ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১

বাগান তৈরির অনুপ্রেরণা চিকিৎসক-শিক্ষক দম্পতি

গাছগাছালিতে ভরা ছাদ শহরে গ্রামীণ পরিবেশ

রাজু মোস্তাফিজ

প্রকাশিত: ২২:২৯, ২২ অক্টোবর ২০২৪

গাছগাছালিতে ভরা ছাদ শহরে গ্রামীণ পরিবেশ

বাড়ির ছাদে বাগান। পরিচর্যা করছেন বেলাল-ডেইজী দম্পতি

পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে। গাছগাছালিতে ভরে আছে ছাদসহ পুরো বাড়ি। শহরের মাঝে যেন গ্রামীণ পরিবেশ। পূবের আকাশ ফর্সা হতেই এই ছাদ বাগানে আসে নানা জাতের পাখি। বাগানের যেদিকে তাকাই ফল, ফুলে ভরে আছে পুরো বাগান। প্রতিটি গাছেই যতেœর ছোঁয়া। সবুজের সমারোহে চোখ জুড়ে যায়। এত সুন্দর করে সাজিয়েছেন ডাক্তার ও শিক্ষক দম্পতি। কাক ডাকা ভোরে এই দম্পতি ছাদবাগানের কাজে লেগে যান। একজন ফল, ফুল আর সবজি গাছের যতœ করেন। অপরজন ছাদের হাউসের দেশী মাছগুলোর খাবার দেন, হাউস পরিষ্কারসহ নানা কাজ করেন। 
রংপুর শহরের কেরানীপাড়ায় তাদের বাড়ি। এই দুজন কুড়িগ্রাম জেলার মানুষ। অবসরপ্রাপ্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আজিজুল ইসলাম বেলাল অপরজন রংপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাজেদা বেগম ডেইজী। এই দম্পতি প্রথমে শখেরবশে ছাদবাগান শুরু করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, বৈশি^ক উষ্ণায়ন কমানোর উদ্দেশে নানা পরিকল্পনা নেয়। ২ হাজার ২শ’ স্কয়ার ফুট এই ছাদ বাগানের একদিকে ফুল, অপরদিকে ফল ও সবজি এবং দুটি বড় বড় হাউসে টেংরা, কৈ, শিং, মাগুর ও পুঁটিসহ চাষ করছেন দেশীয় মাছ। এ সমস্ত মাছ, সবজি আর ফল চাষ করে সারাবছর নিজের বাড়ির চাহিদা পূরণ করে পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে তা বিতরণ করেন এই দম্পতি।
বাগান ঘুরে দেখা যায়, বাগানে কলা, ডালিম, আনারস, লেবু, আম, পেয়ারা পেঁপে, ড্রাগন, কামরাঙ্গা ফলের গাছ। অধিকাংশ গাছে ফল ধরে আছে। পুঁইশাক, পাটশাক, লালশাক, লাউশাক, সজনে শাক, কলমি শাক রয়েছে বাগানে। শসা, বেগুন, টমেটো, লাউ, কুমড়া, বরবটি, শিমসহ নানা পদের সবজি। আছে আদা মরিচ,  পেঁয়াজ, হলুদ চিনা বাদাম গাছ। ফুলের মধ্যে রক্ত জবা, নয়নতারা, কামিনী, গন্ধরাজ, রঙন, ক্যামেলিয়া, অর্কিড, বিভিন্ন জাতের ্অ্যাডেনিয়াম ফুল মাধবীলতা, শিউলী, কাঁঠালচাপা বেলী,  গোলাপ, কাশফুল, অ্যালমু-াসহ নানা জাতের দেশী বিদেশী ফুলে ভরা এই বাগান। 
অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাজেদা বেগম ডেইজী জানান, ২০১৮ সালের দিকে কয়েকটি টবে ফুলের গাছ লাগিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করি। সময় যতই যায় গাছগুলোকে নিজের সন্তানের মতো যতœ শুরু কর্।ি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে। আমি শিক্ষক মানুষ সারাদিন স্কুলে কাটাতে হতো। তখন বাগানে এত সময় দিতে পারতাম না। এখন অখ- অবসর সব সময় এর যতœ করি। প্রায় সময় কৃষিবিদদের কাছে পরামর্শ নেই ও ইউটিউব দেখে বাগানে সবজি ফুল ও ফলের চাষের পদ্ধতি শিখি। তিনি আরও জানান আমাদের বাগানে কোনো রাসায়নিক সার প্রয়োগ করি না।

জৈবসার, কিচেন কম্পোস্ট, মাছের বর্জ্যপানি এবং খৈইল দেই। প্রতিমাসে খরচ হয় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। সাজেদা বেগম আরও জানান বাগানে আসলে মনে দারুণ প্রশান্তি লাগে। প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা কাজ করি। প্রতিটি গাছ আমার সন্তানের মতো। ওদের দেখলেই বুঝতে পারি ওদের খাবারের সংকট হচ্ছে কিনা। প্রতিদিন যে পরিমাণ সবজি আর ফল উৎপাদন হয় তা আামার পরিবারের চাহিদা পূরণ করে পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনদের কাছে বিতরণ করি। যা সত্যিই খুব আনন্দের। 
ডা. আজিজুল ইসলাম বেলাল জানান, আমি বাগানে গেলেই মন ভরে যায়। ছোট বেলার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। বিলে মাছ ধরা, সবজির খেতে সবজি তোলার কথা মনে পড়ে যায়। বিকেলে ছাদে দক্ষিণা ঠা-া বাতাসে সব কিছু এলোমেলো করে দেয় তখন আরও ভালো লাগে। অধিকাংশ মানুষ ছাদ বাগানে সবজি, ফুল ও ফলের চাষ করে। কিন্তু আমাদের বাগানে সবকিছুর পাশাপাশি মাছের চাষ করছি। এ জন্য ছাদের ওপর বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে দুটি হাউস।

এখানে কৈ, টেংরা, মাগুর, শিং, পুঁটিসহ বিভিন্ন প্রকার দেশী মাছের চাষ করছি। দুপুরের চড়া রোদের কারণে কচুরিপানা লাগানো হয়েছে। ঠা-ার মধ্যে মাছ থাকে। অতিরিক্ত কচুরিপানা হলে তখন জৈব সার হিসেবে গাছের গোড়ায় দেওয়া হয়। এ ছাড়া হাউজের পানি গাছের জন্য খুব উপকারী। প্রতিদিন দু’বেলা খাবার দেই। তখন মাছের ছুটাছুটিতে আনন্দে ভরে উঠে মন। ভবিষ্যতে বারোমাসি কাঁঠাল ও ভিয়েতনামী নারকেল গাছ লাগাব। 
এই দম্পতি জানান তাদের বাজারের সবজি কখনোই কিনতে হয় না যদি রুচির পরিবর্তন করতে চান তখন বাজার থেকে কিছু সবজি কিনে নিয়ে আসেন। এই অবসর কালীন সময়ে দুজনেই ভীষণ ব্যস্ত তাদের বাগান নিয়ে। শুধু ছাদে নয় বারান্দায়, ঘরে নানা জাতের দেশী বিদেশী গাছে ভরা তাদের বাড়ি। এটি যেন পাখিদের অভয় অরণ্য। তারা জানান কয়েকদিন আগে বাগানের গাছে ঘুঘু পাখি বাচ্চা দিয়েছিল। পাখির ছানা বড় হলে আপন মনে নিয়ে যায় তাদের। তাদের বাগান দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ আসেন। নিয়ে যায় ছাদ বাগান তৈরির অনুপ্রেরণা।
সময়ের সঙ্গে এ বাগান এখন আর শৌখিনতার জায়গায় নেই। নিরাপদ সবজি দিয়ে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদাপূরণ, পারিবারিক বিনোদন এবং অবসর কাটানোর এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে এ ছাদ বাগানগুলো। বাংলাদেশের শহুরে কৃষি ব্যবস্থার শৌখিন পদযাত্রা সময়ের বিবর্তনে এক সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিতে যাচ্ছে ছাদ বাগান।

×