ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

শিকড়ের কাছে ফেরার ডাক

নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠার অপেক্ষা

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২১:৫০, ১৩ নভেম্বর ২০২৪

নবান্ন উৎসবে মেতে  ওঠার অপেক্ষা

নবান্ন উৎসব সামনে। তার আগেই নতুন চালের পিঠা তৈরির দৃশ্য চোখে পড়ছে গ্রাম-শহর সবখানে

বাঙালির আদি ঐতিহ্য, গৌরবের ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার কত রকম চেষ্টা এখন দেশে হচ্ছে! সচেতনতার অভাবেও হারিয়ে যাচ্ছে অনেককিছুআর বিশ্বায়নের থাবা তো আছেইতাই বলে সবাই নিজের সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছেন- এমনও নয়বরং অসংখ্য মানুষ শেকড় সন্ধানীপূর্বপুরুষের কৃষ্টি-কালচারের প্রতি যত্নবানফসলকেন্দ্রিক অনেক লোকাচার বা উসব অনুষ্ঠান তারা বাঁচিয়ে রেখেছেননবান্ন উসবের বেলায়ও এই কথা সত্যিএই উসব ঘিরে অন্যরকম আবেগ-উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যায় এখনোপ্রতি বছর গ্রামে, এমনকি শহরে নবান্ন ঘিরে উসব-অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়এবারও চলছে প্রস্তুতিআর মাত্র কদিন পর ১ অগ্রহায়ণ, ওইদিন প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে সারাদেশেই হবে নবান্ন উসব

বাঙালির ফসলকেন্দ্রিক প্রাচীন উসব নবান্ননতুন ধান থেকে পাওয়া চালে হয় নবান্ন উসবএকসময় ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখা হতোবাকি অংশ চাল করে সে চালে হতো পায়েস রান্নাঘরে-ঘরে চলত পিঠা-পুলির আয়োজনআত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ করা হতোএখনো গ্রামে এ ধরনের নানা আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতা চোখে পড়ে

তবে বর্তমান বাংলাদেশে শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে মোটামুটি সারাবছরই কম-বেশি ফসল হয়বছরজুড়ে নানা ফসল ফলান কৃষকরাএমনকি যে কার্তিককে মরা কার্তিকবলা হতো সে মাসেই হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ

বাইরের জেলাগুলো থেকে পাওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় জোরেসোরে চলছে আগাম আমন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজবর্ষার শেষদিকে আউশ আমন বোনা হয়েছিলবর্তমানে আমন ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যস্ত কৃষক কৃষাণীওস্তাদ মোমতাজ আলী খানের একটি গানের কথা মনে পড়ে গেল, যেখানে তিনি বলছেন, চাষির বউ সকাল বেলায়/বাঁশের ঝাড়ের ছায়ায়/ধান ঝারে আর ধান উড়ায়/ঝির ঝির ঝির হাওয়ায়/সেই বউয়ের হাতের রেশমি চুড়ি/রুনু ঝুনা বাজে/ সেই না সুরে চাষির মন আর/যেতে চায় না কাজে...।       

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, নবান্নের সময়টাতে দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ফসল উপাদন হয়প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন আমন উপাদন হয় এ সময়প্রচুর ফসল ঘরে তোলার আনন্দ প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ওপ্রকৃতির দানের কথা স্বীকার করে নিয়ে কবিগুরু লিখেছেন, ‘ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।/দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে

গ্রামের মতো শহরেও, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় প্রতি বছর জাতীয়ভাবে নবান্ন উসবের আয়োজন করা হয়লোকগান নাচ আবৃত্তিসহ নানা পরিবেশনায় শিল্পীরা কৃষিনির্ভর জীবন ও সংস্কৃতির জয়গান করেনশেকড়ের সংস্কৃতি তুলে ধরা হয় নাগরিক মঞ্চ থেকে

থাকে পিঠাপুলির আয়োজনওঅগ্রহায়ণের প্রথম দিন ঢাকার চারুকলায় বা শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে নবান্ন উসব আয়োজন করা হয়নবান্ন উসব উদ্যাপন পর্ষদের আয়োজনে আগ্রহ নিয়ে যোগ দেন বিভিন্ন বয়সী মানুষআয়োজকদের মতে, গ্রামে ফিরে যাওয়ার আকুতি থেকেই নগরে নবান্ন উসব আয়োজন করা হয়গ্রামীণ ঐতিহ্যের উসব নিজেকে চিনতে সহায়তা করেএসব কারণেই ঘটা করে নবান্ন উসব আয়োজন করা হয়তবে এবার দেশের পরিস্থিতি একটু ভিন্নফলে রাজধানী শহরের আয়োজনটি অব্যাহত রাখা যাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছেগ্রামে হবে ঠিকইকারণ গ্রামের ঘরে-ঘরে চলে নবান্ন উসবনতুন ধান থেকে চাল, চাল থেকে মায়ের হাতের বানানো পিঠা! সন্তান না খেয়ে পারে? পিঠার পাশাপাশি পায়েস ফিন্নি ইত্যাদিও হবে যথারীতিঅবশ্য তারও আগে রাজধানী শহরের অলিগলি ফুটপাতে চুলো বসে গেছেসেখানে তৈরি হচ্ছে পিঠানাগরিকরা এরই মাঝে ভাঁপা চিতই তেলের পিঠার স্বাদ নিতে শুরু করেছেনপিঠা খেতে খেতে কল্পনায় গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন তারানবান্ন উসবের কথা মনে করছেনএই যে মনে করা, এই যে পেছন ফিরে তাকানো, এটাই তো বাঙালির শক্তি! এই শক্তি রুখে দেওয়ার সাধ্য আছে কার

×