নবান্ন উৎসব সামনে। তার আগেই নতুন চালের পিঠা তৈরির দৃশ্য চোখে পড়ছে গ্রাম-শহর সবখানে
বাঙালির আদি ঐতিহ্য, গৌরবের ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার কত রকম চেষ্টা এখন দেশে হচ্ছে! সচেতনতার অভাবেও হারিয়ে যাচ্ছে অনেককিছু। আর বিশ্বায়নের থাবা তো আছেই। তাই বলে সবাই নিজের সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছেন- এমনও নয়। বরং অসংখ্য মানুষ শেকড় সন্ধানী। পূর্বপুরুষের কৃষ্টি-কালচারের প্রতি যত্নবান। ফসলকেন্দ্রিক অনেক লোকাচার বা উৎসব অনুষ্ঠান তারা বাঁচিয়ে রেখেছেন। নবান্ন উৎসবের বেলায়ও এই কথা সত্যি। এই উৎসব ঘিরে অন্যরকম আবেগ-উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যায় এখনো। প্রতি বছর গ্রামে, এমনকি শহরে নবান্ন ঘিরে উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এবারও চলছে প্রস্তুতি। আর মাত্র ক’দিন পর ১ অগ্রহায়ণ, ওইদিন প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে সারাদেশেই হবে নবান্ন উৎসব।
বাঙালির ফসলকেন্দ্রিক প্রাচীন উৎসব নবান্ন। নতুন ধান থেকে পাওয়া চালে হয় নবান্ন উৎসব। একসময় ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখা হতো। বাকি অংশ চাল করে সে চালে হতো পায়েস রান্না। ঘরে-ঘরে চলত পিঠা-পুলির আয়োজন। আত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ করা হতো। এখনো গ্রামে এ ধরনের নানা আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতা চোখে পড়ে।
তবে বর্তমান বাংলাদেশে শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে মোটামুটি সারাবছরই কম-বেশি ফসল হয়। বছরজুড়ে নানা ফসল ফলান কৃষকরা। এমনকি যে কার্তিককে ‘মরা কার্তিক’ বলা হতো সে মাসেই হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ।
বাইরের জেলাগুলো থেকে পাওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় জোরেসোরে চলছে আগাম আমন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ। বর্ষার শেষদিকে আউশ আমন বোনা হয়েছিল। বর্তমানে আমন ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যস্ত কৃষক কৃষাণী। ওস্তাদ মোমতাজ আলী খানের একটি গানের কথা মনে পড়ে গেল, যেখানে তিনি বলছেন, চাষির বউ সকাল বেলায়/বাঁশের ঝাড়ের ছায়ায়/ধান ঝারে আর ধান উড়ায়/ঝির ঝির ঝির হাওয়ায়/সেই বউয়ের হাতের রেশমি চুড়ি/রুনু ঝুনা বাজে/ সেই না সুরে চাষির মন আর/যেতে চায় না কাজে...।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, নবান্নের সময়টাতে দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ফসল উৎপাদন হয়। প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন আমন উৎপাদন হয় এ সময়। প্রচুর ফসল ঘরে তোলার আনন্দ প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও। প্রকৃতির দানের কথা স্বীকার করে নিয়ে কবিগুরু লিখেছেন, ‘ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।/দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।’
গ্রামের মতো শহরেও, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় প্রতি বছর জাতীয়ভাবে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। লোকগান নাচ আবৃত্তিসহ নানা পরিবেশনায় শিল্পীরা কৃষিনির্ভর জীবন ও সংস্কৃতির জয়গান করেন। শেকড়ের সংস্কৃতি তুলে ধরা হয় নাগরিক মঞ্চ থেকে।
থাকে পিঠাপুলির আয়োজনও। অগ্রহায়ণের প্রথম দিন ঢাকার চারুকলায় বা শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে নবান্ন উৎসব আয়োজন করা হয়। নবান্ন উৎসব উদ্যাপন পর্ষদের আয়োজনে আগ্রহ নিয়ে যোগ দেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। আয়োজকদের মতে, গ্রামে ফিরে যাওয়ার আকুতি থেকেই নগরে নবান্ন উৎসব আয়োজন করা হয়। গ্রামীণ ঐতিহ্যের উৎসব নিজেকে চিনতে সহায়তা করে। এসব কারণেই ঘটা করে নবান্ন উৎসব আয়োজন করা হয়। তবে এবার দেশের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। ফলে রাজধানী শহরের আয়োজনটি অব্যাহত রাখা যাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। গ্রামে হবে ঠিকই। কারণ গ্রামের ঘরে-ঘরে চলে নবান্ন উৎসব। নতুন ধান থেকে চাল, চাল থেকে মায়ের হাতের বানানো পিঠা! সন্তান না খেয়ে পারে? পিঠার পাশাপাশি পায়েস ফিন্নি ইত্যাদিও হবে যথারীতি। অবশ্য তারও আগে রাজধানী শহরের অলিগলি ফুটপাতে চুলো বসে গেছে। সেখানে তৈরি হচ্ছে পিঠা। নাগরিকরা এরই মাঝে ভাঁপা চিতই তেলের পিঠার স্বাদ নিতে শুরু করেছেন। পিঠা খেতে খেতে কল্পনায় গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন তারা। নবান্ন উৎসবের কথা মনে করছেন। এই যে মনে করা, এই যে পেছন ফিরে তাকানো, এটাই তো বাঙালির শক্তি! এই শক্তি রুখে দেওয়ার সাধ্য আছে কার?