.
বাল্য বিয়ে যে কোনো সমাজ-সংস্কারের এক অপ্রতিরোধ্য বিপন্ন অবস্থা। বাল্য বিয়ে মানেই অকাল মাতৃত্ব। সেখানে শুধু গর্ভধারিণী মা-ই নন বরং স্নেহে মায়া মমতায় নিত্য সাহচর্যে গড়ে তোলাও মাতৃত্বের পরম মহিমাও। সদ্যজাত সন্তানের দেখভালের দায়িত্বে থাকা স্নেহময়ী জননী কতখানি মাতৃত্বের অধিকারে অভিভাবকত্ব পেতে পারেন তা আজও প্রশ্নবিদ্ধই শুধু নয় বরং অপরিণামদর্শিতার চরম বিঘ্নতাও বটে। দেশ থেকে সারাবিশ্বে সমতাভিত্তিক সমাজ গঠন প্রক্রিয়ার জোরদার আন্দোলন শুরু হলেও অনেক বিপরীত প্রবাহও জিইয়ে থাকা অস্বস্তিকর। একজন সম্ভাবনাময় তরুণী মা হওয়ার সুবর্ণ সময়ে তার শরীর ও মনের পরিপক্বতা কতখানি অনুকূলে থাকে সেটাও বিবেচ্য বিষয় হয়ে যায়। এ নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনে তথ্য-উপাত্তেরও কমতি নেই। আমাদের দেশে যেখানে বাল্য বিয়ে নামক অপরিণত সামাজিক ধর্মীয়বোধ কমানো গেল না সেখানে অকাল মাতৃত্বের আশঙ্কা পদে পদে। এমন তথ্যও বিষন্ন হওয়ার দুরবস্থায়। দৃশ্যমান হচ্ছে এক শিশুর গর্ভে আর এক শিশুর ভ্রুণ লালন পালন করা মাতৃত্বের পরম আকাক্সক্ষায়। কিন্তু সন্তান যখন জগতের আলো দেখে তখন থেকেই মায়ের সেবা-যত্ন, সুনিবিড় ছায়া আর তৈরি হওয়ার পথে নিঃশর্ত সমর্পণ সবই প্রচলিত সমাজের লিখিত-অলিখিত বিধি নিয়ম বলাই যায়। ধরা যাক, ১৪ বছরের এক উদীয়মান কিশোরী চিরায়ত মাতৃত্বের আভরণে জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েই নিল।
কিন্তু সে যথার্থভাবে তার কোল আলো করে সন্তানটিকে দেখভালের প্রস্তুতিপর্বে কতখানি সক্ষম সেটাও এক বিপন্নতার প্রতিবেশ। বাংলাদেশ এখনো গ্রামনির্ভর সমাজের পরম নির্দেশক। সিংহভাগ মানুষ জীবন কাটায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যেখানে শিক্ষার আলো ছড়ায় না, নব্য সংস্কৃতির ছায়া পড়ে না, আর আধুনিকতার নির্মাল্য তো দূর অস্ত। সেই আবহমান পল্লী জননীর ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়ের অধিবাসীরা যুগ-যুগান্তরের পুরনো সংস্কার আর জীবনাচরণে অভ্যস্ত। সেখানে কোন মায়ের ভূমিকা কতখানি জোরালো কিংবা নগণ্য সত্যিই আড়ালে। একজন শিশুর জন্মের পর থেকে শুধু খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা নয় তার সামগ্রিক জীবন গঠন প্রক্রিয়ায় মায়ের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান সন্তানকে যে মাত্রায় পরিপূর্ণ করে তার দাম অমূল্য। কিন্তু প্রশ্ন অন্যখানে। যথার্থ অভিভাবক হিসেবে সন্তানের প্রতি শুধু দায়-দায়িত্ব পালন। অন্য কিছু নয়। সেখানে মায়ের অবস্থান নাকি শুধু জিম্মাদারি। এটা নিয়ে বহু বাগ্বিতন্ডা, অভিযোগ, আপত্তি উঠলেও আইনি সমাধান কিন্তু দ্রুততার সঙ্গে না হওয়াও মায়ের প্রতি অন্যায়, অবিচার তো বটেই। নিজের পক্ষে আইনি লড়াই করতে গেলে শুধু অর্থ-বিত্তই যথেষ্ট নয় বরং সামাজিক অবস্থান কিংবা গ্রহণযোগ্যতাও এসে যায়। যদিও শব্দগুলো একেবারেই আপেক্ষিক। সর্ব ধর্মেই মাকে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া প্রচলিত, প্রতিষ্ঠিত সংস্কারের অনন্য বিধি। ইসলাম ধর্মে মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত এমন ধর্মীয় আদেশে জন্মদাত্রী মায়ের যে সম্মান, মর্যাদা, মহিমার অন্য কোনো তুলনায় সন্তানের জন্য প্রাপ্যতা, মঙ্গলজনক তা বলাই যায় না। এমন সর্বংসহা জননী মাতৃভূমির গরিমায়ও অলঙ্কৃত। কিন্তু অভিভাবকত্ব আইনের কোনো বিধান উল্লেখ না থাকায় মাতৃশৌর্যের ওপর আঁচড় বসানো। তবে বাদ, প্রতিবাদ, ওজর, অভিযোগে তেমন আইন সংশোধন করে মাকে পূর্ণ মর্যাদায় অভিষিক্ত করাও বিচার ব্যবস্থাপনার অশেষ মান্যতা পাওয়া। তা ছাড়া ২০২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি জিম্মাদার থেকে মাকে অভিভাবকত্বে বসানো ছিল আইনি বিধির আধুনিকায়ন ও মাতৃত্বের পরম উপহার। একজন শিশু কন্যা কিংবা পুত্র সন্তানের আধিপত্যেও আছে অসমতা কিংবা বৈষম্য।
সেখানে পুত্র সন্তানের ৭ বছর এবং কন্যা সন্তানের ১৮ বছর পর্যন্ত শুধু মায়ের তত্ত্বাবধান। কিন্তু অভিভাবকত্ব দেওয়া হয়নি মাকে। সন্তান শুধু মায়ের হেফাজতে থাকবে। আইনিভাবে পুরো দায়িত্ব কিন্তু পিতার। এখানে বিশিষ্ট আইনবিদ সালমা আলী যিনি নারীর আইনি অধিকারে বরাবরই সোচ্চার থাকেন তিনি বর্তমান সংস্কার প্রক্রিয়ায় মায়ের অধিকার নতুন দেশ গঠনের আলোকে আধুনিকায়ন ও ন্যায্যতা জরুরি বলে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করেন। সন্তানের যথার্থ অভিভাবক নাকি পিতা। বিচ্ছিন্ন পিতা-মাতার ক্ষেত্রেও তেমন আইন স্বতসিদ্ধ। টানাপোড়েনে পড়ে সন্তানরা। আর পুরুষ প্রাধান্য সমাজে অতি অবশ্যই পুত্র নয় বরং কন্যাই যত বিপরীত ¯্রােতকে মোকাবিলা করে। তবে আধুনিক শিল্পোন্নত বাংলাদেশও আইনি বিধান ছাড়া সন্তানের প্রতি মায়ের দায়বদ্ধতাকে অনস্বীকার্য দাবি করতে আর পিছু হটছে না। সেখানে নারী শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়া, হরেক পেশায় নারীদের নিত্যনতুন অভিগমন সবই নতুন সময়ের অনুষঙ্গেই এগিয়ে যাওয়া। সঙ্গতকারণে সামগ্রিক সমাজের হরেক অপসংস্কার পুরনো বিধির ওপর নবযুগের আলোকিত কিরণ পড়া সময়ের অপরিহার্যতা। এখন নতুন সময়ের অনন্য শুভযোগে পশ্চাদপদ নারীরা শুধু অভিভাবকত্বে নয় বরং সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারিত্বে নিজেদের যোগ্যতম হিসেবে প্রমাণ করছেন নির্দ্বিধায়, অবলীলায়, স্বাচ্ছন্দ্যভাবে। সমতার আদলে এগিয়ে যাওয়া আধুনিক রাষ্ট্র সমাজ হরেক অপশাসন আর মান্ধাতা আমলের পুরনো সংস্কার, প্রচলিত বিধিনিষেধকে ক্রমান্বয়ে অতিক্রম করছে। সুশিক্ষিত, স্বাবলম্বী মায়েরাই আজ যে কোনো সন্তানের যথার্থ অভিভাকত্বে তাদের জীবনের দিকনির্দেশনায় জোরালো দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তবে আমাদের দেশের সুগৃহিণী, সক্ষম মায়েরাই এক সময় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের উপহার দিয়ে জাতির গৌরব মহিমায় অবিচ্ছেদ্য থেকেছেন। নেপোলিয়ানের সেই অমৃত ও সার্বজনীন বাণী একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকেও অক্ষয় ঐশ^র্য। উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন আমাকে একজন মা দাও আমি একটি শ্রেষ্ঠ জাতি উপহার দেব।
অপরাজিতা প্রতিবেদক