চারুকলার বকুলতলায় আয়োজিত নবান্ন উৎসবে শনিবার গ্রামীণ জীবন ও লোকায়ত সংস্কৃতির নানা দিক ফুটিয়ে তোলা হয়
কৃষিনির্ভর জীবন ও লোকায়ত সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ প্রকাশ করলেন রাজধানীবাসী। নাগরিক সমাজের এই অংশটি বরাবরই শেকড় সন্ধানী। পূর্বপুরুষের দান কখনো তারা অস্বীকার করেন না। শহুরে জীবন বেছে নিলেও, আত্মা বাঁচিয়ে রাখতে ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’ ধরে দৃঢ় পায়ে হাঁটেন। স্মৃতি কুড়িয়ে বেড়ান। অভিন্ন চেতনার জায়গা থেকে শনিবার তারা মেতে উঠেছিলেন নবান্ন উৎসবে। সকালে চারুকলার বকুলতলায় উৎসবের আয়োজন করা হয়। নবান্ন উৎসব উদ্যাপন পর্ষদের আয়োজন চলে রাত পর্যন্ত।
বাঙালির ফসলকেন্দ্রিক প্রাচীন উৎসব নবান্ন। প্রতি বছর অঘ্রানের প্রথম দিন দেশব্যাপী নবান্ন উৎসব উদ্যাপন করা হয়। নতুন ধান থেকে পাওয়া চালে হয় নবান্ন উৎসব। একসময় ফসল কাটার আগে বেজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখা হতো। বাকি অংশ চাল করে সে চালে হতো পায়েস রান্না। ঘরে- ঘরে চলত পিঠা-পুলির আয়োজন। আত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ করা হতো। এখন এসব আচার-অনুষ্ঠান পালনে কিছুটা ভাটা পড়লেও, একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। গ্রামীণ ঐতিহ্যের নবান্ন উৎসব উদ্যাপন করা হয় রাজধানী শহরেও। ১৯৯৯ সাল থেকে নিয়মিতভাবে উৎসবটি আয়োজন করা হয়ে আসছে।
অবশ্য এবার বাস্তবতা একটু ভিন্ন। বাঙালির নিজস্ব যা, যা যা গর্বের তার সবই কম-বেশি হুমকির মুখে পড়ে গেছে। এ অবস্থায় নবান্ন উৎসব কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয়-সন্দেহ ছিল। অবশেষে নাগরিক আয়োজনটির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেছে। ২৬তম নবান্ন উৎসবে গ্রামের ফসলকেন্দ্রিক সমাজ সংস্কৃতির উজ্জ¦ল বহির্প্রকাশ ঘটানো হয়। অসাম্প্রদায়িক উৎসবে যোগ দেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। অন্যান্য বছরের তুলনায় সংখ্যাটা কম হলেও, বৈরী সময়ে একে প্রাপ্তি হিসেবেই দেখতে হবে।
আয়োজকরা এদিনও উৎসব মঞ্চ ঘিরে একটি গ্রামীণ আবহ সৃষ্টি করেছিলেন। বাঁশের তৈরি কুলা, ঝুড়িসহ কৃষিকাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন গৃহস্থালী পণ্য দিয়ে সাজানো হয়েছিল মঞ্চ। সকাল সোয়া ৭টার দিকে ঐতিহ্যবাহী বাঁশির সুরে উৎসবের সূচনা করা হয়। বাঁশি বাজিয়ে শোনান হাসান আলী। তার পর গান কবিতা নাচসহ বিভিন্ন পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসতে থাকেন শিল্পীরা। কখনো একক পরিবেশনা। কখনো দলীয়। প্রতিটি পরিবেশনা থেকে বাংলাদেশের কৃষির চরিত্র, কৃষকের কাজের ধরন, ফসল ঘরে তোলার আনন্দ, ঐতিহ্যবাহী উদ্যাপনের চিত্র তুলে ধরা হয়। লোকগানের প্রিয় সুর নাগরিক মনে কী যে দোলা দিয়ে যায় এদিন! নৃত্যায়োজনগুলোও ছিল দারুণ উপভোগ্য। সাংস্কৃতিক পরিবেশনার পাশাপাশি আলোচনা পর্ব থেকেও কৃষকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা হয়। খাদ্যের জোগান দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা জানানো হয় তাদের প্রতি। সর্বোপরি শহুরে প্রজন্মকে গ্রাম দেখার, গ্রামের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
নবান্ন উৎসবে পিঠা খৈ মোয়া মুরালি, বাতাসার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে অন্যরকম একটি দিন। সকাল থেকে শুরু হওয়া উৎসব মাঝখানে বিরতি দিয়ে রাত পর্যন্ত চলে। একই দিন ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন স্থানে উদ্যাপিত হয়েছে নবান্ন উৎসব।