দেশের সর্বউত্তরের তেঁতুলিয়া বাইপাস মহাসড়ক থেকেও দেখা যায় শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা
তাপমাত্রা কমছে। মৃদু পায়ে-শীত নামছে। হেমন্তের রূপে দেশের সর্বউত্তরের পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় এসে পর্যটকরা শ্বেত-শুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে যেন আকাশের বুকে প্রকান্ড পাহাড়ের ওপর একগুচ্ছ রঙিন প্রতিচ্ছবি। কখনো দেখতে শ্বেত-শুভ্র আবার কখনো দেখতে সূর্য ও কমলা রঙের। বরফের পঞ্চরত্ন হলো কাঞ্চনজঙ্ঘা। পাঁচটি চূড়া থেকেই এই নাম। তবে হিমালয় পর্বত বলেই বেশি পরিচিত। এ বছর এখনো পরিষ্কারভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়নি।
হিমালয় ও অন্যান্য মধ্যএশীয় পর্বত পৃথিবীর ছাদ অর্থাৎ পামির মালভূমি থেকে উত্থিত হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে গেছে। পামির মালভূমি থেকে হিমালয় ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব দিক বেষ্টন করে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বিস্তৃত হয়েছে। এই পর্বতশ্রেণির পূর্বাঞ্চল পশ্চিমাঞ্চলের তুলনায় সংকুচিত এবং পর¯পরের খুব কাছাকাছি। এর ফলে আচমকা এগুলো সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠে গেছে। ২৮ হাজার ১৬৯ ফুট উচু এই চূড়া মাথায় নিয়ে মহান হিমালয়ের অবস্থান নেপাল ও ভারতের সিকিম রাজ্যের মাঝামাঝি সীমান্ত রেখায়।
বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলের উত্তরাঞ্চল হলো ভিন দেশের এই পর্বত দেখার স্থান । চলতি সময় কারও ভাগ্যে এক পলক কাঞ্চনজঙ্ঘার উঁকি ধরা পড়লেও কেউ কেউ ব্যর্থ হয়েছেন। যারা এক পলকে দেখতে পেয়েছিলেন - তারা কেউ কেউ আপন মনে গেয়ে ওঠেন.. এক পলকের একটু দেখা আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কি?... কেউ আবার গেয়ে ওঠেন ‘আবার হবে তো দেখা -এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো-যাবার বেলায় আজ কেন যে কেবলই মনে পড়ে গো -অসময়ে নীল আকাশে কত দিন কত মেঘ ধরে গো...
বৃহ¯পতিবার (২৪ অক্টোবর) সকাল ৭টার দিকে মেঘমুক্ত আকাশে পর্বতশৃঙ্গটি দেখা গেছে কিছু সময়ের জন্য। এর পর ওই দিন বিকাল ৪টার দিকে আরেক ঝলক দেখা যায়। তবে শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) দেখা মেলেনি। তার ওপর ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবের ঝাপটা এসে লেগেছে এই অঞ্চলে। মেঘে ঢেকেছে আকাশ। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে । তবে অচিরেই পরিষ্কার আকাশে হিমালয়ে ফুটে উঠবে বলে জানালেন স্থানীয়রা। তবে সাপ্তাহিক দুদিনের ছুটিতে কেউ কেউ এক পলক দেখার অপেক্ষায় শনিবার বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন বলে জানালেন তেঁতুলিয়ায়। পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা যার মোহনীয় সৌন্দর্য উপভোগ করতে কয়েকদিন আগেই মহানন্দা নদীর তীর তেঁতুলিয়ায় এসে আছেন অনেকেই। তেঁতুলিয়া উপজেলার ডাকবাংলো পিকনিক কর্ণারসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার আবাসিক হোটেলে পর্যটকগণ অবস্থান নিয়েছেন। কেউ কেউ রাজধানী ঢাকা ও কক্সবাজার থেকেও এসেছেন।
রাজধানী টু তেঁতুলিয়া। ৪টি ৪-এর সমাহার। সড়কপথের এটি দূরত্ব ৪৪৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার। দূরত্ব তেমন বেশি নয়, কিন্তু একই দেশের এই দুই অঞ্চলে প্রকৃতির মেজাজ এখন একেবারেই দুই ধরনের। শীতকাল না এলেও তেঁতুলিয়ায় শীতের কাঁপন লেগে গেছে খুব ভালোভাবে। প্রতিদিন এখানে ভোরে হাল্কা কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকে। বিকেল না হতেই উত্তরের হিম বাতাস চলে আসছে। লোকজন গরম কাপড় পরে বাইরে বেরোচ্ছে। এত দিন বনবন করে ঘুরতে থাকা ঘরের বৈদ্যুতিক পাখার ছুটি মিলেছে তেঁতুলিয়ায়। আড়মোড়া ভেঙেছে সযতেœ ভাঁজ করে রাখা কাঁথা-কম্বল। শুক্রবারের হিম বাতাসের প্রভাব ছিল ভালই। তেঁতুলিয়ায় কার্তিক মাসে শীত পড়েছে, সে কথা আবহাওয়া অধিদপ্তরও জানিয়েছে। শুক্রবার সকালে তাদের তথ্য অনুযায়ী, তেঁতুলিয়ায় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এর দুদিন আগে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রির ঘরেও নেমেছিল। বলা হচ্ছে তেঁতুলিয়া সহ রংপুর বিভাগের উত্তরাঞ্চলের সর্বোচ্চ ও সর্বনি¤œ তাপমাত্রা বলতে গেলে পাশাপাশি চলে এসেছে। সূত্রমতে আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই উত্তরাঞ্চলের শীতের দাপট বহুগুণ বেড়ে যাবে।
তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর এলাকায় এসে দাঁড়ালে মনে হবে আপনি যেন ওপারের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি শহরে অবস্থান করছেন। পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়াই খালি চোখে এমন দৃশ্য দেখতে পেয়ে পর্যটকদের যেন আনন্দের সীমা থাকে না। ওপারের গাড়ি চলাচল আর মানুষজনের হাঁটাহাঁটি করা স্পষ্ট। ভ্যানচালক রমজান আলী জানালেন আকাশ পরিষ্কার হলেই হেমন্ত ও শীতের এ সময়ে দেশের শুধু পঞ্চগড় থেকে খালি চোখে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। অবাক হতে হয় তেঁতুলিয়ার মতো প্রত্যন্ত গ্রামের একজন খেটে খাওয়া ভ্যানচালক বুঝে গেছেন তেঁতুলিয়া এখন পর্যটন নগরীতে পরিণত হয়েছে। তাই পর্যটক যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভ্যানচালক রমজান আলীকে বলতে শোনা যায়, মাউন্ট এভারেস্ট ও কে টু এর পরে এর স্থান। পর্বতের কিছু অংশ ভারতের সিকিম ও কিছু অংশ নেপালে অবস্থিত। কাঞ্চনজঙ্ঘা খালি চোখে দেখা গেলেও সবচেয়ে ভালো দেখা যায় সীমান্ত নদী মহানন্দা তীরের ঐতিহাসিক তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো পিকনিক কর্ণার ও বাংলাবান্ধা থেকে। বাংলাবান্ধায় যখন দেখা যায় তখন মনে হবে সামনে একটু হেঁটে গেলেও হিমালয়। আসলে কিন্তু না। বলা বাহুল্য বাংলাদেশের সর্বোত্তরের স্থান বাংলাবান্ধা জিরো (০) পয়েন্ট ও বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। এটি বাংলাদেশের একমাত্র স্থলবন্দর যার মাধ্যমে চারটি দেশের সাথে সুদৃঢ় যোগাযোগ গড়ে উঠেছে । এ ছাড়া তেঁতুলিয়া বাইসপাস মহাসড়ক থেকেও হিমালয় ষ্পষ্ট দেখা যায়। গত বছরের এই ছবিটি স্থানীয় একজন তুলেছিলেন তা এই প্রতিবেদনকে দিয়েছেন। তবে চলতি সময়ের হিসালয়ের ছবি সংগ্রহ করা অসম্ভব ছিল। যারা এক পলকে হিমালয় দেখে তাদের মঠোফোনে ছবি তোলার চেষ্টা করলেও তা ছিল ঝাপসা।
স্থানীয়রা জানায়, সূর্যের আলোর সঙ্গে কখনো শুভ্র, কখনো গোলাপী আবার কখনো লাল রঙ নিয়ে হাজির হয় বরফ আচ্ছাদিত এ পর্বত চূড়াটি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা ঝাপসা হয়ে এলে রঙ হয় সাদা। আর এ সৌদর্য উপভোগ করার মোক্ষম সময় ভোর, সকাল ও বিকেল বলে জানান স্থানীয়রা।রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম রাতের কোচে উঠে শুক্রবার ভোরে এসে পৌঁছেন তেঁতুলিয়ায়। তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানালেন দুদিনের জন্য এসেছিল। শনিবার রাতের গাড়িতে ঢাকা ফিরব। এর মাঝে এক পলকের একটু দেখা দেখতে চাই হিমালয়। ভাগ্য ভালো থাকলে দেখা হবেই আমার হৃদয় প্রেমের কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এলাকার বাসিন্দা রূপম সওদাগর বললেন, ১০ দিনে সফরে তেঁতুলিয়া এসেছি। এখন তো কক্সবাজার থেকে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট উত্তরাঞ্চলের নীলফামারীর সৈয়দপুর পর্যন্ত সরাসরি চলাচল করছে। গত শনিবার দুপুর ১টা ১০ মিনিটে ছেড়ে এক ঘণ্টা ৪৫ মিনিটে সৈয়দপুরে আসি। তারপর সড়ক পথে দুই ঘণ্টায় তেঁতুলিয়া এসেছি। এখানে হোটেল ভাড়া খাওয়ার খরচ অনেক কম। তাই ১০ দিনে জায়গায় একটু বেশি থাকব। গ্রামে মেঠোপথ সমতলের চা বাগান ঘুরে দেখতে ভালোই লাগছে। বিশেষভাবে হিমালয় দেখতে পেয়েছি। এই আনন্দে পুলকিত তিনি। আগামী বুধবার দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে তিনি সৈয়দপুর থেকে বিমানের ফ্লাইটে কক্সবাজার ফিরে যাবেন। স্থানীয় লোকজন জানান, পর্যটকরা ফজরের আজানের পর পরই পৌঁছলে অনেক সময় ধরে পর্বতটি দেখতে পারবেন। নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত মেঘমুক্ত আকাশে দেখা দেবে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
জয়পুরহাট থেকে মোটরবাইক নিয়ে ঘুরতে আসা দুই বন্ধু সাগর ও সোহাগ বলেন, আমরা বুধবার রাতে এসে আবাসিক হোটেলে অবস্থান নেই। বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) সকালে দুই বন্ধু ডাকবাংলো পিকনিক কর্ণারে মহানন্দা নদীর তীর থেকে পর্বতটি দেখতে পেয়েছি এক ঝলক। আবার বিকেল চারটার দিকে বাংলাবান্ধা সড়কে সিপাইপাড়া নামক স্থানে এক পলকে একটু দেখতে পেয়ে আমাদের এ যাত্রা সফল হয়েছে। এর পর তেঁতুলিয়া সমতলের চা বাগান সহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখছি। শুক্রবার দুপুরে তেঁতুলিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় গাইছিলেন আবার হবেতো দেখা, এ দেখা শেষ দেখা নয়তো....।