ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

লজ্জাবতী ঘিরে  রহস্য অপার

গাছও রোমান্টিক হয় লজ্জায় মরে, নাকি অন্য কিছু?

মোরসালিন মিজান 

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ১২ নভেম্বর ২০২৪

গাছও রোমান্টিক হয় লজ্জায় মরে, নাকি অন্য কিছু?

.

লজ্জার মাথা দিব্যি গিলে খাচ্ছে মানুষ। অনেকেই এখন আর লজ্জা-শরম নিয়ে ভাবতে চান না। তবে একটি গাছ আছে, যেটি আচার-আচরণে খুবই লাজুক। এই গাছের পাতায় আঙুল দিয়ে সামান্য স্পর্শ করলেই হলো, লজ্জায় সে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে। নাম তাই লজ্জাবতী। জগদীশ বাবু বহুকাল আগে নিশ্চিত করেছিলেন যে, গাছের প্রাণ আছে। লজ্জাও আছে কি না, তা নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। না হোক, লজ্জাবতীকে লাজুক লতা হিসেবেই জানে বাংলাদেশের মানুষ। কবিগুরু লিখেছিলেন: নাই কি রে তীর, নাই কি রে তোর তরী?/কেবলি কি ঢেউ আছে তোর?/হায় রে লাজে মরি...। প্রতিনিয়ত লাজে মরে লজ্জাবতী।   
গাছটির ইংরেজি নাম ‘মিমোশা’। বাঙালির চোখে দেখলে ‘মিমোশা’ তো মেয়েদেরই নাম। মেয়েরা যেমন অপেক্ষাকৃত লাজুক হয়, লজ্জাবতী গাছও তা-ই। নতুন বউয়ের সঙ্গে গাছটির বেশ মিল। বউয়েরা শ্বশুর-শাশুড়ি, এমনকি, বরের সামনেও লজ্জাটা ধরে রাখতে চান। প্রকৃতিপ্রেমীরা সেই বউয়ের সঙ্গে মিল খুঁজে পান লজ্জাবতীর। লজ্জাবতীকে রোমান্টিক ভাবতেও পছন্দ করেন তারা।     
লতাগুল্ম জাতীয় গাছের পাতা চিরুনির মতো। যৌগিক। দুই সারি পত্রক বিদ্যমান। সবুজ পাতার মাঝে আবার গোলাপি রঙের ফুল ফুটে থাকে। ছোট গোলাকার ফুল দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। পাতা বা ফুল যেখানেই স্পর্শ করা হোক না কেন, তৎক্ষণাৎ এটি প্রতিক্রিয়া দেখায়। বৃষ্টি শেষে ছাতা গুটিয়ে রাখি না আমরা? অনেকটা সেভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। দায়ে কাটা পড়া লতাপাতার মতো নিথর হয়ে মাটির ওপর শুয়ে পড়ে। প্রাণবন্ত অবস্থা থেকে এমন নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি বেশ উপভোগ করে মানুষ। বারবার ছুঁয়ে দিয়ে ম্যাজিক দেখার আনন্দ পায়। আর বাচ্চারা তো রীতিমতো উত্ত্যক্ত করে!  
কিন্তু এই একটি গাছের কেন এত লজ্জা? লজ্জা? রোমান্টিকতা?  নাকি অন্য কিছু? রহস্য খোলাসা করে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক পরিমল কান্তি বিশ্বাস বলছেন, এইসবের কিছুই গাছটির বেলায় সত্য নয়। লজ্জাবতী গাছের পাতার গোড়ার অংশের কোষগুলো পানিতে পূর্ণ থাকে। এ কারণে সেগুলো বেশ ফোলা দেখায়। কিন্তু ডাটাগুলো হয় সরল ও সোজা। আঙুল দিয়ে পাতা সামান্য ছুঁয়ে দিলে গাছের পুরো শরীরে মৃদু তড়িৎ প্রবাহ ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রভাবে পাতার গোড়ার ফোলা অংশ থেকে পানি বেরিয়ে বোঁটার দিকে নেমে যায়। আর পাতার কোষগুলোর জলের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে তা কুঁচকে আসে। নুয়ে পড়ে। তাপের প্রভাবে ও সন্ধ্যার পর আপনি নিজেকে গুটিয়ে নেয় লজ্জাবতী। 
অর্থাৎ, লজ্জাবতী একটি বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের গাছ। আজকের বাংলাদেশে মানুষের লজ্জিত হওয়ার অনেক কারণ আছে বটে। গাছের বেলায় এই প্রশ্ন অবান্তর। তাই লজ্জাবতীকে রোমান্টিক না ভেবে, লাজুক না ভেবে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের গাছ হিসেবেই দেখতে হবে। 
গবেষণা বলছে, লজ্জাবতী প্রায় ৪শ’ প্রজাতির গুল্ম ও লতার একটি গণ (জেনাস)। এটি লেগিউম জাতীয় ফ্যাবায়েসি পরিবারের এবং মিমোসয়ডিয়া উপ-পরিবারের সদস্য উদ্ভিদ। সবচেয়ে পরিচিত প্রজাতিটির নাম মিমোসা পুডিয়া। আদি নিবাস মধ্য আমেরিকা। বাংলাদেশেরও খুব পরিচিত লতা। প্রায় সকল লজ্জাবতীর কা- সরু কাঠির মতো। অনেক শাখা-প্রশাখা। শীতের এই কালে সুন্দর ফুলও ফুটে আছে। জঙ্গলে ফুটে থাকা গোলাপি এবং সাদা রঙের ফুলের সৌন্দর্য দারুণ উপভোগ্য। লজ্জায় ডুবে থাকা গাছের প্রাণ বড় শক্ত। আগাছার মতো হওয়ায় অনেকে একে পায়ে মাড়িয়ে যান। কিন্তু গাছটি সহজে মরে না। বরং নিশ্চিহ্ন অবস্থা থেকেও যৌবনে ফিরতে জানে। একইভাবে অনেক প্রতিকূল পরিবেশে এটি জন্মাতে পারে। কোনো রোগ বা পোকা একে কাবু করতে পারে না। 
উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার গবেষণা মতে, দেশে লজ্জাবতীর দুটি জাত রয়েছে। একটি দেশীয়। অন্যটি থাই লজ্জাবতী। দেশীয় লজ্জাবতীর বৃদ্ধি কম। এটি ৩ থেকে ৭ ফুট লম্বা হয়। গায়ে সূক্ষ্ম কাঁটার অস্তিত্ব দেখা যায়। অন্যদিকে থাই লজ্জাবতী গাছে কোনো কাঁটা হয় না। এটি দ্রুত বাড়ে। গাছ প্রায় ৩-১০ ফুট লম্বা হয়। গাছ নরম ও রসাল বলে দ্রুত পচে যায়। ফলে এ জাতীয় লজ্জাবতী জৈব সারের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।  
তাই বলে শুধু উদ্ভিদ বা কৃষি বিজ্ঞান দিয়েই লজ্জাবতীকে বিচার করতে হবে, না, সেটি বোধহয় ঠিক হবে না। বরং লজ্জাবতীর সঙ্গে মানুষের যে ছোঁয়াছুঁয়ির সম্পর্ক, সেটি অটুট থাকুক। আরও রোমান্টিক হোক এই সম্পর্ক।
 

×