.
বই শিশু ও কিশোরদের মনন বিকাশে অনন্য ভূমিকা পালন করে। তবে শিশু বয়সে কিছু মজার মজার ছড়া পড়ে আনন্দ পাওয়া ও সেই ছড়া মুখস্থ করে প্রিয়জনদের শোনানো ছাড়া তেমন কিছু করার নেই। বই পড়ার আসল মজা হলো কিশোর বেলায়। এ সময় নানা ঢঙের কিশোর উপযোগী ছড়া-কবিতা, গল্প-অ্যাডভেঞ্চার পড়ে আলোকিত ও রোমাঞ্চিত হওয়ার প্রকৃষ্ট সময়। একটি সুন্দর কিশোর মন ভবিষ্যতের জাতি গঠনে ও জাতীয় অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যে জাতির কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে কিশোর সাহিত্য জনপ্রিয় নয়, সে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বাংলা সাহিত্যে অনেক জনপ্রিয় কিশোর সাহিত্যিক অতীতেও যেমন ছিলেন, এখনো তেমন আছেন। এক্ষেত্রে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই যার নাম আসে, তিনি সুকুমার রায়। কিশোরদের জন্য বিচিত্র ভাবনার অনেক সুন্দর সুন্দর ছড়া তিনি লিখেছেন।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছড়াগুলোও চমকপ্রদ এবং অবশ্যই মনোরঞ্জক। গদ্য সাহিত্যে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। কিশোর বয়সের মন ও মননের বিকাশে এর কোনো জুড়ি নেই। অপু ও দুর্গার কিশোর বয়সের সেইসব খণ্ড খণ্ড কাহিনী আজও মনকে উদ্বেল করে তোলে। কাজী নজরুল ইসলামের লিচু চোর, খুকি ও কাঠবিড়ালী, খাদু দাদু, খোকার সাধ প্রভৃতি কিশোর মনে দারুণ দোলা দিয়ে যায়। তবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সংকল্প’ কবিতাটি কিশোর-কিশোরী মনে জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন জাগিয়ে তোলে। অসম্ভবকে জয় করার স্পর্ধা জোগায়। রবীন্দ্রনাথের সবুজের অভিযান কিশোরের মানস থেকে সংকীর্ণতার মনোভাবকে সমূলে উপড়ে ফেলে।
অগ্রজ প্রজন্মের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে একটি সজীব, প্রাণবন্ত ও মানবিক ভবিষ্যৎ নির্মাণের আহ্বান জানায়। কবি জসিমউদ্দিন কিশোরদের জন্য অনেক ছড়া-কবিতা ও গল্প লিখেছেন। তার কবিতা ও ছড়া বহুল পঠিত হলেও দারুন মজাদার কিশোর গল্পগুলো আজ কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে। তার লেখা ‘বাঙালির হাসির গল্প’ নামে দুই খণ্ডের একটি বই রয়েছেÑ যা কিশোর গল্পের অনবদ্য সংকলন। সত্যজিৎ রায়ের কিশোর অ্যাডভেঞ্চার ও রহস্য গল্পের নায়ক ফেলুদা দুই বাংলার কিশোরদের কাছেই সমান জনপ্রিয়। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু সিরিজও কিশোরদের মন জয় করে নেয়ার মতো চিত্তাকর্ষক।
বাংলাদেশে কিশোরদের সায়েন্স ফিকশনকে সর্বপ্রথম জনপ্রিয় করে তোলেন সাহিত্যের যাদুকর হুমায়ূন আহমেদ। তার লেখা ইরিনা, কুহক, তোমাদের জন্য ভালোবাসা, ফিহা সমীকরণÑ কিশোর পাঠকের মনকে বারবার আপ্লুত করেছে। বাংলা কিশোর রহস্য সাহিত্যে রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা সিরিজ একটি মাইলফলক। তিন গোয়েন্দা, কিশোর মুসা রবিন দেশি ও বিদেশি পটভূমিতে নানা অ্যাডভেঞ্চার ও রহস্য উন্মোচনে জড়িয়ে পড়ে। এ সিরিজের রহস্য রোমাঞ্চে বাংলাদেশের অনেক মানুষের কৈশোরকাল ঘোরের মধ্যে কেটে গিয়েছে। খালেদা এদিব চৌধুরী, আবুল খায়ের মুসলেহ উদ্দিন, নাসির আলী, খালেক বিন জয়নুদ্দিন, আনজির লিটন, লুৎফর রহমান রিটন, আমিরুল ইসলাম প্রমুখ বরেণ্য কবি ও লেখক কিশোর সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় দু’হাত ভরে লিখে সাহিত্যের এ শাখাকে সমৃদ্ধ করেছেন।
চ্যানেল আইয়ের কর্ণধার ফরিদুর রেজা সাগরের হাল আমলের লেখা ছোট কাকু সিরিজটিও কিশোরদের মাঝে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এতো গেল বাংলা কিশোর সাহিত্যের আলোচনা। কিশোরদের জন্য রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের লেখা কিশোর ক্লাসিক উপন্যাস ও গল্প। এডগার রাইস বারোজের টারজান, রুইয়ার্ড কিপলিংয়ের দ্য জাঙ্গল বুক, আলেকজান্ডার দ্যুমার থ্রি মাস্কটিয়ার, কাউন্ট অভ মন্ট্রিক্রিসো, চার্লস ডিকেন্সের অলিভার টুইস্ট, ডেভিড কপারফিল্ড, গ্রেট এক্সপেক্টেশন, স্যার ওয়াল্টার স্কটের আইভানহো, মার্ক টোয়েনের টম সয়্যার, মিগুয়েল ডি সারভান্তেসের ডন কুইক্সোট, হাওয়ার্ড পাইলের দ্য এডভেঞ্চার অভ রবিন হুড প্রভৃতি বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
আমাদের বর্তমান কিশোর প্রজন্ম নেট ও ভিডিও গেমের জগৎ থেকে একটু নজর সরিয়ে যদি এ সকল কিশোর সাহিত্যে মনোযোগ দেয়, তবে সামাজিক অবক্ষয় যেমন রোধ হবে, জাতিও তেমনি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। কিশোর-কিশোরীরা এখন যেমন ঘরে আবদ্ধ থেকে মোবাইলে সময় অপচয় করছে, তেমনটি না করে সাহিত্য ও খেলাধুলার মাধ্যমে শরীর ও মনের বিকাশ করলে জাতি একটি সমৃদ্ধ, কর্মক্ষম, স্বপ্নময়, মানবিক নতুন প্রজন্ম পাবে। বড়দের দায়িত্ব কিশোর-কিশোরীদের তেমন আলোকিত পথে নিয়ে যাওয়া।
আরেকটি কথা- এটা হলো বাবা-মায়েদের একটি ভুল প্রসঙ্গে। বাবা-মা অনেক সময় তাদের কিশোর ছেলে বা কিশোরী মেয়েকে গুরুগম্ভীর, তথ্যমূলক, উচ্চস্তরের বই পড়ার জন্য ধরিয়ে দেয়। ফলে এসব বই বুঝতে না পেরে কিশোর-কিশোরীদের বই পড়ার ওপর একধরনের ঘৃণা জন্মে যায়। এ ধরনের ভুল করা যাবে না। তারা মজা পায়, এ ধরনের বই তাদের পড়তে দিন। পড়ায় একবার মজা পেলে ওরা একদিন ঐ সব গুরুগম্ভীর বইয়েও মজা খুঁজে পাবে। আর সেদিনই ওরা হয়ে উঠবে সার্থক পাঠক।