গাঢ় নীল রঙের ফুল নীলকণ্ঠ
খুব চেনা একটি ফুলের কথা হোক আজ। চেনা ফুল। প্রিয় ফুলও বটে। অনেকের শখের বাগানে বা বাসার বারান্দায় নিশ্চিতভাবেই দেখা যায়। অন্য ফুল থেকে এটি আলাদা। বিশেষ করে পাপড়ির গঠন এবং বিন্যাস একেবারেই স্বতন্ত্র। লম্বাটে ধরনের একটি বড় পাপড়ি এই ফুলের মূল অবয়ব স্পষ্ট করে। গাঢ় নীল রঙের আকর্ষণীয় ফুল নীলকণ্ঠ নামে পরিচিত।
বলা হয়ে থাকে বেদনার রং নীল। নীলকণ্ঠ ফুল যেন সেই বেদনাকেই ধারণ করে আছে। পৌরাণিক গল্পগাথা থেকে একটি উদাহরণ টানা যায়। সেই গল্প অনুযায়ী, দেবতা শিবের আরেক নাম নীলকণ্ঠ। সমুদ্র মন্থনে উঠে আসা ভয়ানক বিষপান করেছিলেন তিনি। সৃষ্টি রক্ষায় তার এমন সিদ্ধান্ত। বিষের জ্বালায় শিবের গলা নীলবর্ণ ধারণ করেছিল। নীলকণ্ঠ ফুল যেন পৌরাণিক কাহিনীর সেই বিষ ব্যথার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
অবশ্য ফুলটি অপরাজিতা নামে সমধিক পরিচিত। এ নামেই বেশি ডাকা হয়। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, ফুল বা গাছের আবার জয়-পরাজয় কী? জবাবে বলি, অপরাজিতা ফুলের গাছ নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে তবেই নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। বাধা-বিপত্তি যতই আসুক, বহু বছর বাঁচে। এর বেঁচে থাকা বৃদ্ধি কেউ তেমন ঠেকাতে পারে না। এ কারণেই ফুলটির নাম অপরাজিতা। নীল ছাড়াও সাদা রঙের অপরাজিতা বেশ দেখা যায়। মিষ্টি ঘ্রাণ না থাকলেও পাপড়ির সৌন্দর্য মুগ্ধ করে রাখে।
মোটামুটি সারাদেশেই হয় অপরাজিতা। লতাপাতার ঝোপ থেকে ফুল উঁকি দেয়। দেখতে অনেকটা মেয়েদের কানের দুলের মতো। কোথাও নিঃসঙ্গ একাকী। কোথাও কাছাকাছি দূরত্বে দুটি ফুল। নীল ফুলের ওপর কড়া রোদ এসে পড়তেই রংটা বেগুনি মনে হয়। মনে হয়, রং গলে গলে পড়ছে। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা অনুযায়ী, নীলকণ্ঠ ফ্যাবাসিয়াই প্রজাতির ফুল। বৈজ্ঞানিক নাম ক্লিটোরিয়া টারনেটিকা। যৌগ এবং বিজোড়পত্রী। একটি পাপড়ি বড়। প্রায় ৪ সেমি লম্বা। অন্যগুলো ছোট পুঁটলির মতো।
পৌরাণিক কাহিনী বলছে, অপরাজিতার লতা বা শেকড় হাতে বেঁধে নিতে পারলে পরাজয় ধারে-কাছে আসতে পারবে না! উদাহরণও আছে। বলা হয়ে থাকে, দেবরাজ ইন্দ্র অসুর দমনের লক্ষ্যে স্বীয় হস্তে অপরাজিতা ধারণ করেছিলেন। অপরাজিতার ভেষজ গুণও ঢের। তার চেয়ে বড় কথা পাপড়ি দিয়ে চমৎকার চা হয়। গরম পানিতে কয়েকটি পাপড়ি ছেড়ে দিলেই হলো। পানিটা নীল হয়ে যায়। স্বচ্ছ কাপে নীল রঙের চা দেখতেও অদ্ভুত হয়। স্বাদটাও বেশ। তাই বলে চা পানের নামে সব ফুল ধ্বংস করতে যাবেন না যেন! বরং বাঁচিয়ে রাখুন। ফুল ফুটতে দিন। আমাদের অব্যক্ত বেদনাগুলোকে এভাবেই ধারণ করে থাকে নীলকণ্ঠ।
কবি আবু হাসান শাহরিয়ার অবশ্য নিজেই নীলকণ্ঠ হতে চেয়েছিলেন। সেই ইচ্ছের কথা জানিয়ে কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, ‘নীলকণ্ঠ হব বলে বসে আছি বিষপাত্র নিয়ে/আমার পার্বতী এক বিষাদ-বংশোদ্ভূত বিষ।’ এই বিষ কবি বলেই হয়তো হজম করতে পেরেছেন। আপনি কি সাধারণ ফুলপ্রেমী? তাহলে ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো। নীলকণ্ঠের কাছেই জমা রাখুন নিজের ছোট-বড় সব কষ্ট।