সংগৃহীত ছবি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটি বেশ উচ্চারিত হচ্ছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো শেখ হাসিনার সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ট সরকার’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে। তাদের অভিযোগ, যারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে বা সরকারের পক্ষে কথা বলছে, তাদেরকেও ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
তবে প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটি কেন এত বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে? আসলেই ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটির উৎপত্তি কোথায়? এবং এর ইতিহাস কী? ফ্যাসিস্টদের গুরু কে ছিলেন, এবং তাদের পরিণতি কী হয়েছিল? চলুন জেনে নেওয়া যাক:
‘ফ্যাসিজম’ বা ‘ফ্যাসিবাদ’ কী?
ইতালীয় শব্দ ‘ফ্যাসিমো’ এসেছে 'ফ্যাসিও' থেকে। আর ‘ফ্যাসিও’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ 'ফ্যাসেস' থেকে, যার অর্থ হলো একত্রে বাঁধা লাঠি বা কাঠের বান্ডেল। এই বান্ডেল যখন একত্রে বাঁধা থাকে, তখন সেটি সহজে ভাঙা যায় না। একক কাঠ বা রড সহজেই ভেঙে ফেলা যায়, কিন্তু একত্রিত হলে তা শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
এই প্রতীক থেকেই ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দলের নামকরণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা ঐক্য এবং শক্তির ধারণা প্রকাশ করতে চেয়েছিল। ফ্যাসিবাদ মানে ছিল শক্তিশালী ও একীভূত শাসন, যেখানে একক শাসকের কর্তৃত্বই মূল ছিল এবং বিরোধিতার কোন স্থান ছিল না।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুযায়ী, ‘ফ্যাসিজম’ একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং গণআন্দোলন ছিল, যা ১৯১৯ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে ইউরোপে ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি একটি উগ্র ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন করে এবং এই মতাদর্শে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার কোনো স্থান ছিল না। ফ্যাসিবাদের মূল মন্ত্র ছিল, রাষ্ট্রই সবকিছু, এবং ক্ষমতা একটি কেন্দ্রে আবদ্ধ থাকা উচিত। এর মাধ্যমে ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করা হত এবং একতরফা শাসন প্রতিষ্ঠিত হতো।
ফ্যাসিবাদের জনক কে?
ফ্যাসিবাদের জনক বেনিতো মুসোলিনি, ফ্যাসিজমের প্রতিষ্ঠাতা এবং ইতালির একাধিকার শাসক হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। তিনি ১৯২২ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ইতালির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তাঁর শাসনামলে ফ্যাসিবাদী আদর্শের বিস্তার ঘটান। তার শাসন ব্যবস্থায় আধিকারিকতা, কর্তৃত্ববাদ, এবং একনায়কতন্ত্রের ব্যাপক প্রসার ঘটে। তবে, বিশ্বযুদ্ধের পর, মুসোলিনির শেষ পরিণতি ছিল একেবারে নিকৃষ্ট, যা তার স্বৈরাচারী শাসনের শোকাবহ সমাপ্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
মুসোলিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৩ সালের ২৯ জুলাই, ইতালির পেডার্নোতে। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয় সমাজতন্ত্রে, তবে কিছুদিন পর তিনি ফ্যাসিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯১৯ সালে তিনি 'ফ্যাসিস্ট পার্টি' প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯২২ সালে "মার্চ অন রোম" নামে একটি অভিযান পরিচালনা করে প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন। এরপর, তিনি একটি স্বৈরাচারী সরকার প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ক্ষমতা এককভাবে তার হাতে কেন্দ্রীভূত হয়।
মুসোলিনি ১৯৩৯ সালে নাজি জার্মানি, আন্ডার অ্যাডলফ হিটলার, এর সাথে মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তবে, তার নেতৃত্বের অধীনে ইতালি যুদ্ধের মুখে পরিণত হয়। ১৯৪৩ সালে, জোটবদ্ধ বাহিনীর কাছে ইতালি পরাজিত হলে, মুসোলিনি সরকারের পতন ঘটে এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মুসোলিনির গ্রেপ্তার ও মৃত্যুর পরিণতি
এপ্রিল ২৭, ১৯৪৫-এ, মুসোলিনিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তাকে তার সহযোগী নার্দো ফ্যাব্রিজিওসহ শাসকরা দিকভ্রান্তভাবে অন্তরীণ করে রেখেছিল। পরের দিন, ২৮ এপ্রিল, তাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার মরদেহ পরে মিলান শহরের একটি সড়কে উন্মুক্তভাবে প্রদর্শন করা হয়, যা ছিল ইতালিতে তার শাসনের এক অপমানজনক সমাপ্তি।
মুসোলিনির মৃত্যুর পর, তার মরদেহের প্রদর্শন প্রচলিত ইতিহাসে একটি শক্তিশালী প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। তার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ ও তীব্র প্রতিবাদ ছিল স্পষ্ট। ইতালির জনগণ মনে করেছিল, তার শাসন ছিল জনগণের জন্য এক অভিশাপ, এবং তার মৃত্যুর মাধ্যমে সেই অভিশাপের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
বেনিতো মুসোলিনির শাসন কেবল ইতালির জনগণের জন্যই নয়, সারা পৃথিবীজুড়ে এক অন্ধকার যুগের সূচনা করেছিল। তবে, তার মৃত্যুর মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়লেও, তার কৃতকর্মের প্রভাব আজও ইতিহাসে এক শোকাবহ চিহ্ন হয়ে রয়েছে।
নুসরাত