নাসিমা, হাফিজারা গোবরের ঘুঁটে বিক্রি করে জীবিকা চালায়। স্বামী সন্তান সংসার সামাল দিয়েও কোনো বিশ্রাম নেই তাদের। রাজনৈতিক স্লোগান, বিনোদনের খবর তাদের কানে পৌঁছে না। নিজেরাও সাজগোজ করার সময় পায় না। বাড়ির উঠানে পাড়ার মহিলাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার ফুরসত নেই। তারা শ্রম দেয় প্রতিদিন, প্রতি মাস, বছর সাল। তাদের শ্রম জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত চলছে, চলবে। এ যেন জীবিকার জন্য উদয় অস্ত সংগ্রাম। তবে জীবিকার এ যুদ্ধে তারা বিজয়ী। প্রতিদিন তারা ৬ থেকে ৭শ’ টাকা রোজগার করে। সংসারে জোগান দেয়। নিত্য দিনের চাহিদা মেটায়। স্বামী-সন্তান নিয়ে জীবনযাপন করে। তারা এ জীবনকেই পরম সুখ মনে করে। তবে তারা জ্বরা ব্যাধিতে কাতর। নিজ এলাকায় উন্নত চিকিৎসা নেই। অর্থাভাবে জেলা শহর বা নিজের উপজেলায় প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ পায় না।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার পোতাজিয়া-রাউতারা গ্রাম। পাবনা-বগুড়া মহাসড়কের শাহজাদপুর উপজেলার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারি বাড়ি যাওয়ার রাস্তার মোড়ের ঠিক উল্টা দিকে রাউতারা-পোতাজিয়া সড়কে যেতেই চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গো-চারণ ভূমি, এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই গবাদিপশুর খামার। এসব খামারে পালিত গরুর বিষ্ঠা বা গোবর প্রতিদিনই পরিষ্কার করা জরুরি। না হলে গরু খামারে থাকতে পারবে না। কারণ নানা রোগ-ব্যাধি ছড়াবে। অসুস্থ হবে, গরু মারা যাবে। প্রথম প্রথম মালিকেরা নিজেরাই গোবর সরানোর ব্যবস্থা করেছে। পরবর্তী সময় দিন মজুর পরিবারের নারী-পুরুষ এ কাজ শুরু করে। বাড়ির আঙিনায়, সড়কের পাশে এই গোবর শুকিয়ে ঘুঁটে তৈরি করে বাজারে বিক্রি শুরু করে। এতে বেশ লাভবান হয় এই দিন মজুর পরিবার। কিন্তু সময় বদলাতে থাকে, বদলায় পদ্ধতিও। এখন খামার মালিকের বাড়ি থেকে খামার পরিষ্কার করে গোবর কিনে আনতে হয়। খামারের ১০-১২টি গরুর গোবর বিক্রি হয় মাসকাবারি ১৫শ’ টাকায়। তাতে খামার মালিকরা লাভবান হয়। কিন্তু বিকল্প নেই দিন মজুর পরিবারের তাতেই রাজি তারা। কারণ এটা তাদের রোজগারের অবলম্বন।
নাসিমা, হাফিজার মতো আরও অনেক মহিলা আছেন, যারা এ আয়ের ওপর নির্ভরশীল। খামারের গোবর সংগ্রহ করে সড়কের পাশে বাড়ির আঙিনার বা খোলা মাঠে দিনভর হাতের মুঠা বা তালু দিয়ে একটি নির্দিষ্ট আকার তৈরি করে তা রোদে শুকাতে দেয়। বিকেলে এগুলো বস্তায় ভরে সাপ্তাহিক হাট কিংবা দৈনন্দিন বাজারে বিক্রি করে। ৫০ কেজি আকারের প্রতি বস্তা ঘুঁটে তুলে তা বিক্রি করে ১৪০ টাকা থেকে ১৫৯ টাকায়। তবে বস্তার আকার ৫০ কেজি হলে ঘুঁটের ওজন ২৫ থেকে ৩০ কেজির বেশি নয়। রাউতারা গ্রামের নাসিমা , হাফিজার সঙ্গে কথা বলে জানা গেলÑ প্রতি দিন এই ঘুঁটে বিক্রি করে তাদের আয় হয় ৬/৭শ’ টাকা।
নাসিমা দুই সন্তানের মা। স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তিনি জানান, রাউতারা এলাকায় দিনমজুর পরিবারের অনেক মহিলা আছেন, তারা রোজগারের অবলম্বন হিসেবে গোবরের ঘুঁটে তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেন। প্রতিদিনই শ্রম দিতে হয়। প্রখর রোদ, ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঘুঁটে শুকানোর কাজ করতে হয়। সাত সকালে খাবার তৈরী করে স্বামী-সন্তানকে খাইয়ে গো-খামারে গিয়ে গোবর সংগ্রহ করে তা টুকরিতে ভরে সড়কের পাশ ভেঙে দেই। এতে সময় গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়। স্বামী-সন্তানের জন্য দুপুরের খাবার তৈরি করে আবার মাঠে গিয়ে শুকানো ঘুঁটে বস্তায় ভরে ঘরে ফিরতেই সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। সারাদিনের পরিশ্রমের পর রাতে দ্রুতই ঘুমাতে হয়। কারণ পরদিন ভোরে উঠে আবারও একই কাজ। এ ঘুঁটে তৈরি করে তাদের পরিবারে ৬/৭শ’ টাকা জোগান দেওয়া নিত্য দিনের কাজ। এ যেন এক জীবন সংগ্রাম, রাজনৈতিক স্লেøাগান কিংবা বিনোদন সাজগোজ নিয়ে কথা উঠলে নাসিমা জানানÑ এগুলো কানে তোলার সময় নেই। বাড়ির পাশের মহিলারা এক সঙ্গে বসে গপ্প করব এমন সময়ই হাতে নেই। তবে তার দুঃখ রোগ তাপে এলাকায় ভালো কোনো ডাক্তার পাওয়া যায় না। উপজেলা বা জেলা সদরে গিয়ে উন্নত চিকিৎসার খরচ মেটানো খুবি কষ্ট হয়। সাধারণত সর্দি-জ্বর, পেট খারাপ, পাতলা পায়খানা, আমাশয় রোগের চিকিৎসা হয় কবিরাজ বা ওষুধের দোকানদারের পরামর্শে।
জীবিকার যুদ্ধে নাসিমারা জয়ী
শীর্ষ সংবাদ: