সম্প্রতি শেষ হলো কপ ২৯ সম্মেলন। আজারবাইজানে অনুষ্ঠিত এই জলবায়ূ আসলে নারী ও শিশুর বিষয়ও আলোচিত হয়। জলবায়ু বিপন্নতায় পরিবেশের চরম ক্ষতিকারক অবস্থা নিয়ে সোচ্চার সারা বিশ্ব। নৈসর্গ বিজ্ঞানীরা এমন দূষণ নিয়ে সাবধান বাণী ও বিশ্বকে সচেতন করতে সামনে নিয়ে আসছেন। বলাইবাহুল্য যে কোনো বিপরীত দুরবস্থার চরম শিকার হয়ে থাকেন সমসংখ্যক নারী বিপরীত দুরবস্থার চরম শিকার হয়ে থাকেন সমসংখ্যক নারী সমাজ। সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে মুক্তির সংগ্রাম ছাড়াও হরেক সামাজিক অপসংস্কারেও নারীদের চরম সংকট সামনে আসতে সময় নেয় না। আর প্রকৃতি পরিবেশের রুক্ষতাও সবার আগে গিয়ে পড়ে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া সমসংখ্যক নারীর ওপর। বিষময় প্রতিবেশে নারীদের শোচনীয় অবস্থার দুঃসময়ও সংশ্লিষ্টদের তাড়িয়ে বেড়ায়। বিভিন্ন সময় জলবায়ু দূষণ ও প্রতিকারে অনুষ্ঠিত কপ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নারী ও শিশুর ওপর দূষণের যে বাস্তব চিত্র উঠে আসে তা কিন্তু ভাবিয়ে তোলার মতো। লিঙ্গ সমতায় বৃহত্তর এশিয়ার জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতির ওপর আলোকপাত করতে বিভিন্ন সময় নারীর যে বেহাল চিত্র দৃশ্যমান হয় তা মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়।
জলবায়ু দূষণ গত শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্ন থেকেই বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়। সেখানে সর্বাগ্রে উঠে আসে ১৭৬০ সালের শিল্প বিপ্লবের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। জেমস ওয়াট আবিষ্কৃত বাষ্পীয় ইঞ্জিন সারা দুনিয়াকে যে নতুন সম্ভাবনার দিকে উন্মোচন করে তা ছিল এক অবধারিত যন্ত্রসভ্যতার নবযুগ। তেমন নতুন সময়ের মহাসন্ধিক্ষণে আধুনিক শিল্প যে মাত্রায় বিশ্বকে এগিয়ে নিয়ে যায় সেখানে গতি বেড়েছে প্রচুর। কিন্তু তার নেতিবাচক খারাপ সময় চিহ্নিত করতে বিশ্বকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও একটি গোটা শতক। উনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা নতুন এক বিপরীত আবহে শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন। সেখানে বলা হচ্ছে চিরায়ত সবুজ নৈসর্গ তার স্বভাবজাত সুষম অবস্থান থেকে ক্রমান্বয়ে বিচ্যুত কিংবা দূরে সরে যাচ্ছে। আর সেখানেই সবচাইতে দুঃসহ অবস্থার শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশু ও সর্বংসহা জননীরা। আর বৃহত্তর এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থানও তত সন্তোষজনক নয়। সমুদ্র পরিবেষ্টিত ও নদীবিধৌত বাংলাদেশ হরেক প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে সামাল দিয়ে টিকে থাকে। সেখানে দূষণ প্রক্রিয়া যদি আবারও আঘাত হানে তার দাম দিতে হয় পুরো জনগোষ্ঠীকে আর সেখানে সমানের দিকেই উঠে আসে নারীদের চরম দুর্গতির লাগাতর অসময়। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, প্লাবন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টির বাড়তি চাপে উপস্থিত প্রতিবেশ হয় বিঘ্নিত, বিধ্বংস। তার সিংহভাগ দায়ভাগ চাপছে নারী ও শিশুদের প্রতি। বসতভিটা তলিয়ে যাওয়া থেকে, খাদ্যে নিরাপত্তার অভাব এমনকি পুষ্টিহীনতায় ভুগতে হয় মা ও শিশুকেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্নানান্তরের দুর্ভোগ তো থাকেই। তার ওপর অতি আবশ্যিকভাবে ভর করে পুষ্টি ও খাদ্যাভাব। হরেক প্রাকৃতিক ও দূষণ সংকটে রান্নার জন্য উনুন জ্বালানো এক প্রকার বিপরীত আবহ। বিশেষ করে স্বল্প খাদ্য যা জোটে তাই দিয়ে দিতে হয় পরিবারের কর্তা মহাশয়কে। বাকিটুকু বয়োবৃদ্ধ মানুষদের। শিশুরাও কিছুটা বঞ্চিত হয়। তবে সার্বিক বঞ্চনার দুর্বিপাক এসে ভর কওে গৃহিণীর ওপর। অনাহারে,অর্ধাহারে জীবন কাটানো এক প্রকার নিয়মে দাঁড়িয়ে যায়। আর সেখানে কোনো নারী যদি গর্ভবতী হন তার বিপদ তো পদে পদে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত পরিবেশ দূষণের সম্মেলন কপ থেকে এমন সব নেতিবাচক তথ্য উঠে আসে নারীদের বিষয়ে। অতিবৃষ্টি আর বন্যায় কাঠের অপর্যাপ্ততা কিংবা, ভিজা কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালানোর যে সীমাহীন দুর্ভোগ তা নতুন করে বলারই কিছু নয়। তার মধ্যে যৎসামান্য আহার পরিচর্যায় সামনে থাকেন বয়োবৃদ্ধ, অসহায় শিশু আর পরিবারের কর্তাব্যক্তি। গৃহিণী নিজেই সব যোগাড় করে দুর্যোগের মধ্যেই সবার জন্য রান্না করলেও নিজের পাতে তেমন কোনো অবশিষ্ট না থাকাও দুঃসময়ের আকাল। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চল আর নিভৃত পল্লীতে হতদরিদ্র নারীদের দুরবস্থা সত্যিই এক অসহনীয় বিষয়। বিপরীত পরিবেশ নারীদের কোনো কিছু ভাবারও অবকাশ দেয় না। নিজের ভালো মন্দের হিসাব-নিকাশ করতে পেছনে হটতে হয়। বিপন্ন প্রতিবেশ আর অবর্ণনীয় দুর্ভোগে তাদের স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বেঁচে থাকার উপায়ও নাকি থাকে না। কপ সম্মেলনের হরেক প্রতিবেদনে তেমন দুঃসহ চিত্র সত্যিই সমসংখ্যক নারীর জন্য অচলায়তন এক যাত্রাপথ। আর লবণাক্ত পানির চরম আকালের মধ্যে পড়লে তো কথাই নেই। লবণাক্ত পানি পান করা মানেই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা। আর সেটাই নাকি হয়। প্রকৃতি দূষণ আর বিপরীত আবহ নারীদের মাথা ঘোরা থেকে বমি বমি ভাব সব মিলিয়ে এক দুর্বিষহ শারীরিক বিপন্নতায় নাজেহাল করে। যাতে স্বাস্থ্যহানিরও চরম প্রকাশ। বন্যা কিংবা প্লাবনে পরিবারের পুরুষরা যেভাবেই হোক না কেন অন্যত্র নিরাপদ স্থানে চলে যেতে সক্ষম হয়। যা নারীদের পক্ষে সত্যিই এক পাহাড়সম প্রাচীর। সেখানে হিসাব থাকে পরিবারের বয়স্ক ও শিশুদের বিষয়ে। যারা সত্যিই স্থানান্তরেও সক্ষম নন। কপ সম্মেলনে বারবার উচ্চারিত হয়ে আসছে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে যে মাত্রায় কার্বন নিঃসরণ হয় সেখানেই পরিবেশ দূষণে প্রভাব সর্বাধিক থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু অবাক হওয়ার মতো বিষয় বাংলাদেশ উন্নত বিশে^র আধুনিক প্রযুক্তি সেভাবে ব্যবহারও করে না। তা সত্ত্বেও নেতিবাচক সংকটে পড়তে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। আধুনিক প্রযুক্তির বিশে^র চাইতেও। সংগত কারণে কার্বন নিঃসরণে ক্ষতিকারক যে দূষণ তার প্রতিকারে শিল্পোন্নত দেশকেই সর্বাধিক সাহায্য সহযোগিতা দেওয়া বাঞ্ছনীয়। এছাড়া আছে নারীদের ঋতুস্রাবজনিত মাসিক বিষয়। যা দূষণের মাত্রা কিংবা বন্যা, অতিবৃষ্টিতে নাকাল হওয়ার দুরবস্থা। তৃতীয় বিশে^র পিছিয়ে পড়া দেশগুলো যে মাত্রায় কার্বন নিঃসরণের দুর্বিপাকে কাহিল হচ্ছে অনুষঙ্গ হিসেবে নারীদের অবস্থাও চরম অসময়ে আবর্তিত হয়। তবে উন্নত দেশগুলো তাদের অঙ্গীকারবদ্ধ অর্থ সাহায্যে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলকে সহযোগিতার বিষয়টিও সেভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। সেটাও বিপন্ন পরিস্থিতিকে সামাল দিতে হিমশিম খাবার দুরবস্থা। এখান থেকে পরিত্রাণ পেতে সচেতন দায়বদ্ধতা ছাড়া নারীদেরই নিজের প্রতি যথেষ্ট খেয়াল ও নজর রাখা অতি আবশ্যক। প্রজন্ম জাতিকে উপহার দেওয়াও কঠিন। সবাইকে সম্মিলিতভাবেই দুর্যোগ পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করা ন্যায্যতা। আগামীর বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম যাতে সুস্থ, সবলভাবে গড়ে উঠতে পারে তাও বিবেচনায় রাখা নিতান্ত জরুরি।