রাজধানীর একটি বাসার বাগানে থোকা থোকা কামিনী
কিছু ফুলের ঘ্রাণ এত মিষ্টি যে, নাকে এসে লাগলে বাতাসটাকেও মিষ্টি মনে হয়। এই যেমন কামিনী। ফুলটির ঘ্রাণ মন ভালো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তীব্রগন্ধী নয়। মিষ্টি ঘ্রাণ বলতে সত্যিকার অর্থে যা বোঝায় কামিনীর ঘ্রাণ ঠিক তেমন। বিভিন্ন সময়ে ফোটে বলে ঘ্রাণ নেওয়ার সুযোগটা বেশি পাওয়া যায়। এই মুহূর্তেও কামিনী ফুলে গাছ ভর্তি হয়ে আছে।
আমার নিজের পরিচিত একটি বাসার কথা বলতে পারি। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় উঁচু অট্টালিকা। সেই অট্টালিকার সামনে একটিমাত্র গাছ লাগানো হয়েছিল। এখন এই গাছ দ্বিতীয় তলার বারান্দা পর্যন্ত ছুঁয়ে আছে। গাছ ভর্তি ফুল। নিচতলার বাসিন্দারা গাছ লাগিয়ে ফুলের ঘ্রাণ নিচ্ছেন বটে। উপরের ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সঙ্গে গাছের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু রাতে কামিনীর ঘ্রাণ নিতে নিতেই ঘুমোতে যাচ্ছেন তারা। কী দারুণ না ব্যাপারটা ? অবশ্য ছোট পরিসরেও কামিনী অনেক হয়। চাইলে আপনিও একটা কামিনীর চারা কিনে এনে টবে পুঁতে দিতে পারেন। বনসাইও খুব ভালো হয় কামিনী গাছে। এখন অনেকের বনসাই গাছে শুভ্র সুন্দর কামিনী ফুটে আছে।
কামিনী গাছের পাতা খুব ছোট এবং ঘন। ফুল ফোটে আরও ঘন হয়ে। একসঙ্গে এত ফুল ফুটছে যে, গাছটাকেই সাদা মনে হয়। একদিকে ফুল ফুটতে থাকে। অন্যদিকে আগে ফোটা ফুল থেকে দুর্বল পাপড়ি খসে পড়তে থাকে। হালকা বাতাসে তো ঝরে পড়েই। পাশাপাশি অসংখ্য মৌমাছি কামিনীর ফুল থেকে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে। ওদের ওড়াওড়ির কারণেও ফুলের পাপড়ি ভেঙে নিচে পড়ে যায়।
এ কারণেই হয়ত রবীন্দ্রনাথ কামিনীকে অতি ‘কোমল কুসুম’ বলে উল্লেখ করেছে। লিখেছেন, ‘জান ত কামিনী সতী কোমল কুসুম অতি/দূর হ’তে দেখিবারে, ছুঁইবারে নহে সে-/দূর হ’তে মৃদু বায়, গন্ধ তার দিয়ে যায়/কাছে গেলে মানুষের শ্বাস নাহি সহে সে।’ পরের অংশে তিনি লিখেছেন, ‘কামিনীকুসুম ছিল বন আলো করিয়াÑ/মানুষপরশ-ভরে শিহরিয়া সকাতরে/ওই যে শতধা হয়ে পড়িল গো ঝরিয়া।’
কামিনীর বৈজ্ঞানিক নাম ম্যুরায়া প্যানিকুলাটা। আদি নিবাস বাংলা-ভারতের উষ্ণ অঞ্চল, মালয়, চীন ও অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশে বহুকাল ধরে আছে। গুল্ম জাতীয় গাছ। গাছ ওপরের দিকে তেমন বাড়ে না। লম্বায় তিন থেকে পাঁচ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। দেখতে ঝোপের মতো অনেকটা। ঘন সবুজ পাতার ফাঁকে সাদা সুন্দর ফুল যেন হাসি হয়ে ফোটে।
উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা অনুযায়ী, কামিনী চিরসবুজ ক্ষুদ্র বৃক্ষ। এর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা। ঠাসবুনন। এটি লেবু গোত্রীয়। গোষ্ঠীবৈশিষ্ট্যে পাতাও ফুলের অংশবিশেষ। ফুলের পাঁচ থেকে সাতটি পত্রিকা। মাঝে হলুদ দেখতে একটি পরাগকেশর। ফুলগুলো সবুজ পাতার মাঝে মঞ্জরিবদ্ধ হয়ে ফুটে থাকে।
কামিনীর পাতার সৌন্দর্যও উল্লেখ করার মতো। ছোট ছোট পাতা। ঘন বিন্যস্ত। সবুজ এই পাতা বিয়ের গাড়ি, বাসরঘর সাজাতে ব্যবহার করে দোকানিরা। অন্য ফুলের তোড়া সাজাতেও কামিনীর পাতা ব্যবহার করা হয়। কামিনী থেকে কলম করে কেটে-ছেঁটে নানা আকৃতি তৈরি করা যায়। একই কারণে এ গাছে ভালো বনসাই হয়। কামিনীর এক ধরনের ফলও হয়। গোলাকার রক্তিম ফল পাখির বিশেষ করে বুলবুলির প্রিয় খাদ্য। ঔষধি গুণও আছে।
গাছটি থেকে তৈরি ওষুধ শরীরের জ্বর সারাতে ব্যবহার করা হয়। ব্যথানাশক হিসেবেও কাজ করে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে, কামিনী গাছে আছে রাসায়নিক উপাদানও। অবশ্য এসব তথ্য জেনে ফুলপ্রেমীদের কাজ নেই। বরং আসুন প্রিয় ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করি। ঘ্রাণ নিয়ে সতেজ হই। শুভ্র কামিনীর মিষ্টি ঘ্রাণ দুঃখ ভুলিয়ে জীবনে ফেরাক আমাদের।