন এলাকা শাসন করতেন একেকজন ছোট ছোট নৃপতি বা রাজা বা জমিদাররা। তখনকার আঞ্চলিক শাসনকর্তা নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করে কাজ করতে শুরু করলেন। অনেকে মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধও গড়ে তোলেন। ইতিহাসবিদদের মতে, সেই সময় বাংলা এলাকাজুড়ে এরকম শাসক ছিলেন শতাধিক। কিন্তু তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিল প্রভাবশালী। বিশেষ করে মুঘল শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোয় তারা বিশেষ নজর করেছিলেন। পরবর্তীতে আকবরনামা এবং মির্জা নাথানের বাহরিস্তান-ই-গায়েবীতে এদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এরাই পরিচিতি পেয়েছিলেন বারোভুঁইয়া নামে। তখনকার আঞ্চলিক শাসনকর্তা নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করে কাজ করতে শুরু করলেন। অনেকে মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধও গড়ে তোলেন।

বারোভূঁইয়া নাকি বড়ভূঁইয়া
ভূঁইয়া শব্দের অর্থ হলো ভৌমিক বা ভূস্বামী- যিনি প্রচুর জমির অধিকারী। মধ্যযুগে এই শাসকরা তাদের এলাকার সব জমির মালিক ছিলেন, প্রজারা তাদের খাজনা দিয়ে এসব জমিতে চাষবাস করতেন। পরবর্তীকালের জমিদারী ব্যবস্থার মতো। এরকম শতাধিক ভূঁইয়া থাকার পরেও কেন বারো ভূঁইয়াকে নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়, এ নিয়ে ইতিহাসবিদরা কখনো একমত হতে পারেননি।
অনেকের মতে, আকবরনামা বা বাহারিস্তান-ই-গায়েবীর মতো গ্রন্থগুলোয় বারোজন ভূঁইয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এদের কেউ কেউ মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, কেউ কেউ মুঘলদের অনুগ্রহ ভাজন ছিলেন। আবার কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, শব্দটা আসলে বড় ভূঁইয়া বা বড় শক্তির ভূঁইয়া থেকে বারো ভূঁইয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। ইতিহাসের সেই সময়ের বিভিন্ন বর্ণনায় বারো ভূঁইয়াদের সম্পর্কে নানারকম বর্ণনা পাওয়া যায়। এদের সংখ্যা নিয়েও বিভিন্ন গ্রন্থে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য এসেছে। তবে মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। এটা পরিষ্কার যে, বাংলায় অনেক ভূঁইয়া ছিলেন। তাদের বড় একটি অংশ মুঘলদের শাসক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তবে প্রভাব আর বীরত্বের জন্য বেশ কয়েকজনের নাম আলাদাভাবে ইতিহাস গ্রন্থে উঠে এসেছে। একসময় মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল সোনারগাঁ।

বাংলার বিভিন্ন এলাকা শাসন করতেন একেকজন ভূঁইয়া
সুনীতিভুষণ কানুনগো লিখেছেন, সেই সময় ময়মনসিংহের পূর্বাংশ, কিশোরগঞ্জ ও সিলেটের একটি অংশ এবং ঢাকার উত্তর দিকে একটি অংশ নিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা ভাটি এলাকা নামে পরিচিত ছিল। সেই ভাটি অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন ঈসা খাঁ, যাকে মসনদ-ই আলা উপাধিতে অভিহিত করেছেন কোনো কোনো ইতিহাসবিদ।’ প্রতাপ প্রতিপত্তির দিক থেকে তিনি বারোভূঁইয়াদের মধ্যে কেবল সর্বশ্রেষ্ঠই ছিলেন না, তিনি তাহাদের দ্বারা অবিসম্বাদী নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। ‘বারোভূঁইয়া বা ষোড়শ শতাব্দীর ইতিহাস’ বইতে আনন্দনাথ রায় লিখেছেন, ঈশা খাঁর পরিবার অযোধ্যা থেকে বাণিজ্য করার জন্য বঙ্গদেশে এসে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেন। পরে সোনারগাঁয়ের কাছে জমি কিনে বসবাস করতে শুরু করেন। আফগানদের রাজকর না দিয়ে বিদ্রোহ করায় তার পিতাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় ঈশা খাঁর পিতৃব্য কুতুব খাঁ রাজ আনুকূল্য অর্জন করেছিলেন। বাহ্যিক আচরণের মাধ্যমে তিনি বাদশাহের আনুগত্য স্বীকার করলেও বরাবর স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন বলে ইতিহাসবিদরা লিখেছেন। মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঈশা খাঁ বহুবার সন্ধি করেছেন, আবার বিদ্রোহীও হয়েছেন। আনন্দনাথ রায় লিখছেন, ‘প্রবাদ রয়েছে, ঈশা খাঁকে দমন করার জন্য মুঘল সেনাপতি মানসিংহ সোনারগাঁয়ের খিজিরপুর দুর্গ অবরোধ করেন। সেই যুদ্ধে মানসিংহের জামাতা নিহত হলে তিনি ঈশা খাঁকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহবান করেন। উভয়ের মধ্যে লড়াইয়ের একপর্যায়ে মানসিংহের তলোয়ার ভেঙে যায়। তখন মানসিংহকে হত্যা না করে বরং স্বহস্তের তলোয়ার সমর্পণ করেন ঈশা খাঁ। তখন ঈশা খাঁ চিরদিন মুঘলদের আনুগত্য স্বীকার করবেন বলে ঘোষণা করেন।’ তখন তাকে সোনারগাঁয়ের সর্বময় শাসন কর্তৃত্ব প্রদান করেন মানসিংহ। ঈশা খাঁ জীবিত থাকা পর্যন্ত আর মুঘল বাদশাহের বিরুদ্ধাচরণ করেননি। তবে এটি লোকগাঁথা হিসেবেই প্রচলিত, এই ঘটনার ঐতিহাসিক কোন প্রমাণ নেই বলে বলেন ইতিহাসবিদেরা। যদিও ঈশা খাঁর উত্তরাধিকারী মুসা খাঁ মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। পরবর্তীকালে বারোভূঁইয়াদের বিদ্রোহের মূল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুসা খাঁ। বাংলার ইতিহাস গ্রন্থে সুনীতি ভূষণ কানুনগো লিখেছেন, ঘোড়াঘাট অঞ্চলে শাসক ছিলেন মাসুম খান কাবুলি। চাটমোহরে তার এবং ছেলে মির্জা মুমিনের শাসন কেন্দ্র ছিল। মুঘলদের বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন মাসুম খান কাবুলি। কিন্তু মানসিংহের আক্রমণের মুখে প্রথমেই ঘোড়াঘাটের পতন ঘটে। মাসুম কাবুলি পালিয়ে ঈশা খাঁর এলাকায় আশ্রয় নেন। তার সম্পর্কে আনন্দনাথ রায় লিখেছেন, তখন বাঙ্গালায় মাসুম কাবুলি এবং সোনারগাঁয়ে ঈশা খাঁ পাঠান দলের প্রকৃত নেতা ছিলেন। শাহজাদপুরের ভূস্বামী ছিলেন রাজা রায়। তিনি সুবাদার ইসলাম খানের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। ঢাকার উত্তরাঞ্চলের উঁচুভূমি নিয়ে ভাওয়াল অঞ্চল পরিচিত ছিলে। সেখানকার জমিদার ছিলেন ফজল গাজী। তার মৃত্যুর পর শাসক ছিলেন বাহাদুর গাজী এবং তার ভাইয়ের ছেলে আনোয়ার গাজী। তারাও মানসিংহের কাছে পরাস্ত হয়ে মুঘলদের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছিল। ঢাকার বিক্রমপুরের জমিদার ছিলেন কেদার রায়। তবে মানসিংহের অভিযানে পরাজিত হলে তখনকার শ্রীপুর বা বর্তমানের বিক্রমপুর মুঘলদের হাতে আসে। নিয়মিত কর দেওয়ার শর্তে তাকে রাজ ক্ষমতায় থাকতে দেন মানসিংহ। তিনি কেদার রায়ের একজন কন্যাকে বিয়েও করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে আবার বিদ্রোহী হয়েছিলেন কেদার রায়। পরে মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে তার মৃত্যু হয়। আনন্দনাথ রায় লিখেছেন, ‘বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে যদি কাহাকেও সর্বপ্রথম আসন প্রদান করতে হয়, তাহা রাজা কেদার রায়ের প্রাপ্য। কারণ ঈশা খাঁ মসনদ-ই-আলী ছিলেন বা সর্বপ্রধান ছিলেন বটে, কিন্তু তিনিও মুঘল পতাকামূলে মস্তক অবনত করতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে অধিকাংশই সেই পথ বেছে নেন। কিন্তু অবনত হননি কেদার রায়, প্রতাপাদিত্য ও মুকুন্দ রায়।’ মুসা খার নেতৃত্বে বারো ভূঁইয়াদের সম্মিলিত বাহিনী মুঘলদের মুখোমুখি হয় বিক্রমপুরে ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে। সেই যুদ্ধেই বন্দি হওয়ার পর কেদার রায়ের মৃত্যু হয়। সেই সময় ময়মনসিংহ, শেরপুর এলাকা নিয়ে চাঁদ পরতাব জমিদারী ছিল, যার ভূঁইয়া ছিলেন বিনোদ রায়। বর্তমান ফরিদপুর সে সময় পরিচিত ছিল ফতেয়াবাদ নামে। এর শাসনকর্তা ছিলেন বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম নেতা মজলিশ কুতুব। তার নিজস্ব একটি নৌবাহিনী ছিল। যশোর এলাকার ভূঁইয়া ছিলেন শ্রীহরি বিক্রমাদিত্য। তার ছেলে প্রতাপাদিত্য এবং পৌত্র উদয়াদিত্য- উভয়েই মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন। শ্রীহট্ট বা বর্তমানের সিলেট এলাকার জমিদার ছিলেন বায়েজিদ করবারী। তিনি দীর্ঘদিন মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন।
হিজলী, মেদিনীপুর, জলেশ্বর, বালেশ্বর ইত্যাদি এলাকা নিয়ে ছিল সলিম খানের জমিদারী। এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে মুঘলদের দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করতে হয়। সলিম খানের মৃত্যুর পর ভাইয়ের ছেলে বাহাদুর খান ক্ষমতায় আসেন। তিনিও একাধিকবার মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। মেঘনা নদীর পশ্চিম তীরের এলাকার নাম ছিল বাকলা চন্দ্রদ্বীপ, যা বর্তমানে বরিশাল নামে পরিচিত। সেই অঞ্চলের শাসক ছিলেন পরমানন্দ রায়। নদীবেষ্টিত এলাকা হওয়ায় মুঘলদের ওই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।

মুঘলদের হাতে যেভাবে
বারোভূঁইয়াদের পতন
বহু বছর ধরে মুঘল সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে এলেও অবশেষে সেই বিদ্রোহে যবনিকা টেনে দেন মুঘল সেনাপতি ইসলাম খান। রাজা মানসিংহের শরীর ভেঙ্গে পড়তে শুরু করলে তিনি অবসর নেন। ইতোমধ্যে দিল্লির শাসন ক্ষমতায় এসেছ পরিবর্তন। আকবরের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় এসেছেন সম্রাট জাহাঙ্গীর। পরবর্তীতে বেশ কয়েকজনকে সুবাদার হিসাবে মুঘল সম্রাটেরা পাঠালেও তারা ভূঁইয়াদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। যদিও মুঘল বাহিনীরও পুরোপুরি সুবিধা করতে পারেনি। এরপর ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুবাদার হয়ে আসেন ইসলাম খান চিশতী। তার মূল লক্ষ্য ছিল বারভূঁইয়াদের পরাস্ত করা। ‘বাংলার ইতিহাস’ বইতে সুনীতিভূষণ কানুনগো লিখছেন, প্রথমে ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিণে আলাপসিং পরগণা দখল করে ওসমান খানকে বিতাড়িত করেন। এরপর দক্ষিণ বাংলার শাসক সলিম খানকে পরাস্ত করেন। বর্তমান নড়াইলের কাছে ছিল ভূষণার অধিপতি সত্যজিৎ এর রাজত্ব। একটি মুঘল বাহিনী পাঠিয়ে তাকে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করেন। সে সময় বিশাল মুঘল বাহিনী নিয়ে ঘোড়াঘাটে অবস্থান নিয়ে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য, কামতা (কুচবিহার) রাজার রক্ষীনারায়ণ এবং সুসাঙ্গের রাজা রঘুনাথকে পরাস্ত করেন। এরপর বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে করতোয়া নদী বরাবর দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেন ইসলাম খান। শাহজাদপুরের ভূঁইয়া রাজা রায় তাকে বাধা দিলেও পরাজিত হন। সুনীতিভূষণ কানুনগো লিখেছেন, ‘ইসলাম খানের আগমনের খবর পেয়ে ঈশা খাঁর পুত্র মুসা খাঁর নেতৃত্বে বাংলার ভূঁইয়ারা একত্রিত হন। তাদের মধ্যে ছিলেন ভাওয়ালের বাহাদুর গাজী ও তার পুত্র সোনা গাজী, বানিয়াচঙ্গের আনোয়ার গাজী, মির্জা মুমিন, খলসীর মধু রায়, চাঁদ প্রতাপের বিনোদ রায়, মাতঙ্গের পাহলোয়ান। ইছামতী নদীর তীরে যাত্রাপুর নামক স্থানে তারা অবস্থান নিয়ে দুর্গ তৈরি করেছিলেন। সেটি দখল করে নেয় মুঘল বাহিনী। এরপর ডাকচরা দুর্গও দখল করে। সুবাদার ইসলাম খান ঢাকায় প্রবেশ করে ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণা করেন এবং সম্রাটের নামে তার নতুন নামকরণ করেন - জাহাঙ্গীরনগর। এরপর সেখান থেকে বারোভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে শুরু করেন। মুসা খাঁর নেতৃত্বে ভূঁইয়ারা আবার সমবেত হচ্ছিলেন। তখন এগারসিন্দুর থেকে সোনারগাঁ পর্যন্ত বহু সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছিল ভূঁইয়া বাহিনী। ইসলাম খানও সেজন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এরপর ১৭১১ সালে মুসা খাঁর সামরিক ঘাঁটি কাত্রাভু দুর্গের ওপর হামলা শুরু করে মুঘল বাহিনী। সেটা দখলে নেওয়ার পর একের পর এক সামরিক ঘাঁটি দখল করতে করতে সোনারগাঁ এসে হাজির হয়। তুমুল লড়াইয়ের পর মুঘল বাহিনী সোনারগাঁ দখল করে নেয়। সুনীতিভূষণ কানুনগো লিখেছেন, “সম্ভবত এটাই মুঘলদের বিরুদ্ধে বারোভূঁইয়াদের সর্বশেষ সম্মিলিত সংঘর্ষ। মেঘনা নদীর পশ্চিম তীরবর্তী সমগ্র অঞ্চল মুঘল অধিকারভুক্ত হইল। প্রতিরোধকারী নেতারা অতঃপর মুঘল প্রশাসনের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করিলে তাহাদের সামরিক ও প্রশাসনিক বিভাগে উচ্চপদ দেওয়া হইল।’ কিন্তু তখনো কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা মুঘলদের নিকট নতি স্বীকার করেননি। যেমন রাজা প্রতাপাদিত্য আগে বশ্যতা স্বীকার করলেও, নিজের রাজ্যে ফিরে গিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে শুরু করেন। বরং তিনি সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী শক্তিশালী করতে শুরু করেন, এক পর্যায়ে যুদ্ধে পরাজিত অনেক পাঠান তার বাহিনীতে যোগ দিতে শুরু করে। এই খবর পেয়ে ইসলাম খান মুঘল সেনাবাহিনী যশোরের দিকে পাঠান। তাতে নৌ ও স্থলযুদ্ধে প্রতাপাদিত্যের বাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়। তাকে বন্দি করে দিল্লি পাঠানো হলে পথে তার মৃত্যু হয়। এরপর বাকলা বা বরিশালের দিকে মুঘল বাহিনী পাঠান ইসলাম খান। সেখানকার জমিদার রামচন্দ্র পরাজিত ও বন্দি হন। এর মাধ্যমে পুরো দক্ষিণ বঙ্গ মুঘলদের নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু মুঘল বাহিনী সবচেয়ে বড় প্রতিরোধে মুখে পড়েছিল ভাটি অঞ্চলের ওসমান খানের সামনে। বুকাইনগরে শাসন কেন্দ্র স্থাপন করে তিনি শক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। তার সঙ্গে শ্রীহট্টের আনোয়ার খান, বায়েজিদ কররানীও যোগ দিয়েছিলেন। এরপর ১৭১২ সালে দক্ষিণ শ্রীহট্টে মুঘল বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ওসমান খান। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা অঞ্চলে মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে ভূঁইয়াদের প্রতিরোধ সংগ্রামও শেষ হয়ে যায়।
ফারুক হোসাইন, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ

×