ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বাঙালির চির ঐতিহ্যের নবান্ন উৎসব আজ

অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি মধুর হাসি...

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:৩১, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি মধুর হাসি...

.

ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি মধুর হাসি...। জাতীয় সংগীতের এই চরণে, আহা, কী মায়া লেগে আছে! হৃদয়ের সবটুকু আবেগ দিয়ে বাঙালি বারবার গাইছে, গেয়ে চলেছে। কিন্তু অঘ্রানের সেই ভরা খেত দেখেছেন কখনো? মানে, জাতীয় সংগীতের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়েছে? এখন সেই সময়, মিলিয়ে দেখুন। অসাধারণ এক অনুভূতি হবে। আত্মাকে ফিরে পাবেন আবার। কারণ আজ থেকেই শুরু হয়েছে অগ্রহায়ণ। মাসের পুরোটাজুড়েই থাকবে ফসলের হাসি। কৃষকও হাসিমুখে নতুন ধান ঘরে তুলবেন। নতুন ধানেই আজ হবে ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব।
আবহমান কাল ধরে কৃষকের ঘরে-ঘরে নবান্ন উৎসব উদ্যাপিত হয়ে আসছে। ইতিহাস থেকে বিচ্যুতি অপচর্চা অপসংস্কৃতির রমরমা সময়েও যে কটা আচার-অনুষ্ঠান কৃষির ঐতিহ্য ও জনমানুষের সংস্কৃতিকে সবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরে, নবান্ন উৎসব সেগুলোর  অন্যতম। ফসলকেন্দ্রিক সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন উৎসব বলা হয় এটিকে। আজ শনিবার ১ অগ্রহায়ণ, নতুন ফসল ঘরে তোলার আনন্দে দেশজুড়েই হবে নবান্ন উৎসব। গ্রামের মতো নগরেও থাকবে বর্ণাঢ্য আয়োজন। ঢাকার চারুকলার বকুলতলায় সকালে নাগরিক নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হবে। লোকায়ত জীবন ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জয়গান করা হবে সংগীত কবিতা নৃত্যায়োজনে।  
নবান্ন মানে নতুন অন্ন। নতুন চালের রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবই নবান্ন উৎসব নামে পরিচিত। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব শুরু হয়। হাজার হাজার বছর আগে কৃষি প্রথা যখন চালু হয়েছিল, অনুমান করা হয়, তখন থেকেই নবান্ন উৎসব উদ্্যাপন করা হয়ে আসছে। ঘরে ফসল তোলার আনন্দে এ উৎসবের আয়োজন করা হতো। ফসল কাটার আগে কৃষকরা বেজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখতেন। বাকি ধান থেকে চাল করে সে চালে পায়েস করা হতো। এ ছাড়াও নবান্ন উৎসবের দিন গৃহস্থ বাড়িতে নানা পদ রান্না হতো। শাক, ভর্তা, ভাজিসহ কুড়ি থেকে চল্লিশ পদের তরকারি রান্না করা হতো কোনো কোনো বাড়িতে।
সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী, নবান্ন উৎসবের সঙ্গে ধর্মীয় কিছু আনুষ্ঠানিকতাও যোগ হয়। হিন্দুরা নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষ অন্ন প্রার্থনা করেন। পার্বণ বিধি অনুযায়ী হয় শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। শাস্ত্র মতে, নবান্ন শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়। কে চায় অমন পাপ করতে! অমুসলিম রীতিতে, নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করে।
আত্মীয়-স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন। নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা বিশেষ লৌকিক প্রথা। অন্য একটি আচার অনুযায়ী, বাড়ির উঠানের মাঝখানে একটি গর্ত করা হয়। তার চারপাশে পিটুলী দিয়ে আলপনা আঁকা হয়। এরপর গর্তে জ্যান্ত কই মাছ ও দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোঁতা হয়। সেই বাঁশের প্রতি কঞ্চিতে বাঁধা হয় ধানের ছড়া। নবান্ন উৎসবে কাকবলী, লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ হয়ে গেলে সবাই একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেন। এর আগে কেউ কিছু মুখে নেন না।
অগ্রহায়ণ প্রিয় ঋতু হেমন্তের দ্বিতীয় মাস। হেমন্তকে ফসলের ঋতু বলা হয়। আর প্রথম মাসটি কার্তিক। এক সময় মরা কার্তিকে এসে কৃষকের গোলা শূন্য হয়ে যেত। অভাব দেখা দিত খাবারের। সবাই তখন তাকিয়ে থাকত অগ্রহায়ণের দিকে। তবে যত দিন গেছে ততই বদলে গেছে হিসাব-নিকাশ। কার্তিক আর আগের মতো নেই। এ মাসেও পাওয়া যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ ধান। বস্তুত শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে এখন মোটামুটি সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন কৃষক। বিভিন্ন ফসল ফলান তারা। আয়-রোজগারও ভালো। কার্তিক মাসে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ। পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়।
অগ্রহায়ণ আমন ধান কাটার মাস। ফলন ও উৎপাদনে বোরোর চেয়ে আমন পিছিয়ে থাকলেও প্রতি বছর এর উৎপাদন বাড়ছে। লোক কবির ভাষায়- ‘আইলো অঘ্রান খুশীতে নাচে প্রাণ/চাষি কাঁচিতে দিলো শান/কাঁচি হাতে কচ কচা কচ কাটে চাষি পাকা ধান...।’ ঠিক এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে আগাম আমন ধান কাটার উৎসব। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে ফসল কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ চলছে পুরোদমে। বগুড়া, রংপুর, নীলফামারীসহ কয়েকটি জেলার কৃষক ব্যস্ত সময় পার করছেন এখন। কৃষকরা বাড়তি লোক নিয়ে ফসলের মাঠে যাচ্ছেন। দিনভর চলছে ধান কাটা। তারপর ফসল কাঁধে বাড়ি ফিরছেন। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষমাণ কিষানি। ধান মাড়াই, শুকিয়ে ঘরে তোলার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় খুশি মনেই অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে তাদের।
অবশ্য আজকের দিনে অধিকাংশ আচার-অনুষ্ঠানই বদলে গেছে। সনাতন মাড়াই প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। যন্ত্রযুগে প্রবেশ করেছে গ্রাম। কৃষি ছাড়াও আয়ের অনেক উৎস সৃষ্টি হয়েছে। চাকরির সুযোগ বেড়েছে। সম্প্রসারিত হয়েছে ব্যবসা। শুধু তাই ধানের জমির দিকে আর তাকিয়ে থাকতে হয় না। আর নাগরিক জীবনে নতুন ধান বা চালের তেমন কোনো অস্তিত্বই নেই। নেই বললেই চলে। তবে গ্রামে নতুন ধান ঘরে তোলা উপলক্ষে এবারও ঘরে-ঘরে নানা পদ রান্না হবে। থাকবে পিঠাপুলি পায়েসের আয়োজন। নেমন্তন্নও বাদ যাবে না।
রাজধানী শহর ঢাকায়ও বহু বছর ধরে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। বেশ ঘটা করে বর্ণিল এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। শহুরে শেকড় সন্ধানী সংস্কৃতি কর্মীরা লোক আঙ্গিকের গান নাচ ইত্যাদি পরিবেশনের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেন। চলে খৈ মুড়ি পিঠা-পুলির আয়োজনও। একইভাবে আজ সকালে চারুকলার বকুলতলায় নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হবে। জাতীয় নবান্ন উৎসব উদ্যাপন পর্ষদের পক্ষে নাঈম হাসান সুজা জানান, উৎসব শুরু হবে সকাল সোয়া ৭টায়। বর্ণিল আয়োজন থেকে লোকচেতনার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা হবে। শিল্পের নানা মাধ্যমে ফসলকেন্দ্রিক সমাজ ও অর্থনীতির চিত্র ফুটিয়ে তোলা হবে। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানো হবে কৃষকদের। নিজের সন্তানকে শেকড়ের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে উৎসবে নিয়ে আসার আমন্ত্রণও জানান তিনি। 

×