নীলফামারী ও রংপুরের গ্রামে গ্রামে নারীদের হাতে তৈরি নানা কারুপণ্য
পল্লী গাঁয়ের বাড়ির উঠানে, কেউ বারান্দায় কেউবা বাড়ির সামনের খোলা স্থানে জোট বেঁধে বসে কারুপণ্য তৈরিতে ব্যস্ত সময় পাড় করছে। সংসারের কাজ কিংবা লিখাপড়ার পাশাপাশি এমন আয় রোজগারে কাজে নেমেছে তারা। শীতের আমেজে মিষ্টি রোদ্রের তালে তালে তাদের উৎপন্ন এগিয়ে যাচ্ছে। বাহের দ্যাশের উত্তরাঞ্চলের পায়রাবন্দের নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। এ অঞ্চলের পল্লীগায়ের বৃদ্ধা থেকে গৃহবধূ এবং স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা বেগম রোকেয়ার জাগরণের অগ্রদূত হিসাবে নিজেদের স্বাবলম্বী করতে গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে হাতে তৈরি কারুপণ্য তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন। রংপুরের মিঠাপুকুর, নীলফামারীর খোকশাবাড়ি ও গোড়গ্রামে নারীদের নীরব এই কর্মচাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের হস্তশিল্পে হোগলাপাতা ও জলপাতার সঙ্গে যুক্ত হয় পাটের আঁশ। বানানো হয় মোটা শক্ত রশি। সেই রশিতে সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই কারুশিল্পের কাজ করার সুযোগ থাকায় গ্রামের অধিকাংশ নারী ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের সঙ্গে নিজেদের স¤পৃক্ত করে আজ স্বাবলম্বী। তাদের হাতে তৈরি পণ্য ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্তত ২৮টি দেশে যাচ্ছে।
রংপুর শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দক্ষিণে মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ ইউনিয়ন। পায়রাবন্দ বাজারের লাগোয়া খোর্দ্দমুরাদপুর গ্রামে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র। সেখানে বেগম রোকেয়ার ভাস্কর্য ও একটি পাঠাগার আছে। দক্ষিণ পাশের রাস্তা পার হলেই দেবীপুর গ্রাম। নারীদের তৈরি এসব কারুপণ্য দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে, বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। নারীদের নীরব এই কর্মচাঞ্চল্য নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার পায়রাবন্দে চার বছর ধরে নারীদের বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন যিনি, তার নাম রেজাউল করিম (৪৪)।
দেড় লাখ টাকায় জমি বন্ধক রেখে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে নারীদের বোঝালেন। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাদের কারুপণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ দিলেন। প্রশিক্ষণ পাওয়া নারীদের দিয়েই শুরু করলেন আরকে হ্যান্ডিক্র্যাফটসের যাত্রা। এই কারখানা থেকে এখন রাজধানীর দুটি, রংপুরের একটি প্রতিষ্ঠানে পণ্য সরবরাহ করা হয়। এই তিন প্রতিষ্ঠানের চাহিদামতো পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়, জানালেন রেজাউল। প্রতি মাসে তিন প্রতিষ্ঠানে ১৫ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করা হয়। সেই হিসাবে, বছরে পৌনে দুই কোটি টাকার কারুপণ্য বিক্রি হচ্ছে এই পায়রাবন্দ থেকেই। চাহিদা থাকায় বিক্রি আরও বেড়েছে। রেজাউল বলেন, বিনা মূল্যে নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তারা কেউ বাড়িতে, কেউ কারখানায় এসে কাজ করেন। এভাবে আরও অনেকে এগিয়ে এলে এই গ্রাম একদিন আরও আলোকিত হয়ে উঠবে। খোর্দ্দমুরাদপুর ও দেবীপুর ছাড়াও কারখানাটিতে ইসলামপুর ও জয়রামপুর গ্রামের নারীরা কাজ করেন। প্রায় ১০ শতাংশ জমির ওপর একটি টিনশেডের কারখানায় নারীরা কাজ করছেন। কেউ তৈরি করছেন ল্যা¤পশেড, কেউবা রান্নাঘরের ঝুড়ি।
ঘরে কাপড় রাখা, বর্জ্যরে ঝুড়ি, পাপোশও তৈরি হচ্ছে। টিনশেড ঘরটির জন্য মাসে সাত হাজার টাকা ভাড়া দেন রেজাউল। খোর্দ্দমুরাদপুর গ্রামের লাকী বেগম (৩১) বলেন স্বামী আবদুর রাজ্জাক অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করেন। সংসারে দুই ছেলেমেয়ে। কারখানায় এক বছর ধরে নিয়মিত কাজ করছেন। এর আগে তিনি বিনা মূল্যে বিভিন্ন পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন রেজাউলের কাছে। এখানে কাজ করে মাস শেষে পাঁচ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা পান। সকাল ১০টায় কাজ শুরু হয়। দুপুরে এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ চলে। লাকী বেগম জানালেন, বাড়িতে নিয়েও রাতে কাজ করেন। লাইজু বেগম (৪৩) ও তাঁর স্বামী মাহফুজার রহমান (৫৪) তারা দুজনে মিলে কারখানায় কাজ করেন। এক দিনে দুই থেকে আড়াই ফুট লম্বা তিনটি ঝুড়ি তৈরি করতে পারেন বলে জানালেন লাইজু। বললেন, দুজন মিলে মাসে প্রায় ১৫ হাজার টাকা আয় হয়। সেই টাকায় হামার সংসার ভালোই চলছে।
এদিকে নীলফামারী জেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে খোকশাবাড়ি ও গোড়গ্রাম ইউনিয়ন। এক সময় দরিদ্রতা ছিল এ এলাকার মানুষের জীবনসঙ্গী। কিন্তু বর্তমানে ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের সেই চিত্র বদলে গেছে।
গ্রামগুলোর প্রায় প্রতিটি বাড়িতে হোগলাপাতার হস্তশিল্প তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন নারীরা। তাদের হাতে তৈরি পণ্য ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্তত ২৮টি দেশে যাচ্ছে। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে এ কারুশিল্পের কাজ করার সুযোগ থাকায় গ্রামের অধিকাংশ নারী ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের সঙ্গে নিজেদের স¤পৃক্ত করে আজ স্বাবলম্বী। হোগলাপাতার রয়েছে নানা ধরনের নাম। বাংলায় হোগল, হোগলাপাতা ও ধারী পাতা নামে পরিচিত হলেও ইংরেজিতে এটাকে ক্যাট টেইল বা বিড়ালের লেজ বলা হয়। সাধারণত ৫ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার এই হোগলাপাতা রোদে শুকিয়ে বিশেষ কায়দায় এই পাতা পেঁচিয়ে প্রথমে দড়ি বানানো হয়। হোগলাপাতা আড়াআড়ি ও দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে পছন্দের কারুপণ্যের রূপ দেওয়া হয়। মাপ ও সাইজ ঠিক রাখার জন্য অধিকাংশ কারুপণ্য বানাতে লোহা ও জিআই তারের ডাইস ব্যবহার করা হয়। হোগলা পাতাসহ এসব পণ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে কারখানা। এরপর পণ্য তৈরির জন্য দেওয়া হয় নির্দিষ্ট সময়। তৈরি হয়ে গেলে কারখানা থেকে কর্মী এসে পণ্য সংগ্রহ করেন নারীদের কাছ থেকে। প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে তৈরি এ সব কারুশিল্প পরিবেশবান্ধব হওয়ায় বৈদেশিক বাজারে এর চাহিদাও ব্যাপক। এখানকার তৈরি কারুপণ্য সরবরাহকারীদের হাত হয়ে আমেরিকা, কানাডা, চীন, জাপান, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় ২৮টি দেশে রপ্তানি হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়িতে অবসর সময়ে হোগলা পাতা পণ্য তৈরি করেছেন সুইটি আক্তার। তিনি বলেন, পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে গ্রামের নারীদের সঙ্গে হোগলাপাতার পণ্য তৈরি করছি। মাসে আয় হচ্ছে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। তা দিয়ে পড়াশোনা ও হাতখরচ জোগান হচ্ছে। এমনকি প্রতি মাসে টাকা বাবা-মায়ের হাতে তুলে দিতে পারছি। আমার মতো অনেক শিক্ষার্থী এই কাজে যুক্ত আছেন। ওই এলাকার জোসনা বেগম বলেন, আমার স্বামী রিক্সাচালক। আগে সবসময় সংসারে অভাব লেগে থাকত। এসব কাজ শুরু করার পর সংসারের অভাব দূর হওয়ার পাশাপাশি সন্তানের চাওয়া পাওয়া পূরণ করতে পারি। এসব পণ্য বানানোর কাজ শিখতেও বেশি সময় লাগে না। কাজও সহজ। আর কাজের জন্য বাইরে যেতে হয় না। বাড়িতে বসে কাজ করা যায়। জান্নাতী বেগম বলেন, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি এসে দেখছি নারীরা হোগলা পাতার পণ্য তৈরি করে আয় করছেন। তা দেখে আমিও এই কাজ শুরু করি।
এখন নিজের কোনো খরচের জন্য স্বামীর কাছে চাইতে হয় না। উল্টো আমরা সংসারের খরচে সাহায্য করি। আমার মতো গ্রামের অনেক নারী স্বাবলম্বী হচ্ছে এসব কাজ শিখে। আর্টিশিয়ান হাউস বিডি লিমিটেডের প্রোডাকশন ম্যানেজার হামিদুল হক মোল্লা বলেন, আমাদের যে মালগুলো তৈরি হয় এর কাঁচামাল নোয়াখালী থেকে নিয়ে আসি। নিয়ে আসার পর গ্রাম এলাকায় যারা কাজ করছে তাদের হাতে পৌঁছানো হয়। কাজ হয়ে গেলে আমাদের টিম আছে তারা চেক করে নিয়ে আসে। কোনো সমস্যা হলে সেটা সমাধান করে ঢাকা পাঠানো হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন দেশে যায়। বেশিরভাগ যায় ইউরোপের দেশগুলোতে। হোগলাপাতা খুব সহজেই পচনশীল হওয়ায় এতে পরিবেশ দূষণের কোনো সম্ভাবনা নেই। বিশ্বজুড়ে আজ পরিবেশ দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে হোগলাপাতা, তালপাতা, খেজুরপাতা জলপাতা ও গোলপাতা জাতীয় জিনিসের তৈরি পণ্য। পরিবেশবান্ধব পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারিত হওয়ায় হোগলাপাতার পণ্যের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিসিক নীলফামারী জেলা কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক চারু চন্দ্র বর্মণ বলেন, হোগলাপাতার পণ্য তৈরির মাধ্যমে গ্রামের অনেক নারী স্বাবলম্বী হচ্ছে। আর এই পণ্য তৈরি উদ্যোক্তাদের কোনো সহযোগিতা প্রয়োজন হলে বিসিক সবসময় তাদের পাশে থাকবে। তিনি বলেন হোগলাপাতা একটি জলজ উদ্ভিদ। স্যাঁতস্যাঁতে জলাবদ্ধ জমি ও বিলের ধারে হয়ে থাকে। আর এখন গ্রামীণ নারীরা তাদের নিপুণ হাতে হোগলা পাতা দিয়ে তৈরি করছেন ঘর সাজানো শৌখিন পণ্য। গ্রামীণ নারীদের হোগলাপাতার তৈরি ফুলের টব, ব্যাগ, বাটি, ঝুড়ি, পাপোশ, ছোট বালতি, মিনি ফুটকা যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা, সৌদি আরব, ফ্রান্স, জামার্নিসহ ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে।