ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১০ কার্তিক ১৪৩১

সারাদেশে স্বর্ণ পাচারে জড়িত ১ হাজার ৪শ’ জন

প্রতিদিন অবৈধভাবে দেশে ঢুকছে ২৫০ কোটি টাকার স্বর্ণ

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ২১:৪২, ২৫ অক্টোবর ২০২৪

প্রতিদিন অবৈধভাবে দেশে ঢুকছে ২৫০ কোটি টাকার স্বর্ণ

.

দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম হু হু করে বাড়ছে। তবে দেশে অলঙ্কার তৈরির চাহিদার চেয়ে চোরাচালান হচ্ছে বেশি। দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর থেকে চোরাইপথে পাচার হয়ে আসছে স্বর্ণ। সীমান্তের চোরাইপথে পাচার হয়ে যাচ্ছে ভারতে। স্বর্ণের চোরাচালানের বাজার এখন জমজমাট। সারাদেশে স্বর্ণ পাচারে জড়িত প্রায় হাজার ৪শজন। গত ১০ বছরে আড়াই হাজার কেজি স্বর্ণ এসেছে দেশে, যার ৯০ শতাংশই দেশের বিভিন্ন জেলার সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে গেছে ভারতে। দেশে প্রতিদিন আকাশপথ, সমুদ্রপথ স্থলপথে চোরাচালানের মাধ্যমে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার সোনার অলঙ্কার বার প্রবেশ করছে। হিসাবে বছরে প্রায় ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার বা তারও বেশি সোনা অবৈধভাবে প্রবেশ করছে দেশে। তবে স্বর্ণ চোরাচালানের গডফাদার মাফিয়া চক্রের সদস্যরা গ্রেপ্তার এড়িয়ে থাকছেন কৌশলে। বাংলাদেশকে স্বর্ণ চোরাচালানের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে খবর জানা গেছে।

 গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশে স্বর্ণ পাচার চোরাচালানে যারা জড়িত তাদের কেউ কারবারি, কেউ পৃষ্ঠপোষক, কেউবা বাহক। যারা স্বর্ণ চোরাচালানের গডফাদার তারা বরাবরই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। স্বর্ণ চোরাচালানীদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে বা তথ্য ফাঁস করলে কিংবা পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ালে তাকে দুনিয়া থেকে চিরতরে বিদায় করে দেওয়া হয় অর্থাৎ খুন করে গুম করে ফেলা হয় এমন উদাহরণ অসংখ্য। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন সময়ে স্বর্ন চোরাচালানে জড়িতদের তালিকা পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) ধারণা, আকাশপথ, সমুদ্রপথ স্থলপথে দেশে প্রতিদিন চোরাচালানের মাধ্যমে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার সোনার অলঙ্কার বার প্রবেশ করছে। এই হিসাবে বছরে প্রায় ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার বা তারও বেশি সোনা অবৈধভাবে প্রবেশ করছে দেশে। বাংলাদেশ মূলত আন্তর্জাতিক সোনা চোরাচালান চক্রের ট্রানজিট রুট। স্বর্ণ চোরাচালান পাচারকারীদের চক্র ছড়িয়ে আছে দেশে-বিদেশে। সীমান্ত এলাকায়ও আছে পাচারকেন্দ্রিক চক্রের সদস্যরা। সীমান্ত এলাকা ঝিনাইদহ- আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার পর সীমান্তের স্বর্ণ পাচার চক্রের বিষয়ে আলোচনায় এসেছে। প্রাথমিক তদন্তের খবর অনুযায়ী, তিনি ঝিনাইদহ আশপাশের জেলার সীমান্ত এলাকায় স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের নিয়ন্ত্রক ছিলেন। কয়েকটি চালানের ২০০ কোটি টাকার সোনা মেরে দেওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বে গত ১৩ মে ভারতের কলকাতায় খুন হয়েছেন আনোয়ারুল আজিম আনার।

 গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, দেশে  বৈধ-অবৈধ সোনা প্রবেশের মূল পথ ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কিছু আসে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে।

২০২২ সালে  বৈধভাবে দেশে ৪৬ লাখ ভরি সোনা এসেছে। তবে তাঁদের ধারণা, সময় অবৈধভাবে এসেছে প্রায় ৯৮ লাখ ভরি সোনা এমনটাই ধারণা দিয়েছে বিমানবন্দরের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। গত ১০ বছরে বিমানবন্দরের শুল্ক গোয়েন্দা তদন্ত অধিদপ্তর, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), পুলিশ এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) হাজার ৫৮৩ কেজি সোনা জব্দ করেছে। বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ভারতের সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় চোরাই সোনার চালান জব্দের ঘটনা বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে সীমান্ত এলাকায় ৫৪৫ কেজি সোনা আটক করেছে বিজিবি।

 গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিমানবন্দর সীমান্ত এলাকায় যে পরিমাণ সোনা ধরা পড়ছে, পাচার হচ্ছে তার কয়েক গুণ বেশি। বিমানবন্দর থেকে অবৈধ সোনার চালান বের করতে অর্থের বিনিময়ে সহযোগিতা করেন অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। যারা সোনাসহ ধরা পড়েন, তারা প্রায় সবাই বাহক। কারবারি চক্রের পৃষ্ঠপোষকদের নাম প্রকাশ পায় না। মূল হোতারা অর্থাৎ গডফাদাররা ধরা না পড়ায় সোনা চোরাচালানও বন্ধ হয় না।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে সোনা চোরাচালানের ৬৩১টি মামলার তদন্তাধীন। সোনা পাচারের গডফাদারদের বিরুদ্ধে ২১টি মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তবে বছরের পর বছর পার হলেও এসব মামলার তদন্তে অগ্রতি আশানুরূপ নয়। সিআইডির কাছে স্বর্ণ চোরাকারবারিদের তালিকা রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। মাফিয়াদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত চলছে।

 গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, স্বর্ণ চোরাচালানীর মাফিয়া চক্র কত নিষ্ঠুর নির্দয় হতে পারে তার সম্প্রতিকালের উদাহরন এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যা মামলার তদন্তাধীন বিষয়টি। বাংলাদেশ থেকে এই এমপিকে টোপ দিয়ে ভারতের কলকাতায় নিয়ে হত্যা করে লাশ টুকরা টুকরা করে কিমা বানিয়ে গুম করেছে। লাশের টুকরা কিমার অংশ উদ্ধার করা হলেও এমপি আনারই যেই সেই ব্যক্তি তা তদন্তে প্রমাণ করতে পারেনি এখনো। তদন্তে বলা হয়েছে, এমপি আনার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন শীর্ষ একজন সোনা চোরাকারবারি। তিনি ভারতে সোনা পাচার করতেন। কমিশনের বিনিময়ে এতে সহযোগিতা করত বন্ধু আনোয়ারুলের নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি চক্র। চক্রটি বিভিন্ন সময় কয়েকটি চালানের ২০০ কোটি টাকার সোনা আটকের কথা বলে মেরে দেওয়ার পর শাহীন অন্য চক্র বেছে নেন। এসব নিয়ে দ্বন্দ্বেই এমপি খুন হয়েছেন। এমপি খুনের পর আক্তারুজ্জামান শাহীন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়ে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যান।

অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) স্বর্ণ চোরাচালানের মাফিয়ার তালিকায় আছে শফিকুল ইসলাম ওরফে গোল্ডেন শফি। নব্বইয়ের দশকে ফেরি করে গামছা বিক্রি করতেন তিনি। কাস্টমস কর্মকর্তাদের পক্ষে হত্যা মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে তাদের সঙ্গে তিনি সখ্য গড়ে তোলেন।

এই সখ্য কাজে লাগিয়ে তিনি একপর্যায়ে গড়ে তোলেন স্বর্ন চোরাচালানের নেটওয়ার্ক। স্বর্ণ চোরাচালানোর সঙ্গে জড়িত অন্য বড় কারবারিদের বেশিরভাগই তার শিষ্য চক্রের সদস্য। শফির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনের একটি মামলা তদন্ত করছে সিআইডি। স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় আছে মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরের নামও। শফির অন্যতম সহযোগী মনির। ২০২০ সালের ২১ নভেম্বর মেরুল বাড্ডার বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ্যাব।

তার বাসা থেকে বিপুল স্বর্ণ উদ্ধারের মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সম্প্রতি তিনি খালাস পেয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকায় সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত হিসেবে আছে চট্টগ্রামের আবু আহমেদের নাম। তিনি চট্টগ্রামে সোনা চোরাচালানের গডফাদার। তার ৭২১ কোটি ১৭ লাখ টাকার সম্পদের খোঁজ পেয়েছে সিআইডি। সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে আদালতে।

স্বর্ন চোরাচালান মানি লন্ডারিং মামলা নিয়ে কাজ করা সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের সাবেক বিশেষ সুপার হুমায়ূন কবির বলেছেন, স্বর্ণ চোরাচালানের হোতারা সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে।

 

 

 

×