ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১

গেন্ডারিয়ার পুরাকীর্তি বাঁচানোর আকুতি

‘রীনা ব্রাউন’ সিনেমার নান্দনিক সেই বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে!

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২২:০৯, ২১ অক্টোবর ২০২৪; আপডেট: ০০:৫৯, ২২ অক্টোবর ২০২৪

‘রীনা ব্রাউন’ সিনেমার নান্দনিক  সেই বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে!

গেন্ডারিয়ায় শত বছরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি (ওপরে)। ‘রীনা ব্রাউন’ সিনেমায় দেখানো বাড়িটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণের বদলে ভেঙে ফেলার তোড়জোড় চলছে

সিনেমাটির নাম ছিল ‘রীনা ব্রাউন।’ বেশি আগের কথা নয়, ২০১৭ সালে মুক্তি পায়। শামীম আকতারের অসাধারণ নির্মাণ! গল্পটাও ভুলে যাওয়ার মতো নয়। হ্যাঁ, আলাদা আলাদা ধর্মে বিশ্বাসী দুই তরুণ-তরুণী ছিল সিনেমার মূল চরিত্র। ভালোবাসার টানে পরস্পরের কাছে চলে আসে তারা। তবে সময়টা ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা। কারণ ততদিনে বাঙালির ওপর একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। দখলদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটেই গভীর এক ভালোবাসার গল্প বলার চেষ্টা। আর এ গল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছিল পুরান ঢাকার অত্যন্ত নান্দনিক একটি বাড়ি। গেন্ডারিয়ার ১৬ দীননাথ সেন সড়কে অবস্থিত বাড়িতে ২০১৫ সালে শূটিং হয়েছিল ‘রীনা ব্রাউন’র। সিনেমায় বাড়িটি দেখানোও হয়েছে ডিটেইলে। নিপুণ দৃশ্যায়নের কল্যাণে বাড়ির স্থাপত্যশৈলী চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছিল। স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, এখনো অনেকে গেন্ডারিয়ায় গিয়ে সিনেমায় দেখানো বাড়িটির খোঁজ করেন। সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করেন।  
তবে এটি শুধু সিনেমার বাড়ি নয়, দৃষ্টিনন্দন এক পুরাকীর্তি। ‘সেভ দ্য হেরিটেজ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভবনের বর্তমান বয়স প্রায় ১২৬ বছর। ১৮৯৮ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। নির্মাণ করেন মানিকগঞ্জের মত্ত গ্রামের বাসিন্দা তারক বন্ধু মিত্র। স্কুল পরিদর্শক ছিলেন তিনি। সড়কটির নাম যার নামে সেই দীননাথ সেন মিত্রও ছিলেন মানিকগঞ্জের। আরেকটি পরিচয়ের কথা না উল্লেখ করলেই নয়, দীননাথ বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেনের পিতা। স্থানীয়দের কেউ কেউ ভুল করে বাড়িটি সুচিত্র সেনের বাবার বলেও দাবি করে বসেন।
সে যাই হোক, প্রথম থেকেই গেন্ডারিয়ার অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছিল এই সুরম্য ভবন। এক একর জমির ওপর আড়াই ফুট বেদি। তার ওপর নিও ক্ল্যাসিকাল স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন দাঁড়িয়ে। চোখ ধাঁধানো একতলা ভবন দৈর্ঘ্যে প্রায় ৫৬ ফুট। প্রস্তে ৩৩ ফুট। ভবনটির দক্ষিণ-পূর্ব দিকের অবয়ব করিনথিয়ান ক্যাপিটাল যুক্ত সারিবদ্ধ কলাম এবং অর্ধবৃত্তাকার খিলান দিয়ে অলংকৃত করা হয়েছে। পূর্ব দিকে ৫টি অর্ধবৃত্তাকার খিলানসহ করিনথিয়ান ক্যাপিটাল যুক্ত কলামের সারি। ওপরে নকশা করা ডেন্টিলসহ টানা কার্নিশ। সবার ওপরে নকশা করা প্যারাপেট। দক্ষিণ এবং পূর্ব দুই দিকের কাঠামোর ঠিক মাঝখানে মাথার মুকুটের আকৃতিতে করা বিশেষ নকশা।    
পুরান ঢাকার প্রাচীন স্থাপনা নিয়ে গবেষণাসহ নানা কাজ করে থাকে আরবান স্টাডি গ্রুপ। গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলামের ভাষ্য, বহু ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে তারক বন্ধু মিত্রের বাড়ি। প্রাচীন ঢাকার বাসিন্দাদের স্থাপত্য রুচি এবং আভিজাত্য সম্পর্কেও একটি ধারণা দেয়। যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা গেলে বাড়িটি আরও আকর্ষণীয় হতে পারত বলে মনে করেন তাইমুর।  
কিন্তু হায়! সেটি তো হচ্ছেই না, উল্টো ঐতিহ্য ধ্বংসের নিষ্ঠুর পথে হাঁটছে কিছু লোক। এরই মাঝে তারা পুরাকীর্তিটির উল্লেখযোগ্য অংশ ভেঙে ফেলেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে, গোপনে গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলছে ধ্বংসলীলা।
সোমবার দূর থেকে লুকিয়ে তোলা একটি ছবিতে দেখা যায়, মূল কাঠামোটি দাঁড়িয়ে আছে বটে। হাতুড়ি চালানো হয়েছে ভেতরে।  এতে ভবন কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা বোঝা যায় বাইরে ফেলে  রাখা কংক্রিটের স্তূপ দেখে। অবশ্য কারা বাড়ির বর্তমান মালিক বা কারা কেন ভাঙছে সে বিষয়ে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তার পরও বাড়িটি রক্ষার জোর দাবি উঠেছে।  
‘রীনা ব্রাউন’ সিনেমার অভিনয় শিল্পী নাফিজ বিন্দু শূটিংয়ের স্মৃতি  হাতড়ে বলছেন, নতুন ভবন তো কতই দেখি। পুরনো এই বাড়ির টান ভুলতে পারি না। অদ্ভুত এক মায়া অনুভব করি। ভাবতেই অবাক লাগে, এমন একটি অতীত কেউ মুছে ফেলার চেষ্টা করতে পারে! অর্থের লোভে ঐতিহ্য ধ্বংস না করে সিনেমায় যেভাবে বাড়িটি আছে সেভাবেই ধরে রাখার আকুতিও জানান নাফিজ।
একই প্রসঙ্গে গে-ারিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা সংস্কৃতিকর্মী মানজার চৌধুরী বলেন, সাধনা ঔষধালয় লাগোয়া পুরনো নান্দনিক ভবনটি আমরা শৈশব থেকে দেখে এসেছি। এই ভবন অতীত গৌরবের কথা মনে করিয়ে দেয়। ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে ভবনটি রক্ষার দাবি জানান তিনি।
বসে নেই আরবান স্টাডি গ্রুপও। এইসব বাড়ি রক্ষায় নিয়মিত আন্দোলন সংগ্রাম করছেন তারা। এ ক্ষেত্রেও ছাড় দিতে নারাজ। তাই যথারীতি প্রতিবাদে সরব হয়েছে। গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম বলেন, ভবনটির কোনো রকম ক্ষতি করা যাবে না মর্মে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। এর পরও ভাঙা হচ্ছিল। তবে সোমবার আমরা থানাকে অবহিত করে প্রতিকার চেয়েছিল। জিডি করা হয়েছে। এর পর থেকে পুরাকীর্তি ধ্বংসের কাজ বন্ধ রয়েছে বলে জানান তিনি। বলেন, আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। মানববন্ধনসহ প্রতিবাদী কর্মসূচি গ্রহণ করেছি আমরা। কিন্তু সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে দেশের বর্তমান বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগে ভবনটি পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা হবে। যেটুকু ক্ষতি করা হয়েছে তা রিস্টোরেশন করে আগের চেহারায় আনারও দাবি জানান তিনি।

 

×