বগুড়ার শিবগঞ্জের উথলী বাজারে নবান্নের উৎসব ঘিরে বসে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা
হেমন্ত আলত পায় শীতের জানান দিয়ে যায়, অখন্ড নীলাকাশে প্রকৃতির স্নিাগ্ধতা। এই অপার সৌন্দর্য্যে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে ঘাসের ডগায় মুক্তা দানার মতো শিশিরের খেলার মুগ্ধতায় সোনাপাকা ধানখেতে বাতাসের দোলায় কুয়াশার চাদর কাটতে না কাটতেই হেমন্তের উৎসবে মেতে উঠেছিল বগুড়ার শিবগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম। কারণ নতুন ধান কাটার উৎসবের আবির ছড়িয়ে এসেছে যে ‘নবান্ন’র (নবান্না) মেলা, এমন উৎসবের ডাক দিয়ে বর্ণিল সৌহার্দ্য সম্প্রীতির মধ্যে রবিবার বগুড়ার শিবগঞ্জে হয়ে গেল দিনব্যাপী ‘নবান্নের’ মাছের মেলা। এই মাছের মেলা ঘিরে সেখানকার অর্ধশত গ্রামে নামে উৎসবের ঢল। বাড়ি বাড়ি নাইওরে আসাদের আনন্দমুখরতা। শুধু মাছ নয়, নবান্ন উপলক্ষে এই আয়োজনে ছিল গ্রামীণ মেলার সকল অনুষঙ্গ। মিষ্টান্ন থেকে নাগরদোলা, চুরি ফিতার দোকান কোনো কিছুই বাদ ছিল না। হেমন্ত মানেই তো নতুন ধান কাটার উৎসব। নতুন ধানের চালে অন্ন মুখে দেওয়ার নানা আচার পার্বণের মধ্যে নবান্নের উৎসব থেকে তো বাঙালিকে দূরে সরিরে রাখা যায় না। বাঙালির যাপিত জীবনে গ্রামবাংলায় লোকজ মেলা আর নবান্নের উৎসব অবিচ্ছেদ্য। আবহমানকাল থেকে বাঙালির প্রাণের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যের উৎসবের অন্যতম নবান্ন উৎসব। নবান্ন ঘিরে মেলার আয়োজন যেমন অনেক প্রাচীন তেমনি তা ঐতিহ্যের শিকড়ের বন্ধনেও জড়ানো। নবান্ন ও মেলাকেন্দ্রিক উৎসব এখনো গ্রামীণ জীবনে সর্বজনীন উৎসবের আরেক রূপ। নবান্ন উৎসব মিশে আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে। বাঙালি সং¯ৃ‹তির নানা বর্ণময় রূপের বহমনতা তুলে ধরে ভিন্নমাত্রার দ্যোতরা আনে নবান্ন উৎসব উপলক্ষে লোকজ মেলার আয়োজন। শিবগঞ্জের গ্রামে নবান (স্থানীয়ভাবে) নবান্নের মাছের মেলা তেমনি একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব নবান্নের মাছের মেলা। ধর্মবর্ণ মিলেমিশে উৎসবের আবীরে একাকার হয়ে গড়ে ওঠে সম্প্রীতির মেলবন্ধন হয়ে উঠেছে এই মাছের মেলা, যা চলছে যুগের পর যুগ।
‘এই হেমন্তে কাটা হবে ধান, আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলের বান’। সভ্যতার শুরু থেকেই খাদ্য সংগ্রহ কেন্দ্রিক উৎসব ছিল। এটি ফসল ঘিরে উৎসবে পরিণত হয়েছিল কালক্রমে। হৈমন্তিক উৎসবের আরেক নাম নবান্ন। সনাতনী পার্বণের সঙ্গে নবান্ন কিন্তু গ্রামীণ জীবনে রন্ধনের উৎসবেও রূপ নেয়। ফসলকেন্দ্রিক উৎসব নবান্ন রন্ধনে নানা ব্যঞ্জনা যুক্ত করে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে নবান্ন নানা আচার পালনের বিষয় থাকলেও নবান্নের মেলা কিন্তু ধর্মের সীমারেখা পেরিয়ে সম্প্রীতির সুরে সামাজিক মেলবন্ধনের আরও দৃঢ় করে তোলে। শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে শিবগঞ্জের উথলী বাজারে বসে নবান্নের মাছের মেলা। মেলা প্রাঙ্গণজুড়ে বটগাছসহ অন্যান্য গাছের ছায়া। ভোরের সূর্য্য রাতের আঁধার মিলিয়ে দেওয়ার আগেই উথলীসহ আশপাাশের এলাকাগুলো থেকে শুরু হয় মেলায় যাওয়ার পালা। আগের রাত থেকেই মেলার পণ্য ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মাছ আসতে থাকে ট্রাকের পর ট্রাক বোঝাই করে। ভোর থেকে মেলা প্রাঙ্গণে শুরু হয় বেচাকেনা। নবান্ন উৎসবের এই মেলায় যে ক্রেতাই আসুক আর তার অন্য কেনাকাটা যাই হোক মেলা থেকে মাছ কেনা চাই। কারণ মাছ না নিলে মেলায় আসা পরিপূর্ণতা পায় না। মুলত: নবান্ন উপলক্ষে মাছের মেলা হলেও দই, মুড়ি, চিড়াসহ নানা ধরনের মিষ্টান্ন ও নতুন ওঠা সব ধরনের সবজিতে ভরে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। কেউ বলেন, মেলার বয়স ৫০/৬০ কেউবা বলেন, প্রায় শত বছরের।
আশপাশের প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রামের নানা ধর্ম ও শ্রেণি পেশার মেলার শিশু কিশোর থেকে সব বয়সীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। অনেকে আসেন শুধু মেলা দেখতে। উথলী গ্রাম ঘিরে আশপাশের গ্রাম সরকারপাড়া, নারায়ণপুর,ধন্দাকোলা, গণেশপুর, দেবীপুর লক্ষীকোলা, গুজিয়া, আকনপাড়া, অর্জুনপুর, গরিবপুরসহ অর্ধশতাধিক গ্রাম ছাড়াও আশপাশের উপজেলাগুলো থেকেও লোকজন এই মেলায় আসেন। মেলায় নতুন জামাই অমলেশ সরকার ও ছেলে অমিত কুমারকে নিয়ে আসা বিপুল চন্দ্র মোদক জানালেন, সনাতনধর্মাবলম্বীদের পঞ্জিকা অনুসারে অগ্রহায়ণের প্রথমে এই মেলার আয়োজন শত বছরেরও বেশি। মাছের মেলার কারণে এখন এটি জমজমাট। মাছসহ কেনা দই মিষ্টি চিড়াসহ নানা মিস্টান্নের সঙ্গে নতুন ওঠা সবজিও কিনবেন। মেলার কেনাকাটায় ব্যয় হবে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। মাছ বিক্রেতা প্রদীপ কুমার জানালেন, ৩০ বছর ধরে তিনি মেলায় ব্যবসা করেন। মেলা সনতান হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নবান্নের উৎসব পালন উপলক্ষে আয়োজন হলেও এটি সবার।
সব ধর্মের মানুষের কাছেই এটি সমান। মেলার ক্রেতা এবং দর্শকদের ২০ শতাংশ সনাতন ধর্মাবলম্বী। উথলীর এই মেলার উৎসব শুধু মেলা প্রাঙ্গণেই সীমিত থাকে না। আশপাশের গ্রামেগুলোর বাড়িতে বাড়িতে ছড়ায় উৎসবের বর্ণিলতা নিয়ে। প্রতি বাড়িতে জামাইসহ কুটুম আসেন। উপলক্ষ নবান্নের মাছের মেলা। মেলায় দেড় শতাধিক মাছ বিক্রেতা নানা ধরনের মাছ নিয়ে এসেছিলেন এবার। তবে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই জানালেন এবার মাছের দাম বেশি। আমদানিও কিছুটা কম। তার পরও উৎসবের অংশ হতে ক্রেতাদের মাছ কিনতে উৎহের কমতি ছিল না। মাছ বিক্রেতা জামাল হোসেন জানান, মেলায় এবার ৩/৪ কেজি থেকে ১৮/২০ কেজি ওজনের নানা ধরনের মাছ ওঠে। প্রতিটি মাছের দোকানে ৩ লক্ষাধিক টাকার মাছ বিক্রি হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ৩ কোটি টাকারও বেশি মাছ বিক্রি হয় এক দিনের এই মেলায়। মাছ কিনতে আসলেও ‘নবান্ন’ উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সব নতুন সবজি ও কৃষি পণ্য কেনেন মেলা থেকে। মেলায় স্ত্রী ও ছেলে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন পাইকপাড়ার জামাই হাছান আলী। শ্বশুরবাড়িতে মেলা উপলক্ষে দাওয়াতে এসেছেন। শ্বশুরবাড়ির লোকজন কেনাকাটাসহ মাছ কিনেছেন। অরুণ কুমার ও সান্ত¡না রানী দাস দম্পতি জানান, মেলার জন্য তারা সারা বছর ধরে সঞ্চয় করেন। বাঁশের ঝুড়ি চালুনের ছোট ব্যবসা তার। তবে মেলায় এসেছেন কেনাকাটার জন্য। জানালেন অন্তত ১০ হাজার টাকার কেনা কাটা করবেন। এর সিংহভাগ ব্যয় হয়েছে মাছ কেনায়। জানালেন বাড়িতে আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দিয়েছেন। ৭৫ বছরের বৃদ্ধ জহুরুল দুই ছেলেকে নিয়ে মেলায় এসেছেন। কেনাকাটা করছেন ছেলেরা। তিনি ঘুরছেন। জানান শিশু বয়স থেকে তিনি মেলায় আসেন। এখানে এলেই ভালো লাগে। আগে নিজেই মাছ কিনতেন। এখন ছেলেরা কেনে।
ভোরের আলো শুরু হওয়ার সঙ্গে মেলা শুরু হলেও বিকাল গড়লেও মেলায় লোকজনের সমাগম আর উৎসবের ঢেউ ছিল একই রকম। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সম্প্রীতির মিলন কেন্দ্র হয়ে ‘নবান্নের’ এই মেলা ঐতিহ্য সংস্কৃতি, অসামাপ্রদায়িকতায় সম্প্রীতির বন্ধন হয়ে আলোকিত হয়ে ওঠে।