ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ১৩ কার্তিক ১৪৩১

কবে ফিরবে সেইসব আনন্দঘন দিন

বড় বড় সাংস্কৃতিক  উৎসবের মৌসুম,  ক্ষুধা নিয়ে অপেক্ষা

মোরসালিন মিজান 

প্রকাশিত: ২২:২০, ২৮ অক্টোবর ২০২৪

বড় বড় সাংস্কৃতিক  উৎসবের মৌসুম,  ক্ষুধা নিয়ে অপেক্ষা

শীতের ভরা মৌসুমে গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব। সর্ববৃহৎ ও বর্ণিল এই আয়োজনে গত বছরও মুখরিত ছিল শিল্পকলা একাডেমি

শীতকালের প্রতি বাঙালির পক্ষপাত নতুন নয়। এর নানা কারণ। তবে পিঠা-পার্বণের মৌসুম হিসেবে বিশেষ সমাদৃত। ঘরে-ঘরে পিঠা তৈরির আয়োজন চলে এ সময়। আর বাইরে থাকে বিচিত্র উৎসব অনুষ্ঠান। গ্রামে আবহমান কাল ধরে চিত্রটি এমন। শহরও ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে রাজধানী শহরে শীতকালে সবচেয়ে বড় বড় উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মেঘমুক্ত আকাশ, আরামদায়ক আবহাওয়া এক্ষেত্রে দারুণ সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

তাই হেমন্তের শুরু হতে না হতেই উৎসব অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় ঢাকা। কিন্তু এবার ভিন্ন বাস্তবতা। সবকিছু আগের মতো নেই। ছন্দপতন ঘটেছে। ফলে নীরবেই কেটে যাচ্ছে উদ্যাপনের মৌসুম। শিল্পকলা একাডেমি, মহিলা সমিতি, জাতীয় জাদুঘর বা টিএসসিÑ কোথাও উৎসব নেই। নাট্যোৎসব, চলচ্চিত্র উৎসব, সংগীত বা কবিতার উৎসব একরকম হারিয়ে গেছে। 
এই মৌসুমের সবচেয়ে বৃহৎ সবচেয়ে বর্ণিল আয়োজনটির নাম ‘গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব।’ গত এক যুগ ধরে নিয়মিতভাবে ঢাকায়  উৎসবটি আয়োজন করা হয়ে আসছে। দুই নদীর নামে মূলত দুই বাংলার শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা মিলিত হন উৎসবে। মঞ্চনাটক, পথনাটক, সংগীত, আবৃত্তি, প্রযোজনাসহ শিল্পের নানা মাধ্যমে বাংলা ও বাঙালিত্বের জয়গান করেন তারা। এভাবে দুই বাংলার অভিন্ন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার আয়োজনের মূল বৈশিষ্ট্য গড়ে দিয়েছে। গত বছর ৬ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে গিয়েছিল নাটক সংগীত নৃত্য আবৃত্তিসহ প্রায় সব শিল্পমাধ্যমের প্রতিনিধিত্বকারী উৎসব। শিল্পকলা একাডেমির প্রতিটি মঞ্চ একসঙ্গে সরব হয়েছিল। বাইরে খোলা জায়গাগুলোতেও ছিল বর্ণাঢ্য পরিবেশনা। একই উৎসব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল মহিলা সমিতি পর্যন্ত। বাংলাদেশ ও ভারতের ৪৫টি নাট্যদলের নাটক ছিল উৎসবে। অন্যান্য পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে ছিল ১১২টি সাংস্কৃতিক দল।

আয়োজকদের তথ্য, শিল্পের নানা শাখার প্রায় ৪ হাজার শিল্পী অংশ নেন বিভিন্ন পরিবেশনায়। উৎসবে বিপুল সংখ্যক শিল্পী যেমন অংশ নিয়েছিলেন, তেমনি ঢল নেমেছিল শিল্পপ্রেমী মানুষের। কিন্তু এবার আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব উদ্যাপন পর্ষদ। কাছাকাছি সময়ের আরেকটি বড় আয়োজন আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব। শুধু শিশু-কিশোরদের সঙ্গে নিয়ে গত ১৬ বছর ধরে এই উৎসব আয়োজন করা হয়ে আসছে। মূল ভেন্যু ছিল সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার। পরে এটি শিল্পকলায় স্থানান্তরিত হয়। এবার ১৭তম আসরের পর্দা ওঠার কথা ছিল। হয়নি। আয়োজক সংগঠন চিলড্রেন্স ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশ সূত্র জানিয়েছে, তারা উৎসবটি এবার করতে পারছেন না।    
একই মৌসুমের সংগীতায়োজনগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ‘রাধারমণ লোকসংগীত উৎসব।’ ভাটিবাংলার অমর শিল্পী সাধক  রাধারমণের নামে প্রতি বছর নভেম্বরে উৎসবটি আয়োজন করা হয়। রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে তিন দিনব্যাপী উৎসব আয়োজন করে থাকে রাধারমণ সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র। গত বছর ত্রয়োদশতম আয়োজনে সারাদেশ থেকে ঢাকায় আসা দেড়শ’র বেশি শিল্পী লোকসংগীত পরিবেশন করেন। এবার চতুর্দশতম উৎসব আয়োজনের কথা। কিন্তু আয়োজকরা কিছুটা অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। তারা শুধু বলছেন, শত সীমাবদ্ধতা জয় করে এত বছর ধরে উৎসবটা করছি। এবারও করতে চাই। পারবেন কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে তারা কিছু বলতে পারেননি।           
তারও আগের সময়ে ফিরে গেলে নির্ঘাত মনে পড়বে ‘বেঙ্গল ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টিভ্যাল’ বা ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব’র কথা। কী অসাধারণই না ছিল আয়োজনটি! ভাবলে সংগীতপ্রেমীদের মন এখনো আনন্দে নেচে ওঠে। নভেম্বর বা ডিসেম্বরে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামের সুবিশাল পরিসরে রাতভর এই আয়োজন চলত। 
পাঁচদিনের আয়োজনে যোগ দিতেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পীরা। প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, ওস্তাদ জাকির হোসেন, বিদুষী গিরিজা দেবী, শিবকুমার শর্মা, অজয় চক্রবর্তী, ওস্তাদ রশিদ খানসহ বিশ্বনন্দিত শিল্পীরা নিজ নিজ ঘরানার কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীত পরিবেশন করেছেন এই মঞ্চে। গোটা পৃথিবীজুড়ে আয়োজন করা শাস্ত্রীয়সংগীত উৎসবগুলোর মধ্যে এটি ছিল অন্যতম। কিন্তু ২০১২ সালে শুরু হওয়া উৎসব ২০১৮ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। 
শীতের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী আয়োজন পৌষমেলা। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনেক বছর ধরে এই মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। গত বছর একই আয়োজনে মুখর ছিল পুরান ঢাকার সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র বাফা। এবার কি হবে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, আয়োজকরা আয়োজনটি অব্যাহত রাখতে চান। তবে শেষ পর্যন্ত কী হয় সেটা বলতে পারবে সময়। 
সময়টিও একটু ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন দেশ পরিচালনা করছে। নতুন সরকারের আমলে অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে সংস্কৃতি অঙ্গনেও। কিন্তু সংস্কৃতিকর্মীদের অনেকেই এখনো অনিরাপদ বোধ করছেন বলে জানা গেছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া বড় উৎসব আয়োজন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে কি না সেটিও ভাবনার বিষয়। তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা কামনা করছেন তারা। এদিকে, শিল্পসংস্কৃতিপ্রেমী মানুষও মনের ক্ষুধা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তারা উৎসবে মেতে উঠতে চান আবার। কবে আসবে সেই আনন্দঘন সময়?   
 

×