কার্তিকে ভরা ফসলের মাঠ
কার্তিক মাস এখন। একটু একটু করে শিশির ঝরছে। প্রকৃতি ঢাকতে শুরু করেছে কুয়াশার চাদরে। রোদের সেই তীব্রতা নেই। বিকেলটা আগের তুলনায় অনেক বেশি স্নিগ্ধ। শীতল বাতাস এসে গায়ে লাগছে। এসব পরিবর্তন ঘটানোর পাশাপাশি কার্তিক পরিচিত ফসলের মাস হিসেবে। ফসলের ঋতু হেমন্তের প্রথম প্রতিনিধি কার্তিক। বাংলা সনের সপ্তম মাসে ক্ষেতভর্তি হয়ে থাকে সোনার ধানে। এই ধানের নিবিড় পরিচর্যা করে কার্তিক। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। একই মাসে আরও অনেক ফসলের আবাদ করা হচ্ছে। বিবিধ ফসলের কারণে ঘুচে গেছে সেই ‘মরা কার্তিক’ অপবাদ।
হ্যাঁ, কিছুকাল আগেও কার্তিক ছিল অনটনের মাস। এ সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিত। চাল থাকত না ঘরে। ধানের গোলা শূন্য হয়ে যেত। সাধারণ কৃষকেরা ঠিকমতো খেতে পারতেন না। অনটনের কারণে গ্রামীণ জীবনের নানা সংকট দেখা দিত। মাসটির দুর্নাম করে তাই বলা হতো ‘মরা কার্তিক’। রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও দুর্দিনের উল্লেখ পাওয়া যায়। কবিগুরু লিখেছেন- শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান,/কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে।
কিন্তু বর্তমানে কার্তিক আর মরা কার্তিক হয়ে নেই। ফসলে যথেষ্টই সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। শস্যের বহুমুখীকরণের কারণে মোটামুটি সারাবছরই কম বেশি ফসল উৎপন্ন হয়। ব্যস্ত থাকতে হয় কৃষককে। বছরজুড়ে নানা ফসল ফলান তারা। আয় রোজগারও ভালো। এবারও ভাদ্র-আশ্বিনে আমন ধান লাগানো হয়েছিল। বর্তমানে ক্ষেতভর্তি সোনার ধানে। বিস্তীর্ণ ফসলের মাঝে সবুজ ধানের শীষ দোল খাচ্ছে।
পাশাপাশি এখন কার্তিক মাসেই হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আউশ এবং আগাম আমন ধান। পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। ঠিক এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আগাম আমন ধান কাটা হচ্ছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল থেকে ফসল কাটা ও মাড়াইয়ের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। রাজশাহী রংপুর বগুড়া নীলফামারীসহ বিভিন্ন জেলার কৃষকরা ব্যস্ত সময় পাড় করছেন এখন। দিনভর চলছে ধান কাটা। কোথাও কোথাও কাস্তে হাতে ধান কাটছেন কৃষক। কোথাও বা কাজ হচ্ছে যন্ত্রে। কিষানিরাও কাজ করছেন মাঠে। বিশেষ করে ধান মাড়াই, শুকিয়ে ঘরে তোলার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় খুশি মনেই অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে তাদের।
পরের মাস অগ্রহায়ণে সারা বাংলায় হবে নবান্ন উৎসব। বাঙালির প্রধান ও প্রাচীনতম উৎসবগুলোর অন্যতম নবান্ন। এ সময় আমন ধান কাটা হবে। আর এই কাটার শুরুটা হয় কার্তিক থেকেই। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, নবান্নের সময়টাতে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসল উৎপাদিত হয়। প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন আমন উৎপাদন হয় এ সময়, যেখানে কার্তিকের অবদান অনস্বীকার্য।
তবে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, এবার বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় আমন চাষ ব্যাহত হয়েছে। প্রথমবারের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় দ্বিতীয়বার চাষ করতে হয়েছে তাদের। এ আমন ঘরে তুলতে একটু দেরি হবে।
এদিকে, ধান পেতে একটু দেরি হলেও এখন আর তেমন সমস্যা হবে না। কার্তিক মাসে বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ হচ্ছে। আলু পেঁয়াজের বিপুল চাহিদা। সেই চাহিদা পূরণে ব্যাপকভাবে কাজ করছেন কৃষক। ফলে আগের মতো বেকার থাকার সুযোগ নেই। বরং কৃষি জমিতে কাজ করার মতো শ্রমিক খুঁজে পাওয়া মুশিকল হয়ে গেছে। সবজির বাণিজ্যিক আবাদ বদলে দিচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্র। কার্তিক মাস ঘিরে তাই নতুন স্বপ্ন বুনেন এখন কৃষক। বিচিত্র আবাদে হারিয়ে গেছে মরা কার্তিক। ফসলের ঋতু হেমন্তের প্রথম মাসটিকে তাই সমৃদ্ধি হিসেবেই দেখা হচ্ছে।