ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১

এশিয়ার খ্যাতনামা পর্যটন কেন্দ্র

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার নিঝুম দ্বীপ ও মুছাপুর ক্লোজার

গিয়াস উদ্দিন ফরহাদ

প্রকাশিত: ২২:২৬, ৮ নভেম্বর ২০২৪

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার  নিঝুম দ্বীপ ও মুছাপুর  ক্লোজার

নিঝুম দ্বীপের একাংশ

চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রসিদ্ধ প্রাচীন জেলা নোয়াখালী। ঢাকা থেকে মাত্র ১৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জেলার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। প্রাকৃতিক সম্পদ ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই জেলা। জেলার পর্যটন সম্পদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নিঝুম দ্বীপ, জাতীয় উদ্যান ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, মুছাপুর ক্লোজার, স্বর্ণ দ্বীপসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

৪০ বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি নিঝুম দ্বীপ। নোয়াখালীর দক্ষিণে মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত হাতিয়া উপজেলার সর্বদক্ষিণে এই দ্বীপের অবস্থান। চর ওসমান, বাউল্লারচর, কামলারচর মৌলভিরচর- এই চার চর নিয়ে নিঝুম দ্বীপ।

বঙ্গোপসাগরের বুকে ১৯৪০ সাল থেকে দ্বীপটি জেগে ওঠা শুরু করে। ১৯৭৩ সালে দ্বীপটিতে বসতি স্থাপন শুরু হয়েছিল। একদম শুরুর দিকে দ্বীপটির নাম ছিল চর ওসমান বাউল্লারচর। লোকমুখে শোনা যায়, এখানে বসতি গড়া প্রথম মানুষটির নাম ওসমান। তিনি ছিলেন একজন বাথানিয়া; আর তখন তার নামানুসারেই দ্বীপের নামকরণ করা হয়েছিল। শুধু সৈকতই নয়, দ্বীপের মাটিও বালুতে চিকচিক করত। দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে দেখা যেত বালুর ঢিবি বা টিলার মতো জায়গা। কেওড়া গাছপালা পরিবেষ্টিত দ্বীপটিতে ১৯৭৮ সালের দিকে প্রাণিবৈচিত্র্য বৃদ্ধির জন্য চার জোড়া চিত্রা হরিণ উন্মুক্ত করা হয়েছিল। বর্তমানে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কয়েক হাজারে। এছাড়া, এই দ্বীপে কক্সবাজারের মতোই সমুদ্র সৈকত সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের মতো সৌন্দর্য একইসঙ্গে উপভোগ করা যায়। পাশাপাশি বিস্তীর্ণ সৈকতে দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যায় সূর্যোদয় সূর্যাস্ত।

দ্বীপটির বিশেষত্ব হচ্ছে চিত্রা হরিণ শীতকালের অতিথি পাখি। একসঙ্গে এতো চিত্রা হরিণ দেশের আর কোথাও দেখা যায় না। সন্ধ্যা নামতেই শেয়ালের ডাক রোমাঞ্চের ঢেউ তোলে। ভোরের আভায় দেখা মেলে পাখি, হরিণের। নিঝুম দ্বীপ থেকে সামান্য দূরের পথে দেখা মিলবে ভোলার ঢালচর আর চরকুকরি-মুকরির। দ্বীপের সৌন্দর্যে আপাদমস্তক অবগাহন করার শ্রেষ্ঠ সময় শীত বসন্তকাল। সময় রাস্তাঘাট শুকনো থাকায় আশপাশের যে কোনো জায়গায় যাওয়া যায়। হরিণ দেখতে বনের পথে হাঁটতে সুবিধা হয়।

শীতে নিঝুম দ্বীপ মানেই ক্যাম্পিং। ক্যাম্পিংয়ের জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা নামার বাজার। রিসোর্টের পাশের খাল পেরিয়ে সৈকতের কাছে ছয় মাইলের বিশাল খোলা মাঠটি ক্যাম্পিংয়ের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ। জাহাজমারা বাজারে ক্যাম্পিংয়ের প্রায় সব অনুষঙ্গই পাওয়া যায়। এছাড়া জাতীয় উদ্যান এলাকায়ও তাবু ভাড়া পাওয়া যায়। তাই এখানে যাত্রাকালে সঙ্গে তেমন কিছু নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। পেটপূর্তির জন্য নামার বাজারে খাবারের হোটেলগুলো সামুদ্রিক মাছ এবং চিংড়ির পরিবেশন থাকে। আগে থেকে অর্ডার করে রাখলে তুলনামূলক ভালো খাবার পাওয়া যায়। যাত্রা শুরুর আগে অবশ্যই সেখানকার আবহাওয়ার ব্যাপারে জেনে নিতে হবে। নিঝুম দ্বীপে

বিদ্যুতের জন্য জেনারেটর সোলারের ওপর নির্ভরশীল সবাই। তাই যাত্রা মুহূর্তে ব্যাগ গোছানোর সময় শীতের পরিমিত কাপড় ফাস্ট এইডের পাশাপাশি মোবাইল চার্জার, ক্যামেরা মোবাইলের জন্য অতিরিক্ত ব্যাটারি, পাওয়ার ব্যাংক টর্চের কথা মনে রাখতে হবে।

ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে লঞ্চে ভ্রমণ। সদরঘাট থেকে প্রতিদিন বিকেল সাড়ে ৫টায় একটি লঞ্চ হাতিয়ায় তমরুদ্দী ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। গন্তব্যে পৌঁছতে পরদিন সকাল ৯টা বাজতে পারে। তমরুদ্দী ঘাট থেকে ঢাকার ফিরতি লঞ্চ ছাড়ে দুপুর সাড়ে ১২টায়। লঞ্চের ডেকে, সিঙ্গেল কেবিন ডাবল কেবিনে ভাড়া পড়বে যথাক্রমে ৩৫০ টাকা, এক হাজার ২০০ টাকা দুই হাজার ২০০ টাকা। তমরুদ্দী ঘাট থেকে মোটরসাইকেলে মোক্তারিয়া ঘাটে পৌঁছা যায়। বাকি পথটা একইভাবে পাড়ি দিতে হয়।

তবে, তমরুদ্দী ঘাট থেকে সরাসরি নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার পর্যন্ত জলপথটা পাড়ি দেওয়ার আরেকটি উপায় আছে। তমরুদ্দী ঘাট থেকে কিছু মাছ ধরার ট্রলার সরাসরি নামার বাজার যায়। এগুলোতে উঠতে হলে সকাল ১০টার আগেই ঘাটে উপস্থিত থাকতে হয়। জনপ্রতি ভাড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এছাড়া এখান থেকে ট্রলার রিজার্ভ করেও সরাসরি নামার বাজার যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সেক্ষেত্রে তিন হাজার ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া লাগতে পারে।

নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা নামার বাজার সৈকতের কাছেই ভালো মানের কয়েকটি রিসোর্ট আছে। জনপ্রতি এক হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা খরচে বিভিন্ন ক্যাটাগরির রুম পাওয়া যায়।

নোয়াখালীতে পর্যটনের উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে জেলা ব্রান্ডিং এর আওতায় নোয়াখালীকেনিঝুম দ্বীপের দেশনামে ব্রান্ডিং করার কাজ চলছে। নিঝুম দ্বীপের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন স্থানীয় প্রশাসন কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। একে ঘিরে এশিয়ার খ্যাতনামা পর্যটনের হাতছানি রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। পর্যটন সমৃদ্ধ স্থানগুলো নিয়ে বাস্তবমুখী, দীর্ঘমেয়াদি সুচিন্তিত পরিকল্পনার মাধ্যমে নোয়াখালী অঞ্চলকে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করে পর্যটন শিল্প বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।

সম্ভাবনাময় মুছাপুর ক্লোজার নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ সীমানায় বঙ্গোপসাগরের একেবারে কোল ঘেঁষে মুছাপুর ক্লোজার ছোট ফেনী নদী। সবুজ প্রকৃতি, বন্যপ্রাণি, পাখির কলকাকলি, বাগান, নদীর মাঝে ক্লোজার, সাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশিতে জোয়ারের পানি উথলে এক নয়নাভিরাম সৌন্দর্য বিকশিত হয় মুছাপুর ক্লোজারের ছোট ফেনী নদীতে। পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং তিন কিলোমিটার প্রস্থের সৈকতে যেকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় সূর্যাস্ত দেখা যায়।

মুছাপুর ক্লোজার এলাকায় চরের মধ্যে দক্ষিণ মুছাপুর মৌজায় ৮২১ দশমিক ৫৭ একর, চরবালুয়া (দিয়ারা) মৌজায় হাজার ৮৬১ দশমিক ১০ একর চরবালুয়া মৌজায় ৬শদশমিক ১৫ একর সর্বমোট হাজার ২৮২ দশমিক ৮২ একর বনবিভাগের জমিজুড়ে মনোরম বনাঞ্চল রয়েছে। এর মধ্যে মুছাপুর ফরেস্টটি অন্যতম। এখানে রয়েছে ঝাউ, কেওড়া, পিটালী, খেজুর, লতাবল, গেওয়া, শনবলই, বাবুলনাটাই, আকাশমনিসহ বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান গাছ। রয়েছে ঘুঘুসহ বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির পাখির অভয়স্থল। রয়েছে শিয়াল, বন বিড়াল, সাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির পশু পাখি। বনের ভেতরে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট একখণ্ড শীতল ছায়া বিশিষ্ট মাঠ। ইচ্ছে করলে এখানে একটু জিরিয়ে নেওয়া যায়। পাশেই বিশাল সৈকত।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে মুছাপুর ক্লোজারকে সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হলে একদিকে সরকারের রাজস্ব আয়ের খাত তৈরি হবে, পাশাপাশি দেশী-বিদেশী ভ্রমণপিপাসুদের জন্য হতে পারে মনোরম অবকাশ কেন্দ্র।

×