মঙ্গলবার হিমালয়ের পিক আইল্যান্ড জয় করে বাংলাদেশী পর্বতারোহীদের একটি দল
হিমালয়ের অনেক চূড়ার একটি ইমজাৎসে। আইল্যান্ড পিক নামেও পরিচিত। নেপালের সলুখুম্বু অঞ্চলে অবস্থিত এ পর্বত চূড়ার উচ্চতা ৬ হাজার ১৬৫ মিটার। সমতল থেকে এই উচ্চতার কথা ভাবলেও গা অনেকের শিউরে উঠবে। কিন্তু পর্বত জয়ের নেশা যাদের, তারা অধিক উচ্চতাই আসলে স্পর্শ করতে চান। অভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে দারুণ সফল হয়েছেন বাংলাদেশের চার পর্বতারোহী। ২৭ দিনের পরিভ্রমণ শেষে গত মঙ্গলবার আইল্যান্ড পিক জয় করেছেন তারা। ওইদিন সন্ধ্যায় খবরটি দেশে এসে পৌঁছলে সমতলে অবস্থান করা পর্বতারোহীরা উচ্ছ্বাস-আনন্দ প্রকাশ করতে থাকেন। এখনো তা অব্যাহত আছে।
আইল্যান্ড পিক জয় করা দলটিতে ছিলেন ইয়াসমিন লিসা, মোহাম্মদ ইউছুফ, সাফকাত ফারুক সিজান এবং সোহাগ বিশ্বাস। উল্লেখ না করলেই নয় যে, দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন ইয়াসমিন লিসা। নারীর এমন এগিয়ে থাকা, সাহস জোগানোর ঘটনা হঠাৎ বদলে যাওয়া এই সময়ে খুব জরুরি। জরুরি কাজটি দক্ষতার সঙ্গেই পালন করেছেন তিনি।
অনেকেই জানেন, পর্বতারোহীদের সংগঠন ‘অভিযাত্রী’ নিয়মিতভাবে এই ধরনের দল পাঠিয়ে থাকে। এবারের অভিযান নিয়েও অনেকদিন কাজ হচ্ছিল। সংগঠনের দেওয়া তথ্যমতে, সব প্রস্তুতি শেষে গত ১২ অক্টোবর আইল্যান্ড পিকের উদ্দেশে অভিযান শুরু করে দলটি। মধ্য দুপুরে নেপালের লুকলা থেকে ট্রেকিং শুরু হয়। বিকেলের দিকে ২ হাজার ৬১০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছেন তারা। রাতে দুধ কোষী নদীর তীরঘেঁষা ফাকদিং গ্রামে রাত্রি যাপন করেন। ইউনেস্কোর ঐতিহ্যের তালিকায় থাকা গ্রাম থেকে পরদিন পর্বতারোহীরা পৌঁছে যান নামচে বাজারে, যেটির উচ্চতা ৩ হাজার ৪৪০ মিটার।
‘অভিযাত্রী’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দলটি ১৪ অক্টোবর অ্যাক্লামাটাইজেশন হাইকে নামচে থেকে খুমজুংয়ের পথে যাত্রা শুরু করে। খুমজুং স্যার অ্যাডমন্ড হিলারির স্মৃতিবিজড়িত গ্রাম। ১৫ অক্টোবর তারা ছিলেন হিমালয়ের থামে গ্রামে। এই গ্রামেই জন্মগ্রহণ করে আপা শেরপাসহ বহু বিখ্যাত পর্বতারোহী। ১৬ অক্টোবর ৩ হাজার ৭৩৬ মিটার উচ্চতার থামে থেকে ৪ হাজার ৩৬৮ মিটার উঁচু লুংদেনে যাওয়ার প্রাথমিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কথা ছিল, সেখানে একদিন অ্যাক্লামাটাইজেশন রোটেশন করে পরের
দিন ৪ হাজার ৮০০ মিটার উঁচু রেঞ্জো লা অতিক্রম করবেন। কিন্তু পরিকল্পনায় শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন আনা হয়। অভিযাত্রীদের কথা, একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে সদস্যদের সক্ষমতা যাচাই করা ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। সে অনুযায়ী, ওইদিন থামে থেকে গিয়েছিলাম সুন্দার পিকের দিকে। সুন্দার পিকের উচ্চতা ৫ হাজার ৩৭১ মিটার। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার কারণে আমরা ৫ হাজার মিটারের কিছু বেশি উচ্চতা স্পর্শ করে থামে গ্রামে ফিরে আসি। ১৭ অক্টোবর থামে থেকে লুংদেন যাই।
জানা যায়, লুংদেন থেকে পর্বতারোহীরা ১৮ অক্টোবর ভোরে যাত্রা শুরু করেন গোকিওর উদ্দেশে। পথে রেনজো লা অতিক্রম করেন তারা। এভাবে সন্ধ্যায় পৌঁছে যান গোকিওতে। ১৯ তারিখ পা রাখেন গোকয়ো রি তে, যেটির উচ্চতা ৫ হাজার ৩৬০ মিটার। পরদিন গোকিও থেকে ট্রেক করে দলটি পৌঁছে যায় ৪৭০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত থাকনাকে।
এভাবে ক্রমে চূড়ান্ত গন্তব্যের পানে এগিয়ে যেতে থাকেন তারা। এরই একপর্যায়ে আরোহণ করেন লবুচে চূড়ায়। ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করা একটি ছবিতে দেখা যায়, চূড়ার ওপর সাদা তুষারের ছড়াছড়ি। সেই তুষারের ওপর হাসিমুখে বসে আছেন চার অভিযাত্রী। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওড়াচ্ছেন তারা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকাটি মেলে ধরতে দেখা যায় তাদের একজনকে।
চার অভিযাত্রী সবশেষে গত মঙ্গলবার সকাল ৭টা ১৭ মিনিটে ইমজাৎসে চূড়ায় আরোহণ করেন। সকালে আইল্যান্ড পিক জয় করলেও, খবরটি সমতলে আসতে সারাদিন লেগে যায়। লম্বা সময় অপেক্ষায় রাখার পর সন্ধ্যায় ফেসবুক গ্রুপে কয়েকটি ছবি দিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করেন অভিযাত্রীরা। ছবিতে দেখা যায়, চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া। পেছনে নীল আকাশ। পায়ের নিচে সাদা তুষার। আর হাতে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া লাল সবুজ পতাকা। আলাদা আলাদা ছবিতে প্রত্যেকেরই হাসিমুখ দেখা গেছে। গ্রুপ ছবিতে পাওয়া যায় তিনজনকে। বিজয়ীর বেশে তাদের দেখে তখন থেকেই অভিনন্দন জানাতে থাকেন শুভাকাক্সক্ষীরা।
অভিযাত্রী দলের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন নিশাত মজুমদার। বিখ্যাত এই পর্বতারোহী ইতোমধ্যে এভারেস্ট জয় করে নারীর শক্তির বিপুল বিজয় ঘোষণা করেছেন। চার তরুণের আইল্যান্ড পিক জয় সম্পর্কে তার বক্তব্য: আমরা সমতলে থেকেই ওদের জন্য শুভ কামনা করছিলাম। খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম কখন কোথায় পৌঁছাল। মোটামুটি পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারেই দলটি এগিয়ে যেতে পেরেছিল বলে জেনেছি।
তিনি জানান, এই অভিযানে দলটি এভারেস্ট বেইস ক্যাম্পসহ রেঞ্জো লা, চো লা, খোংমা লা’র মতো হিমালয়ের তিনটি উচ্চতর পাশ পাড়ি দিয়েছে। এ ছাড়াও তারা কালা পাত্থর, গোকিও রি, চুখুং রিয়ের মতো রোমাঞ্চকর ট্রেইল পরিভ্রমণ করেন বলে জানান তিনি।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে নিশাত বলেন, তরুণদের এই অভিযান আসলে কোনো বিলাসিতা নয়। বরং এটা একটা লাইফস্টাইল। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার শক্তি অর্জন করতে এই ধরনের অভিযান ব্যাপক সহায়তা করে।
এর আগে ঢাকায় অভিযাত্রী দলের হাতে জাতীয় পতাকা অর্পণ করেন অভিযানের পৃষ্ঠপোষক ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ। তিনি বলেন, তরুণদের এমন চ্যালেঞ্জিং অভিযানের অংশ হতে পেরে আমরা খুবই আনন্দিত। এমন অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গে তরুণরা ভবিষ্যতে আরও বেশি যুক্ত হবেন বলেও আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
আইল্যান্ড পিক জয় করা দলটি আগামী ৪ নভেম্বর দেশে ফিরবে বলে জানা গেছে। দলটিকে আমাদের পক্ষ থেকেও অনেক অনেক অভিনন্দন। শুভেচ্ছা।