সেদিনের সুন্দর বিকেলটাকে কালো করে দিয়ে কী বললো নিওন এসব! তনুর একটা অ্যাকসিডেন্টকে বিশ্বাস করতে পারলো না! এ কেমন ভালোবাসা? শোকাচ্ছন্ন সারাটা রাত মামুন আংকেলের মতো নিওনও যেন তার পাশে লাশ হয়ে শুয়ে ছিল। আর ওদের শেষ কথাগুলো রেকর্ডেড অডিওর মতো অবিরাম বেজে চলেছিল কানে।
‘এ তুমি কী বলছো নিওন? তুমি না বলেছিলে... এ কিছু না তনু। আমি তো বিশ্বাস করেছি। আর কী চাই? সেটা কি মিথ্যে বলেছিলে?’ নিওন একটা উড়ন্ত পাখির দিকে চোখ রেখে বলেছিল, আমি তো বিশ্বাসই করেছিলাম। কিন্তু লজিকটা ঠিক স্টাবলিশ করতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত পারলামই না। যখনই মনে হয় তিন তিনটে ছেলের ধারালো হাত তোমাকে খামছে ধরেছে...আর তুমি ভার্জিন হয়ে ফিরে এলে.. হিসেবটা তো এভাবে মেলে না তনু। কী করবো বল?’ এরপর আর কথা বাড়াতে চায়নি তনু। শুধু বলেছিল- ‘ওকে নিওন। আমি সব বুঝেছি। আমার বাবা যেমন পারেনি, তুমিও পারলে না। তোমাকে একটু আলাদা ভেবেছিলাম। ভুল করেছি। আসলে তোমরা পুরুষেরা একই। এনি ওয়ে, আমাদের গল্পটা তাহলে এখানেই শেষ হয়ে যাক। তুমি এবার আসতে পারো। লীভ মী এ্যালোন প্লিজ।’ গলাটা কেঁপে উঠেছিল তনুর শেষ কথাটায়। দুচোখ ভরে বাঁধ ভাঙা কান্না চলে এসেছিল বুক ঠেলে। হাঁটুর ওপর মুখ রেখে গুমড়ে গুমড়ে কেঁদেছিল খুব।
ঠিক এ সময়েই আরেকটি ধাক্কা বুক ঠেলে বেরিয়ে আসে তনুর হাতফোন থেকে। যুগল বজ্রের পতনে প্রায় নির্বাক হয়ে পড়ে সে। ওর কাঁপা ঠোটে শুধু অস্ফুট স্বরে উচ্চারিত হলো : আংকেল!
রাতে ঘুমটা ভালো না হলেও অনেকটা প্রতিদিনের মতোই বিছানা ছেড়েছে আনিসুর রহমান মিলন। অথচ পাশের বাড়ির সদ্য প্রয়াত মানুষটাকে নিয়ে শোকের বিষণ্নতায় ডুবে রয়েছে চারপাশটা। গেল রাত এগারোটার মধ্যে দাফন কাফন সব শেষ হলেও কারোরই তেমন ঘুম হয়নি সারা রাত। স্ত্রী সানজিদা রহমান ঘুমের ঘাটতি কাভার করতে এখনো বেড এ। পাশের ঘরে তনুও ঘুমোচ্ছে সম্ভবত। ফোলা ফোলা চোখ নিয়েই কাল বিকেলে সে মায়ের সঙ্গে ঢাকা থেকে এসেছে। প্রয়াত প্রতিবেশী মামুন খান খুব ভালোবাসতো তনুকে। মৃত আংকেলের মুখের কাছে অনেকটা সময় নিস্তব্ধ হয়ে বসেছিল তনু। তন্ময় হয়ে ভাবতে ভাবতে এক সময় উঠে দাঁড়িয়ে মিলনকে চেপেও ধরেছিল খুব করে। বাবাকে হারানোর ভয়? না, সেটি না। শোকেরই একটা স্বাভাবিক সংক্রমণ বলেই মনে হয়েছে তার। শাম্মির ভাই তারিক ঢাকাতেই বেসরকারি একটা ভার্সিটির মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে। মামুন মাঝেমধ্যে বলতো, ‘আপনার মেয়েটিকে কিন্তু আমি নিয়ে নেব মিলন ভাই। আপত্তি করতে পারবেন না।’ মিলন মুচকি হেসে চুপ থেকেছে। নেব বললেই তো আর নেওয়া হয় না। তনু যে এখন কোনো মেয়ে নয়, অন্য কিছু, মামুন তা বুঝবে কী করে? ভেবে পায় না মিলন-যে মেয়ে স্কুল কলেজ পার করলো কোনো ঝামেলা ছাড়াই, সেই মেয়ে ভার্সিটিতে পরীক্ষার কথা বলে হঠাৎ উধাও হয়ে যায় কী করে? পরের দিন ফিরে আসার পর ঘরে তুলতে চায়নি মিলন। বিধ্বস্ত মুখে বাসার গেটে চুপচাপ বসেছিল। কিন্তু বাঁধ সেধেছিল ওর মা। কান্নাকাটি করে বলেছিল, ‘বদ ছেলেরা জোর করে মাইক্রোতে উঠিয়ে নিয়ে গেলে কী করবে ওইটুকুন মেয়ে? চিৎকার করারও সুযোগ দেয়নি। দূরে দাঁড়িয়ে সবাই শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে, কেউ এগিয়ে আসেনি। তারপরেও জানটা নিয়ে যে ফিরে এসেছে মেয়েটা, সেটাই তো অনেক। এখন ফিরিয়ে দিলে ও কি বাঁচবে মনে করেছো? সুইসাইড করে মরবে। এ আমি হতে দেব না।’ মিলন গল্পটি বিশ্বাস করতে পারেনি। মনে হয়েছিল-স্রেফ বানানো। মেয়েকে সেইফ করার চেষ্টা ছাড়া কিছু না। কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর তনুও মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল বাবার। ধরা গলায় বলেছিল, ‘বিলিভ মী বাবা, কিচ্ছু করার ছিল না আমার। কুকুরেরা খুব চেষ্টা করেছিল আমাকে নষ্ট করতে। সেটা হতে দিইনি আমি বাবা। আমাকে মেরে ফেলতে বলেছিলাম। মারেনি। ছেড়েও দেয়নি। তিনটা কুকুরের সঙ্গে প্রাণপণ ফাইটটা সহজ ছিল না বাবা। কীভাবে যে পালিয়ে এসেছি, তোমাকে তা বোঝাতেও পারবো না। বাট আমি ভার্জিন বাবা। বিশ্বাস কর আমি ভার্জিন। প্লিজ বাবা।’ মিলন অন্য দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের স্বরে বলেছিল, ‘তিন তিনটা ছেলে তোর সাথে পারলো না- এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছিস?’ তনু দমে না গিয়ে চোয়াল দুটো শক্ত করে বলেছিল, ‘হ্যাঁ বলছি। বিশ্বাস না হয় তুমি আমার ভার্জিনিটি টেস্ট করিয়ে দেখতে পারো। ইয়েস, ইট’স মাই চ্যালেঞ্জ। চল ডাক্তারের কাছে।’ না। চ্যালেঞ্জটা নিতে ইচ্ছে করেনি মিলনের। টেস্ট করতে গিয়ে নোংরা ব্যাপারটা জানাজানি হোক-চায়নি সে। মা মেয়ের সঙ্গে একই ছাদের নিচে আর থাকতেও ইচ্ছে করেনি তার। নিজের বদ্ধমূল ধারণাটাকেই আঁকড়ে ধরে ক্ষোভে কষ্টে ঢাকা থেকে বদলি নিয়ে পাবনায় নিজের জন্ম শহরের বাড়িতে চলে এসেছে সে একাই। একটা কাজের মেয়ে রান্নাসহ বাড়ির সব কাজ করে দিয়ে যায়। কোনো সমস্যা হচ্ছে না। স্ত্রী সানজিদা মাঝেমধ্যে মেয়েকে নিয়ে এসে ক’দিন কাটিয়ে ফিরে যায় ঢাকায়। কথাবার্তা হয় না তেমন। মোটামুটি শান্ত একটা সংসার থেকে বেরিয়ে আসার পর একাকীত্বের এই জীবনকে বেশ উপভোগ্যই মনে হচ্ছিল মিলনের। এটা হতে পেরেছিল খুব হাসিখুশি মামুন খানের জন্যেই। ফ্যামিলি প্লানিং ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র অফিসার মামুন তাকে বেশ ভালোই সঙ্গ দিচ্ছিল। বয়সের পার্থক্য, দুজনের চাকরির স্টাটাস, এসব কখনও দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়নি তাদের মধ্যে। ঘরে বাইরের অনেক কথাই শেয়ারিং হতো তাদের। অফিস থেকে ফিরেই মিলনকে নিয়ে নতুন নতুন জায়গায় বেড়াতে যেত মামুন। প্রাণখোলা হাসি আড্ডায় যেন নতুন এক জীবন পেয়েছিল মিলন। সেই মামুন কোনো জানান না দিয়েই হুট করে চলে গেল! কী এমন বয়স? পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি হবে। সুঠাম শরীর। কোনো রোগ টোগের কথা কখনও শোনেনি মিলন। তবে টেনশন ছিল বাড়ির লোন শোধ করা নিয়ে। আর ছিল ছেলেটির বাসায় না ফেরার রহস্যজনক ব্যাপারটি। উত্তরার ভাড়া বাসায় বন্ধুদের নিয়ে নেশা টেশায় জড়িয়ে পড়েছিল কিনা সে ভাবনাটা ভাবাতো খুব মামুনকে। মেয়ে শাম্মি লেখাপড়া শেষ না করে বিয়ে করবে না বলে বেশ কয়েকটি ভালো প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। মেয়ের এই সিদ্ধান্তটি মেনে নিতে পারেনি মামুন। মেয়ের কোন এ্যাফেয়ার নেই সত্যি কিন্তু হতে কতক্ষণ? চেহারাসুরত তো আর খারাপ না। মামুনের এ ধারণার সঙ্গে একমত হতে না পারলেও মিলন এ নিয়ে কিছু বলতো না মূলত তনুর কথাটা ভেবেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মিলন। নিজের দিকে তাকায়। না, তাকে তেমন শোকার্ত মনে হচ্ছে না। অথচ বাড়ির আর সবার চেয়ে তারই বেশি শক্ড হওয়ার কথা। বরং তার মনে হচ্ছে-এভাবে হুট করে যাওয়াই তো ভালো। কারো সেবা টেবার দরকার হবে না। গেলে তেমন কষ্টও হবে না তনু-সানজিদার। ব্যাংকে ডিপোজিটও একেবারে কম নেই। চলে গেলে মা মেয়ের কষ্ট হওয়ার কথা নয়। বিয়ের পর থেকেই মানসিক দূরত্বে চলে যাওয়া স্ত্রীর সঙ্গে দু’চারটে দরকারী কথা ছাড়া তেমন কথা হয় না অনেকদিন থেকেই। সেজন্যে তনুর জন্মের পর ওকে নিয়েই একটা স্বপ্নঘোর তৈরি হয়েছিল মিলনের। বেঁচে থাকার আনন্দ বলতে ছিল ওইটুকুই। সেটিও আর রইলো কই? বাড়ি আসার পর মামুনই ভুলিয়ে দিয়েছিল সব একাকীত্ব, কষ্ট। সেই মামুন হঠাৎ চলে যাওয়ার পর চারপাশের শূন্যতা গিলে খেতে শুরু করেছে মিলনকে। এ থেকে মুক্তি দরকার তার এখন। খুব দরকার।
বাড়ি থেকে হাঁটাপথ দূরেই গোরস্তান। সেখানেই মামুনের কবর। মিলনের এখন একটু যাওয়া দরকার মামুনের কবরের কাছেই। মামুন নিশ্চয়ই তার জন্য অপেক্ষা করছে। হয়তো বলছেও, ‘কী মিলন ভাই, রাতে আমাকে একলা গর্তে রেখে চলে গেলেন, একবার দেখতেও এলেন না!’ বলতেই পারে।
মামুনের মাথার কাছে বসে মিলন। ঝুরঝুরে মাটিগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে। আর বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘চলে গিয়ে ভালোই করলেন মামুন সাহেব। আমারও খুব যেতে ইচ্ছে করে এখন। কিন্তু চাইলেও তো আর যাওয়া যায় না। সময় হতে হয়। আপনি থাকলে তবু নিজেকে বয়ে নিয়ে যেতে পারতাম...এখন কি আর তা পারবো...
‘অবশ্যই পারবে বাবা। আমি আছি তোমার সাথে।’ কাঁধে তনুর হাতের স্পর্শ পেয়ে হকচকিয়ে যায় মিলন। পিছন ফিরে তাকায় তনুর দিকে।
‘তনু তুই! তুই এখানে কেন?’
‘তোমাকে নিতে এসেছি বাবা। আংকেলের মতো তোমাকে হারিয়ে যেতে দেব না। চল বাসায়।’
‘না আমি যাবো না। কোত্থাও যাবো না। তুই যা এখান থেকে।’ মিলনের গলায় ক্ষোভ।
‘না বাবা, আমি যাবো না। তোমাকে নিয়েই তবে যাবো। ঢাকায় আবারো এক বাসায় একসঙ্গে থাকবো আমরা।’
‘না না এ হয় না তনু। আমার কেউ নেই। দরকারও নেই। পড়াশোনার টাকা তো ঠিকমতোই পাচ্ছিস। সমস্যা কী?’
‘টাকাটাই সব নয় বাবা। বাবাকেও লাগে। প্লিজ বাবা, নিজের রক্তকে ঘৃণা কোর না। সত্যি বাবা, আমার তখন কিছুই করার ছিল না। বড্ড অসহায় ছিলাম। কীভাবে যে সেদিন ভার্জিন হয়ে জানটাকে নিয়ে ফিরে এসেছিলাম...তুমি বাবা হয়ে শুনতেও চাইলে না, বুঝতেও চাইলে না। আমার কষ্ট লাগে না বুঝি?’ বলেই মিলনের কাঁধ চেপে ধরে হু হু করে কাঁদতে থাকে তনু। এ সময় মামুনের মতো করে কে যেন বলে-‘যান মিলন ভাই। ওই এ্যাকসিডেন্টে মেয়ের তো কোন উপায় ছিল না। পরিস্থিতির শিকার হয়েও মেয়েটা যে ফিরে এসেছে, সেটা ক’টা মেয়ে পারে, বলুন। বাবাদের কত কী যে মেনে নিতে হয়... আমার ছেলেটার কথাই ধরুন...’
তনুর দিকে তাকায় একবার মিলন। যেন নতুন করে চিনবার চেষ্টা।... কেটে যায় কয়েকটা সেকেন্ড...মিনিট..। মামুন যেন আবারও বলে ওঠে, ‘কী ভাবছেন মিলন ভাই? দেখছেন না মেয়েটা কীভাবে অসহায়ের মতো কাঁদছে? ওকে কাছে টেনে নিন। ছায়া দিন। সন্তানদের বাবার ছায়া না হলে চলে না মিলন ভাই। মেয়েকেও এখন দরকার আপনার। ও কাছে থাকলে আপনার আর একা একা লাগবে না।’ দ্বিধায় পড়ে যায় মিলন। মামুন কি সব ঠিক বললো? না কেবলি সান্ত¦না? বেশ কিছু সময় কেটে যাওয়ার পরেও বাবার কোন সাড়া না পেয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যায় তনু। চোখ দুটো মুছে চোয়াল শক্ত করে চাপা স্বরে বলে সে, ‘চুপচাপ থেকো না বাবা। তুমি আমাকে চাও না জানি। তবু তোমার মুখ থেকে আজ এখুনি ফাইনালি শুনতে চাই-তোমার কাছে আমার জায়গা হবে কিনা। যদি বল নো, নো প্রবলেম, আমি আমার নিজের পথ বেছে নেব, সেখান থেকে চাইলেও আর কখনও ফেরাতে পারবে না আমাকে।’ ‘কোথায় যাবি তুই?’ অস্ফুট স্বরে জানতে চায় মিলন। ‘যেখান থেকে কেউ আর ফেরে না।’ ‘সুইসাইড?’ ‘নো, আই উইল নট ডু দ্যাট। আই লাভ মাইসেল্ফ ভেরি মাচ। ওই কাজ আমি করবো না। ডার্ক ওয়ার্ল্ড চেন? বল চেন কিনা?’ ‘চিনবো না কেন? নিজেকে নষ্ট করে তুই আমাকে ইমোশনাল ব্ল্কা মেইল করতে চাইছিস?’ ‘ইয়েস, যদি সেটাই ভাবো, তবে তাই। সেই অন্ধকারের দুর্গন্ধ তোমার গায়েও কিন্তু এসে লাগবে বাবা। মাইন্ড ইট। কোথাও মুখ দেখাতে পারবে না বলে দিলাম।’ উত্তেজনায় হাঁফাতে থাকে তনু। অপেক্ষায় থাকে বাবার মুখের দিকে চেয়ে। মিলন তাকিয়ে থাকে মামুনের কবরের দিকে। যেন অপেক্ষা...মামুন কিছু বলবে সে আশায়। কিন্তু কবর এবার নীরব। তনু আর দাঁড়ায় না। দু’চোখ মুছতে মুছতে ফিরে যেতে শুরু করে সে। হতবিহ্বল মিলন একবার মামুনের কবর, আরেকবার তনুর চলে যাওয়ার দিকে তাকায়। সামনে এগোতে চায় কিন্তু পা দুটো নড়ে না। যেন মাটির সঙ্গে সেঁটে থাকে পা দুটো। একবার মনে হয়-মামুন যদি ধাক্কা মেরে ঠেলে দিত সামনের দিকে! যদি দিত! কিন্তু কোথায় কে? তনু ততক্ষণে দৃষ্টির আড়ালে।...
ভার্জিন
শীর্ষ সংবাদ: