বর্ণাঢ্য আয়োজনে মণিপুরি সম্প্রদায়ের মহারাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়। শুক্রবার শ্রীমঙ্গলের কমলগঞ্জের ভানুগাছ এলাকা
নির্জন সুন্দরবনের দুবলারচর এখন নারী-পুরুষ-শিশু-যুবা নির্বিশেষে অগণিত পুণ্যার্থী মানুষের পদচারণায় মুখরিত। প্রায় দেড় শত বছরের ঐতিহ্যবাহী তিন দিনের রাস উৎসব উপলক্ষে তারা মনোবাসনা পূরণের জন্য এসেছেন। প্রতি বছর কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলারচরের আলোরকোলে কুঙ্গা নদীর মোহনায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা ও পুণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে এ রাস উৎসব হয়ে আসছে। সনাতন ধর্মাবলম্বী ছাড়াও অন্য ধর্মের মানুষ বনজীবীরা দুবলারচরের আলোরকোলে রাস উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। এবারও লক্ষাধিক লোকের সমাগম হবে বলে আয়োজকরা আশা করছেন। রাস পূজা ও স্নানকে ঘিরে আক্ষরিক অর্থে এখন দুবলারচরে লোকে লোকারণ্য। বৃহস্পতিবার রাত থেকে এ উৎসব শুরু হয়েছে। শনিবার ভোরে পুণ্য তিথিতে সমুদ্রে পুণ্যস্নানের মধ্যদিয়ে শেষ হবে এ উৎসবের।
রাস উৎসবের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, দুবলারচরের রাস উৎসব প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে নানা মত প্রচলিত আছে। তবে বেশিরভাগ সনাতন ধর্মাবলম্বী ও বনজীবীরা মনে করেন, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অবতার শ্রীকৃষ্ণ শারদীয় দুর্গোৎসবের পর পূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সঙ্গে রাসনৃত্যে মেতেছিলেন। এটিকে স্মরণ করেই দুবলায় পালিত হয়ে আসছে রাস উৎসব।
অনেকে এটাও মনে করেন, শ্রীকৃষ্ণ কোনো এক পূর্ণিমা তিথিতে পাপমোচন ও পুণ্যলাভে গঙ্গাস্নানের স্বপ্নাদেশ পান। তার স্বপ্নাদেশকে সম্মান জানাতে বসে রাসমেলা।
আবার কারও কারও মতে, ঠাকুর হরিচাঁদের অনুসারী হরিভজন নামে এক হিন্দু সাধুমেলার শুরু করেছিলেন ১৯২৩ সালে। এই সাধু চব্বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুন্দরবনে গাছের ফল-মূল খেয়ে জীবন ধারণ করেছেন।
তবে এক সময় রাস উৎসবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিপুল পরিমাণ ভক্ত ও দর্শনার্থী আসলেও, কয়েক বছর ধরে শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যেতে পারেন এই পূজায়। এবার এ উৎসব উপলক্ষে প্রশাসন, পুলিশ, র্যাব, বন বিভাগ, কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ ও সংশ্লিষ্টরা ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
এবার রাস উৎসবের জন্য সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগে মোট ৫টি প্রবেশ পথ নির্ধারণ করেছে বনবিভাগ। প্রবেশ পথগুলো হলো, ঢাংমারী, বগী, কচিখালী, শরণখোলা স্টেশন, বুড়িগোয়ালিনি, কৈখালী, কয়রা কাশিয়াবাদ এবং নলিয়ান। এসব স্থান থেকে বনভিাগের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করা যাবে।
কলাপাড়া, পটুয়াখালী ॥ সব ভক্তের দৃষ্টি পুব আকাশে। যেন অপলক নয়নে তাকিয়ে আছেন। সাগরের বুকচিরে সূর্যের লাল আভা উঁকি দিতেই হাজার হাজার রাসভক্ত নর-নারী জড়ো হন কুয়াকাটা সৈকতের বেলাভূমে। উলুধ্বনিতে সরগম গোটা সৈকত। রাসভক্ত পুণ্যার্থীরা কেউ পূজা করছেন। কেউ বা স্নানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। শুক্রবার প্রত্যুষে কুয়াকাটার দীর্ঘ সৈকতের বেলাভূমে ছিল এমন দৃশ্য। পরিপূর্ণ হয়ে যায় পুণ্যার্থীর মিলনমেলায়। হাজার হাজার ভক্তের যেন মিলনমেলা বসে। রাসভক্তদের পদচারণায় মুখর হয়ে
ওঠে। এ বছরও শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এ রাস উৎসবে ভক্তদের যেন ঢল নামে। ফি বছরের মতো সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারী হাজার হাজার নর-নারী সারা বছরের পঙ্কিলতা দূর করেন সাগরে পুণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে। কেউ বা করেন এখান পানি সংগ্রহ। আসেন জাগতিক পাপ মোচনের আশায়। তবে এ বছর পুণ্যস্নানের তিথি রয়েছে শনিবার ভোর রাত অবধি। শুক্রবার দিনভরই পুণ্যার্থীরা সাগরে করেছেন পুণ্যস্নান।
রাসলীলার এই পুণ্যস্নানে অংশ নিতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকেই রাসভক্তদের কুয়াকাটায় আগমন শুরু হয়। শুক্রবার সন্ধ্যার পরে কুয়াকাটায় রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে সমবেত হন হাজার হাজার রাসভক্ত পুণ্যার্থী। রাত জেগে তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। কেউ বা আবার রাস মেলায় প্রিয়জনের জন্য করেন কেনাকাটা। মধ্যরাতেই সাগরে পুণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে সেখানকার অনুষ্ঠানমালার সমাপ্তি হয়। রাসভক্ত অনেকে জানালেন রোগশোক থেকে মুক্তির আশায় তারা সপরিবারে পুণ্যস্নানে এসেছেন। কেউ বাসে, কেউবা অটো কিংবা ইজি বাইক নিয়ে এসেছেন রাস উৎসবে। রাসমেলার উদ্বোধন করেন পটুয়াখালীর জেলা আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন। এ সময় কলাপাড়ার ইউএনও রবিউল ইসলামসহ গণ্যমান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এবারে রাসকে ঘিরে কলাপাড়া উপজেলা প্রশাসন ও কুয়াকাটা পৌরসভার উদ্যোগে বিশেষ সাংস্কুতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
ভক্ত অনিতা রাণী জানান, তিনি এ নিয়ে ১৪ বার পুণ্যস্নানে কুয়াকাটায় আসেন। তার বিশ^াস এখানে পুণ্যস্নানে তার সকল মনের বাসনা পূরণ হয়। সারা বছরের পাপ মোচনের আশায় সে এবছরও সপরিবারে এসেছেন। মধাব-সাগরী দম্পতি জানান, ফি বছরের মতো পুণ্যের আশায় সাগরে পুণ্যস্নানে তারাও সপরিবারে এসছেন। এদের বিশ^াস সারা বছরের পঙ্কিলতা দূর হবে পুণ্যস্নানসহ ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে। রাস উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী নিহার রঞ্জন বলেন ‘শুক্রবার পূজার আনুষ্ঠানিকতার রাতভর চলবে নামকীর্তন। ভগবৎপাঠ ও আরতি। শ্রীকৃষ্ণের লীলা কীর্তনে অংশ নেবেন ভক্তরা।
রাসভক্তরা আজ শনিবার বিকেল থেকে উপজেলা সদর কলাপাড়ার মদনমোহন সেবাশ্রমে ধর্মীয় উৎসবে মিলিত হবেন। সেবাশ্রমে স্থাপন করা রাধাকৃষ্ণের ১৭ জোড়া যুগল প্রতিমা দর্শন ছাড়াও ধর্মীয় উৎসব পালন করবেন আগতরা। সেবাশ্রম অঙ্গনে ব্যাপক পরিসরে দোকানপাট বসেছে। এখানে শুরু হয়েছে পাঁচ দিনের রাসমেলা। হিন্দু সম্প্রদায়ের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী রাস পূর্ণিমার উৎসবকে ঘিরে কলাপাড়া-কুয়াকাটায় ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রাণ ফিরে পায় ব্যবসায়ীরা। হোটেল-মোটেল থেকে সকল দোকানপাটে থাকে ক্রেতার উপচেপড়া ভিড়। রাস পূর্ণিমার তিথিতে কুয়াকাটায় বঙ্গোপসাগরে পুণ্যস্নানে আসা পুণ্যার্থীদের জন্য সকল ধরনের নিরাপত্তার প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
উপজেলা নির্বাহী রবিউল ইসলাম জানান, রাস পূর্ণিমা উপলক্ষে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক স্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। জেলা-উপজেলা ও পৌর প্রশাসনের সমন্বয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া সার্বক্ষণিক থানা পুলিশ, সেনাবাহিনী, ট্যুরিস্ট পুলিশসহ পাঁচ শতাধিক সদস্য আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন। মন্দির এলাকা সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। আগত রাসভক্তদের জন্য বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। স্যানিটেশন ব্যবস্থার জন্য অস্থায়ী লেট্রিন স্থাপন করা হয়েছে। রাসভক্ত নারীরা পুণ্যস্নান শেষে যেন শালীনতা বজায় রেখে পোশাক পরিবর্তন করতে পারেন এজন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ব্যবস্থা রয়েছে সুপেয় পানির। পুণ্যস্নানের সময় সকল ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উদ্ধারকারী দল রাখা হয়েছে। কুয়াকাটা সৈকত পরিচ্ছন্ন রাখতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।