নওগাঁর মান্দা উপজেলার মৈনম গ্রামে অবস্থিত রাজকীয় নকশাখচিত মাটির ডুপ্লেক্স বাড়ি
পাহাড়ে ঔষধি বাগান
সুফল প্রকল্পের আওতায় শেরপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়জুড়ে তৈরি করা হয়েছে ভেষজ চিকিৎসায় ব্যবহৃত বাসক পাতার বাগান। সবুজে ঘেরা সেই বাগান দেখলে মনে হয় চা বাগানের মতোই। সুফল প্রকল্পের অন্যান্য খাতের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও বাসক বাগান নিয়ে দেখা দিয়েছে সাফল্যের সম্ভাবনা। একদিকে বাসক ওষুধ কোম্পানিগুলোতে বিক্রি করে সরকারি রাজস্ব আদায়, অন্যদিকে ওই বাগানের সঙ্গে জড়িত জনগোষ্ঠীরাও উপকৃত হবেন- এমনটা আশা নিয়েই যাত্রা শুরু হয় বাসক বাগানের। তবে ওই প্রকল্পের প্রায় ৪ বছর পার হলেও পরিপক্ব বাসক গাছ থেকে পাতা সংগ্রহে বন বিভাগের তরফ থেকে এখনো নেওয়া হয়নি কার্যকর কোনো উদ্যোগ। ফলে গাছ থেকে ঝরে পড়ছে পাকা পাতা। বাগানের অংশীজনদের অভিযোগ, সঠিক সময়ে পাতা সংগ্রহ না করায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। অন্যদিকে বন বিভাগ বলছে, খুব দ্রুতই নিলামের মাধ্যমে বাসক পাতা সংগ্রহ শুরু হবে।
বন বিভাগের তথ্যমতে, শেরপুরের সীমান্তবর্তী শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় সুফল প্রকল্পের নামে টেকসই বনায়ন জীবিকায়ন প্রকল্পের আওতায় ২০১৯-২০, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে বালিজুড়ি, রাংটিয়া ও মধুটিলা রেঞ্জে ৬ হাজার ৫৮০ একর জমিতে সুফল বাগান করা হয়। এতে রোপণ করা হয় দেশীয় বৃক্ষ, ফল ও ঔষধিসহ ৬০ প্রজাতির প্রায় ৫০ লাখ বৃক্ষ। এর মধ্যে ২৪৫ হেক্টর জমিতে রোপণ করা হয় বাসক পাতার গাছ। এরই মধ্যে ভেষজ চিকিৎসায় বাসক পাতার বাগান পাহাড়জুড়ে ছেয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে সবুজের হাতছানি। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় ৪ বছর পার হলেও পরিপক্ব বাসক গাছ থেকে পাতা সংগ্রহের কোনো উদ্যোগ নেই স্থানীয় বন বিভাগের।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সীমান্ত সড়কের দু’পাশজুড়ে ছেয়ে গেছে সবুজ বাসক পাতার বাগান। দূর থেকে দেখলে মনে হবে এটা কোনো চায়ের বাগান। আর কাছে গেলেই বুঝা যায় এটি ভেষজ চিকিৎসায় ব্যবহৃত বাসক পাতার বাগান। বর্তমানে গাছগুলো অনেক বড় হয়েছে। গাছে অনেক পাতাও হয়েছে। অনেক জায়গায় আবার দেখা যায়, বাগানের ভেতরে পাকা পাতা পড়ে আছে। অনেক গাছে দেখা যায়, বাসক পাতা পেকে ঝুলে আছে। স্থানীয় অনেকেই সেই পাকা পাতা সংগ্রহ করছে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য।
বাগানের উপকারভোগী রহিম মিয়া বলেন, সিলেটের যেমন চা বাগান, আমাদের এইদিকে তেমন বাসক বাগান। এই বাসক বাগানে আমরা বেশ কিছু সদস্য দেখাশোনা ও পরিচর্যা করে আসছি। এই বাগানের পাতা দিয়ে ওষুধ হবে বন বিভাগ এটা আমাদের শুরুতেই বলেছে। তারা বলেছে, খুব দ্রুতই পাতা তুলে বিক্রি করবে এবং আমাদের লাভ হবে। কিন্তু ৩/৪ বছর পার হলেও পাতা আর তোলা হচ্ছে না। যদি পাতাগুলো তুলতো তাহলে আমরা কর্মস্থলে থাকতাম। কিছু টাকা পয়সা পেতাম। সংসারটা ভালো চলতো। স্থানীয় বাসিন্দা ফারুক আহম্মেদ বলেন, এই গাছগুলো লাগানো হয়েছে ৩ বছরের বেশি হয়ে গেছে। এই গাছের পাতাগুলো বছরে তিনবার তোলা যেত। এতে আমাদের পাশাপাশি সরকারেরও লাভ হতো। আমরা বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে সুন্দরভাবে চলতে পারতাম। বাগানের আরেক অংশীজন প্রদীপ ম্রং বলেন, গারো পাহাড়ে অনেক বাসক পাতার চাষ হয়েছে। আমরা যতটুকু জানি, এগুলো এক বছর পর থেকেই পাতা তোলা যায়। কিন্তু গাছ বড় হয়ে পাতা ঝরে ঝরে পড়ে যাচ্ছে, পাতা উঠানোর কোনো খোঁজ নেই।
ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান প্রাঞ্জল এম সাংমা ও শ্রীবরদী উপজেলা শাখার চেয়ারম্যান প্রাঞ্জল এম সাংমা বলেন, বন বিভাগ যে বাগান সৃজন করেছে তারমধ্যে কিছু ঔষধি গাছ, মানে বাসক গাছের চাষ করা হয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, দীর্ঘ প্রায় ৪ বছর পরও পরিপক্ব গাছের পাতা আহরণ করা হচ্ছে না। অথচ পাতাগুলো এক বছরের পর থেকেই আহরণের উপযোগী হয়ে যায়। এটা দ্রুত সময়ের মধ্যে আহরণ করে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কাছে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করলে স্থানীয়রা শ্রমিক হিসেবে বাড়তি টাকার পাশাপাশি বাগানের অংশীজনরাও লাভবান হবেন। এ ব্যাপারে ময়মনসিংহ বন বিভাগের বালিজুড়ি রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা সুমন মিয়া বলেন, বন অধিদপ্তরের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন সময়ে তিন রেঞ্জের সীমান্ত এলাকাজুড়ে ঔষধি বাগান সৃজন করা হয়। বর্তমানে বাগানের গাছগুলোর গ্রোথ খুবই সন্তোষজনক ও বিক্রির অবস্থায় আছে। সামনে টেন্ডারের মাধ্যমে বাসক গাছগুলো বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বিক্রির পর স্থানীয় অংশীনজনরা বন নিয়ম অনুযায়ী সুবিধা পাবেন।
রফিকুল ইসলাম আধার, শেরপুর
হাঁস পালনে সচ্ছল ঈশিতা
ঈশিতা রানী, পেশায় গৃহিণী। স্বামী পরিমল চন্দ্র কাজ করেন দিনমজুরের। দুই সন্তানসহ চার সদস্যের টানাপোড়েন এক সংসার। একমাত্র স্বামীর আয় দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে চোখে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে ঈশিতা রানীর সংসারে। সংসারের অভাব এবং হতাশার হাতছানিকে উপেক্ষা করে স্বপ্ন দেখেন নিজে কিছু করার। স্বামীর ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে বিগত ২০০১ সালে হাঁস পালন করে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখেন ঈশিতা।
জানা যায়, ঈশিতা রানীর বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার ধলাপাড়া ইউনিয়নের মুসুল্লি পাড়া গ্রামে। বাড়ির চার পাশে বিলের উন্মুক্ত জলাশয়ে হাঁস পালন শুরু করেন ঈশিতা। এজন্য আলাদা কোন ঘরের প্রয়োজন হয়নি। বাড়তি কোনো খাবারেরও প্রয়োজন হয়নি। বিলের কিনারায় নেট জাল দিয়ে বেড়া দিয়ে সেখানে হাঁস রাখেন। পাশেই রয়েছে বাঁশের চাটাই এবং পলিথিনে ঘেরা আরেকটি টং ঘর। সেখানে রাতে হাঁস পাহারা দেয় ঈশিতা এবং তার স্বামী পরিমল। একদিকে স্বামীর সংসারের ঘানি, অন্যদিকে নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই নারী উদ্যোক্তা ঈশিতা। অভাবকে জয় করে সংসারে এনেছেন সচ্ছলতা। তার এই প্রচেষ্টা এবং ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প দেখে এলাকার অনেকেই ঝুঁকছেন হাঁস পালনের দিকে।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার ধালাপাড়া সাগরদিঘি সড়কের ঘোড়াদহ সেতু থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গিয়েছে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ। সামনেই মুসুল্লিপাড়া গ্রাম। গ্রামটি নিচু এলাকা হওয়ায় প্রায় সারাবছর পানি থাকে। গ্রামটির নাম মুসুল্লিপাড়া হলেও এখানে বাস করে ৯০ ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। এ গ্রামেই বাস করেন ঈশিতা রানী।
নারী উদ্যোক্তা ঈশিতা রানী বলেন, আমি বিগত ২০০১ সাল থেকে কিছু কিছু করে হাঁস লালন-পালন করি। তারপর ধারদেনা করে ৫০টি হাঁসের বাচ্চা দিয়ে শুরু করি ছোট একটি খামার। এরপর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ধারদেনা সব পরিশোধ করেছি। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা এবং লাভের জমানো ১৫ হাজার টাকা দিয়ে চলতি বছর আমার খামারে ৩০ টাকা দরে ৫০০ হাঁসের বাচ্চা তুলেছিলাম। সবই দেশী হাঁস।
বর্তমানে আমার খামারে প্রায় ৪০০ হাঁস ডিম দিচ্ছে। কিছু হাঁস মারা গিয়েছে। বাকিগুলো পুরুষ হাঁস। হাঁসের ডিমের বাজার ভালো থাকায় প্রতিদিন ডিম বিক্রি করে আয় হচ্ছে প্রায় চার হাজার টাকা। এতে আমার মাসে আয় হচ্ছে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। সারাদিন হাঁসগুলো উন্মুক্ত জলাশয়ে খাবার খেয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খামারে চলে আসে। ডিম পাড়ার সময়ে দুপুরে বাড়তি খাবার হিসেবে ধানের কুড়া দিতে হয়। মাঝে মাঝে হাঁসের ছোটখাটো রোগবালাই হলে ওষুধ দিতে হয়। তাছাড়া আমার খামারে অন্য কোনো খরচ নেই। বাড়ির আশপাশের লোকজন ধান ভাঙায়, চাল থেকে যে কুড়া বের হয়, সেগুলো আমি পরিষ্কার করে দেই বিনিময়ে তারা আমাকে কুড়াগুলো দেয়। বাইরের কোনো ওষুধ ও খাবার না খাওয়ে নিজস্ব প্রাকৃতিক খাবার খাওয়ে আমি হাঁস লালন-পালন করছি। এতে করে আমার খামারের হাঁস সুস্থ ও ভালো থাকে। চাহিদা ভালো থাকায় ডিমগুলো বাজারে নিতে হয় না। খামারে এসে পাইকার ডিম নিয়ে যাচ্ছে। এতে দামও ভালো পাচ্ছি। আবার ডিম পাড়া শেষ হলে ও হাঁসের বয়স হলে প্রতিটি হাঁস ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা দরে বিক্রি করে দেই। হাঁস বিক্রি করেও প্রাই দুই লাখ টাকার মতো আয় করতে পারব।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সংসারে আগে যেমন অভাব-অনটন ছিল বর্তমানে তা আর নেই। আমার দুই সন্তান রয়েছে। বড় মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। ছোট ছেলের বয়স ৪ বছর। মেয়ের পড়াশোনার খরচ ও সংসারের খরচ করে যে টাকা থাকে সেগুলো সঞ্চয় করি। পরিবার নিয়ে বর্তমানে সুন্দরভাবে চলতে পারছি। আমার দেখাদেখি আমাদের এলাকার আরও লোকজন হাঁস পালনে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বেকারদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, চাকরির পিছনে না ছুটে আমার মতো উদ্যোক্তা হলে আর বেকার কেউ থাকবে না। নিজেরাই কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে পারবেন। হাঁস পালন করা যেমন কষ্ট, তেমন টাকাও আছে।
ঈশিতা রানীর স্বামী পরিমল চন্দ্র বলেন, আমি কাজের ফাঁকে স্ত্রীর এই হাঁসের খামার দেখাশোনাও করি। আমার অনেক ভালো লাগে, যখন খামারে সময় দেই। আগে আমি একা আয় করতাম, যে টাকা পেতাম কোনো রকম সংসার চলতো। আর বর্তমানে আমার স্ত্রী হাঁস পালন করে। আমাদের সংসার এখন ভালো চলছে। আমার স্ত্রীর হাঁস পালন দেখে এলাকার নারী-পুরুষরা হাঁস পালনে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
এ বিষয়ে ঘাটাইল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. বাহাউদ্দীন সারোয়ার রিজভী বলেন, ঈশিতা রানী উপজেলার একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। আমরা আশা করছি তার সফলতা দেখে এই উপজেলার অন্যান্য নারী-পুরুষ অনুপ্রাণিত হয়ে খামারি হয়ে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবেন। আমাদের দপ্তর থেকে কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই। তবে আমরা তাদের ফ্রিতে চিকিৎসা দিয়ে থাকি।
ইফতেখারুল অনুপম, টাঙ্গাইল
২০০ বছরের ঐতিহ্য
জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও জমিদারের রেখে যাওয়া মাটির বাড়িটি জায়গা করে নিয়েছে দর্শক হৃদয়ে। রাজকীয় নকশা খচিত মাটির ডুপ্লেক্স বাড়িটি এক নজর দেখার জন্য প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ আসেন প্রত্যন্ত পল্লী নওগাঁর মান্দা উপজেলার মৈনম গ্রামে। বর্তমান বাড়ির মালিক আসকার ইবনে সুলতান শান্ত বলেন, ১৮২৩ সাল নাগাদ জমিদার সারদা প্রসাদ রায়ের বাবা পাল বংশের কাছ থেকে একটি মাটির দোতলা বাড়ি ক্রয় করেন। সেই সময়ে জমিদারির প্রায় সকল কার্যক্রম পরিচালিত হতো এই বাড়ি থেকেই। সে সময়ে রাজা জমিদার খুব বেশি বিনোদনপ্রিয় ছিল। সেই আমোদ প্রমোদে বিনোদন অঙ্গনের রঙ্গমঞ্চে স্বাদ নিতে সুদূর ভারত থেকে শিল্পী নিয়ে এসে এই বাড়ির উঠানেই বসত থিয়েটার চলতো যাত্রাপালা। এখানে উচ্চবংশীয় এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে পুজোর সময় সংস্কৃতি যুদ্ধ হতো। মৈনম বাজারে রায় বাড়ির জমিদার বাড়ি এখন আধুনিক মাটির ডুপ্লেক্স বাড়ি। ব্যক্তি মালিকানায় থাকলেও দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটক আসেন বাড়িটির সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। ২০২১ সালে রায় বাড়ির বংশধর বরুন রায় এবং বাবন রায় জমি বিক্রি করে নাটোরে চলে যান। বর্তমানে ক্রয় সূত্রে বাড়িটির মালিক আসকার ইবনে সুলতান শান্ত।
বাড়িটি সংস্কারে আধুনিকায়নে শান্ত স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের কারিগরদের শৈল্পিক কারিগরিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এমন সৌন্দর্য যেন সকলে উপভোগ করতে পারে তার জন্য পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বাড়িটির বর্তমান নাম রাইজিং হেরিটেজ প্যালেস। এখানে এখনো সেই সময়ের মাটির চিহ্নগুলো রয়ে গেছে। বাড়ির দেওয়ালগুলোতে মাটির স্তর দিয়ে নানান শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। নিয়ামতপুরের আদিবাসী পল্লী থেকে ৮০-৮৫ বছরের বৃদ্ধ দ্বিজেন বর্মণ তার ২০জনের একটি টিম নিয়ে ৪ মাস শিল্পকর্মের কাজ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে স্থানীয় কারিগর দিয়ে প্রায় দুই বছর সময়ের ব্যবধানে এমন রূপ দিতে পেরেছেন। বাড়িটিতে অভ্যন্তরীণ দুটি মাটির সিঁড়ি রয়েছে, যা প্রায় দুইশ’ বছরের পুরনো। আর সংস্কারের পর বাইর থেকে সকলের চলাচলে সুবিধার্থে সিঁড়ি করা হয়েছে। প্রতিদিন মানুষ আসে মাটির এই ডুপ্লেক্স বাড়িটি দেখতে।
কথিত রয়েছে, জমিদার সারদা প্রসাদ রায়ের দুই ছেলে ছিলেন। বড় ছেলের নাম বড়দা প্রসাদ রায় এবং ছোট ছেলের নাম শরৎ রায়। বড়দা প্রসাদ রায়ের পরিবারকে বলা হতো বড় তরফ আর সারদা প্রসাদ রায়ের পরিবারকে বলা হত ছোট তরফ। এই বড়দা প্রসাদ রায় তৎকালীন ১৯৪২ সাল থেকে যুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই এলাকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। অর্থাৎ এখনকার ভাষায় যেটাকে বলা হয় চেয়ারম্যান। সেই সময়ে চেয়ার নিয়ে কথা বলার সময় এক মুসলিম ব্যক্তির ওপর মন্মথ রায়ের থুতু লেগে যায় আর এতে সেই সম্প্রদায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর মোজাহার ডাকাত ও ইরফান ডাকাতের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। সেই দাঙ্গায় এই পরিবারের ১৩জন সদস্য নিহত হয়। মৈনমের ১৯৬৪ সালের রায়ট বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস একুশে পরিষদ নওগাঁ লিপিবদ্ধ করেছে। সে সময় জমিদার বড়দা প্রসাদ রায়ের স্ত্রীকে কেটে কুচি কুচি করা হয়। এই ঘটনায় বড়দা বাবু কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে যান। তিনি যুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর রায় পরিবারের সদস্যরা এক এক করে বিভিন্ন জায়গায় চলে যান। সর্বশেষ এখানে ছিলেন বরুন রায় এবং বাবন রায়।
দর্শনার্থীরা বলেন, বাড়ি নওগাঁ সদরে হলেও এই বাড়িটির কথা অনেক শুনেছি তাই আজ দেখার জন্য আসলাম। এখন মাটির বাড়ি বিলুপ্তির পথে এই বাড়িটি মাটির হলেও একটা রাজকীয় তথা জমিদারি ভাব আছে যা আমাকে মুগ্ধ করেছে। দর্শনার্থীরা হারানো এমন স্মৃতিকে ধরে রাখতে মোবাইল ফোনে সেলফি তোলেন আবার অনেকে ভিডিও বানান। স্থানীয়রা বলেন, এই বাড়িটি পূর্বে এমন সৌন্দর্য ছিল না। গত বছর বাড়িটির সংস্কার ও নকশার কাজ শুরু করে, যা সম্পূর্ণ হওয়ার পর অনেক দর্শনার্থী দেখতে আসেন। বাড়িটির সামনের অংশে পানির ফুয়ারা বসবার সুব্যবস্থা থাকায় সকলেই যেন সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ-সুবিধা পায়। দর্শনার্থীদের কথা ভেবেই সামনের অংশে এমনটা করা।
বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ
ঘানি টানছেন দম্পতি
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ভূমিহীন জহুরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী মিনা খাতুন গরুর বদলে ঘানি ঘুরিয়ে সরিষা থেকে তেল বের করছেন অনেকদিন ধরে। প্রতিটি লোমকূপ দিয়ে শরীরের ভেতরের পানি বিন্দু বিন্দু ঘাম হয়ে বেরিয়ে আসছে। কপাল বেয়ে মাথার ঘাম পড়ছে মাটিতে। তবু অনবরত ঘুরছেন তারা। আর তাতে ঘানি বেয়ে পাত্রে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা তেল। শুক্রবার ভোরে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় এই চিত্র।
উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে পাঙ্গাশী ইউনিয়নের কালিয়াবিল গ্রামের মৃত রফাত আলী প্রামাণিক রফাত আলীর পেশা ছিল ঘানি দিয়ে তেল তৈরি। তার মৃত্যুর পরে তারই পেশা বেছে নেন তিন ছেলে। তারই এক সন্তান জহুরুল ইসলাম। জহুরুল ইসলাম জানান, বাবা রফাত আলী প্রামাণিক ছিলেন ভূমিহীন। ঘানিতে তেল তৈরি করেই চলত সংসার। বাবার মৃত্যুর পর তিন ভাই বেছে নেন বাবার পেশা। এখন তিন ভাই ঘানির তেল বিক্রি করে চালায় সংসার। আগে গরু দিয়ে ঘানি ঘুরিয়ে তেল তৈরি করতেন। তখন আয়ও হতো বেশি। ছয় সদস্যের সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু ছোট মেয়ে রুমানা খাতুনকে বিয়ে দিতে ঘানি ঘোরানোর গরুটি বিক্রি করে দিতে হয়। অভাবী এলাকায় উপার্জনহীন হয়ে পড়ে পরিবারটি। অনেক চেষ্টা করেও আর গরু কিনতে না পেরে জীবন বাঁচানোর তাগিদে স্বামী-স্ত্রী মিলে শুরু করেন ঘানি টানার কাজ। প্রতিদিন ৫ কেজি সরিষা ভেঙে তেল তৈরির পর বাজারে বিক্রি করে যে টাকা আয় হয়, তা দিয়ে কষ্টে চলছে তাদের সংসার।
নিত্যদিন ঘানি টানার ফলে স্বামী-স্ত্রীর শরীরের বিভিন্ন স্থানে গরুর মতোই কালো দাগ পড়েছে। জহুরুল বলেন, একটি গরু থাকলে এত কষ্ট হতো না। উপার্জনও হতো বেশি। স্বামীর সঙ্গে এ কাজে সহযোগিতা করছেন স্ত্রী মিনা খাতুন। প্রতিটি লোমকূপ নিয়ে শরীরের ভেতরের পানি বিন্দু বিন্দু ঘাম হয়ে বেরিয়ে আসছে। কপাল বেয়ে মাথার ঘাম পড়ছে মাটিতে। তবু অনবরত ঘুরছেন তারা। আর তাতে ঘানি বেয়ে পাত্রে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা তেল।
জহুরুলের স্ত্রী মিনা খাতুন জানান, ‘সন্তানদেরও ঠিকমতো খাবার দিতে পারি না। অভাবের কথা বলতে বলতে মিনা খাতুনের হলুদ ঘোলাটে চোখ ছলছল করে ওঠে। সে জানায় দুটি মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। ঝি জামাই এলে তাদের খাবার দিতে অনেক কষ্ট হয়। একটি গরু থাকলে এ কষ্ট দূর হয়ে যেত।
জহুরুলের আরেক ভাই জুড়ান আলী। তিনিও ঘানির তেল বিক্রি করেন। তার বাড়িঘরের অবস্থা ভালো থাকলেও অভাব রয়েছে তারও। তিনি অভাবের তাড়নায় গরু বিক্রি করে শরীর দিয়ে ঘানি টানছেন। তবে তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে সমস্যায় রয়েছে তারই ভাই জহুরুলের। মেয়ে বিয়ে দিতে গিয়ে ঘানির গরুটা বিক্রি করায় তার চরম কষ্টে দিন যাচ্ছে।
জহুরুলের আরও এক ভাই রবিউল জানান, বাপ দাদার পেশা ছাড়তে পারছেন না। পেশা ছেড়ে অন্য কিছু করার উপায় নেই। তার একটি ঘানি আছে। বর্তমানে ঘোড়া দিয়ে ঘানি চালানো হচ্ছে। তবে তার ভাই জহুরুলের দুঃখের সীমা নেই। অভাবী মানুষ মেয়ে বিয়ে দিতে গিয়ে গরুটি বিক্রি করে দিয়েছেন। এর ফলে তার সংসার চালানো অনেক কষ্ট পেতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সরকারিভাবে তাকে সহযোগিতা করলে কষ্ট থেকে মুক্তি পেত। স্থানীয় পল্লী বিদ্যুতের বিলিং সহকারী জানান, বিলের কপি দিতে এসে দেখি জহুরুল তার স্ত্রীকে নিয়ে ঘানি টানছেন। তখন দেখে আমার খুবই খারাপ লেগেছে।
এ ব্যাপারে রায়গঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাহিদ হাসান খান বলেন, বিষয়টি পরিদর্শন করে উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে ঘানি টানা দম্পতি পরিবারের পাশে দাঁড়ানোসহ সকল প্রকার প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে।
এইচ এম মোনায়েম খান, রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ