ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১

প্রকৃতিতে হেমন্তের ছোঁয়া

রেজা ফারুক

প্রকাশিত: ২১:২২, ২০ অক্টোবর ২০২৪

প্রকৃতিতে হেমন্তের ছোঁয়া

চিরায়ত বাংলার প্রকৃতিতে বিমুগ্ধ হেমন্তের মোহনীয় আবহের

চিরায়ত বাংলার প্রকৃতিতে বিমুগ্ধ হেমন্তের মোহনীয় আবহের চিরচেনা রূপটা আবারও ফিরে এসেছে স্বমহিমায়। প্রহর শুরু হয়েছে নগর জীবনের ছুঁয়ে যাওয়া হেমন্ত প্রবাহের। পদযুগলে পরে সোনার নূপুর হেমন্ত নাইয়র এসেছে। আর এসেই রাঙিয়ে দিয়েছে বাংলার মন তার বর্ণোজ্জ্বল রঙে। পথে পথে বাতাসে ভাসে হেমন্তের ধুলা। কিছু ফুলও থাকে পড়ে নির্জন ব্যালকনিতে, কিছু ঝরাপাতা। কাঁঠালিচাঁপার গন্ধে যায় ডুবে সারাটা দুপুর, ঘু ঘু ডাকা নিঝুম বিকেল। এই হলো হেমন্তÑ এই হলো নবান্নের অনুপম রূপ।
শিশির ভেজা পায়ে আসে হেমন্ত নিবিড় আয়োজনে। প্রকৃতিতে যেমন হেমন্তের রয়েছে প্রবল প্রভাব। তেমনি অনন্তকাল ধরে বাঙালি সংস্কৃতি, কৃষিপ্রধান এই বাংলার মাঠে-ঘাটে, পথে প্রান্তরে, নদী, বিল, হাওড়, বন-অরণ্য গ্রামে ও শহরে হেমন্তের ছোঁয়া রচনা করে এক অনাবিল মুগ্ধ চিত্রবীতি। রচিত হয় শব্দ, অক্ষরপুঞ্জ হৃদয়স্পর্শী অজস্র পঙ্ক্তিমালা।
‘প্রথম ফসল গেছে ঘরে,/ হেমন্তের মাঠে ঝরে/ শুধু শিশিরের জল,/ অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে/ হিম হয়ে আসে/ বাঁশপাতা মরাঘাসÑ আকাশের তারা! বরফের মতো চাঁদ চালিছে ফোয়ারা’- রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ এভাবেই হেমন্তের কবিতার আর্শিতে প্রতিবিম্বিত করেছেন এক অনন্য রূপকল্প আর স্বপ্ন ও বাস্তবজগতের বিচিত্র বর্ণের মনোলোভা রূপে।
শিশির আর ধুলাডোবা চাষি আর রাখালের গরুর পাল নিয়ে খেত-মাঠে যাওয়ার যে দৃশ্য হেমন্তের রৌদ্রাঙ্কিত সকালের ক্যানভাসে ফুটে ওঠে, তা কেবল এই ষড়ঋতুময় বাংলায়ই প্রত্যক্ষ করা যায়। কার্তিক কিংবা অঘ্রাণের দুপুরে হেমন্ত যেরূপে আবির্ভূত হয়Ñ অপরাহ্ণে তার রূপটা যেন আরও মোহনীয় আর মায়াবি মুগ্ধতায় স্ফুরিত হয়ে ওঠে। আর সন্ধ্যায় নারিকেল পাতার ঝালরের ফিনকি গলিয়ে হেমন্তের গোল চাঁদের মনিরতœ এসে ছড়িয়ে পড়ে এই মৃত্তিকায়, ঘাসে, পথের ধুলায়।

রাত যত গভীর হয়- হিম হিম মৃদু ঠান্ডা বাতাসের আঙুল যেন পিয়ানোর রিডের মতো মেঘশিরিষের সবুজ খাঁজকাটা পত্রপল্লবে তোলে এক অপূর্ব গুঞ্জরণ। একই অঙ্গে অনেক রূপের বর্ণ ধারণ করে হেমন্ত বাংলার গ্রামে-গ্রামে যে রং ছড়িয়ে দেয় তার তুলনা কেবল হেমন্তের সঙ্গেই চলে।
হেমন্ত এলেই এই বাংলার মাঠে-প্রান্তরে এক হলুদ রঙের বিস্তীর্ণ প্রেক্ষাপট তার অমোঘ বিশালতায় রেশমি পালক ছড়িয়ে দেয়। হলদে ধানের খেতে হাওয়ার দাপাদাপি এক চিরায়ত নৃত্যপরা বাংলার কৃষি ঐতিহ্যকে চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলে। তারপর শুরু হয় ধানকাটা। ধানের আঁটি গরু আর মোষের গাড়িতে করে কৃষকের বাড়ি বয়ে নিয়ে যেতে যেতে গাড়োয়ানের কণ্ঠে উৎসারিত হয় যে ভাওয়াইয়া সংগীত আর বাঁশির সুরের এক পাগল করা, হৃদয় নিংড়ানো সুরমূর্ছনা- এ ছবিটা এই বাংলা ছাড়া কোথাও কি খুঁজে পাওয়া যায়!

উঠোনের এক পাশে ধানের আঁটির স্তূপ থেকে থোকা থোকা ধানের আঁটি খুলে ধান খসিয়ে নিয়ে রাতভর উনুনে সিদ্ধ করার যে দৃশ্যাবলি, কৃষাণীদের অবিশ্রান্ত ব্যস্ততা আর নতুন ধানের ম-ম গন্ধে বাতাস ফুরফুরে হয়ে ওঠার নৈসর্গিক পরিবেশকে হেমন্তের এক অনাবিল অবগাহন ছাড়া অন্য কিছু কি বলা যায়! ধান শুকিয়ে ঢেঁকি অথবা কলে ধান ভাঙানোর পর নতুন চালের সুমিষ্ট-স্নিগ্ধ ঘ্রাণ শরীরে মেখে ঘুরে বেড়ানো প্রতিটি প্রহরে বাংলার চিরন্তন প্রতিচ্ছায়াটা ঘুর ঘুর করে ঘুরে বেড়ায় যেনো এই বাংলারই জল, হাওয়া আর মাটির মনোভূমে। ঘরে ঘরে তৈরি হয় নতুন ধানের পিঠা-পুলি।

এ তো গেল হেমন্তের এক রূপ। এ রূপের বিপরীতে হেমন্ত আসে নগর জীবনে নানারূপে। বিশেষত প্রাত্যহিক জীবনে হেমন্তের আগমনী সংগীত বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির মতোই বর্ণোজ্জ্বল হয়ে ওঠে জীবনধারা। হেমন্তের রয়েছে এক চিরায়ত বাঙালিয়ানার অনিন্দ্য সুন্দর প্রতিচ্ছায়া। নবান্নের ঘ্রাণের বিমুগ্ধতা গ্রাম বাংলার চিরন্তন আবেশ হেমন্তকে এক ভিন্ন আমেজে প্রকৃতিতে তার সৌন্দর্যের বর্ণিল রূপ ঐশ্বর্যকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায় মায়াবি কারুকাজে। একদিকে নবান্নের আগমনী সংগীত, অন্যদিকে শীতের আবহ অঙ্গে জড়িয়ে দেয় এক অনুপম মুগ্ধতার রেশ। রোদ আর কুয়াশায় ভেজা হেমন্তের সকালবেলাটা যেন ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র রূপে আবির্ভূত হতে দেখা যায়।
গ্রামে-গ্রামে হেমন্তের মুগ্ধতার শিস্ দিয়ে যাওয়া হাওয়ার রেশ এসে ছড়িয়ে পড়ে নগর জীবনেও। প্রকৃত পক্ষে সারা বাংলাদেশটাই তো এক সবুজ-স্বর্ণালী গ্রাম। বাংলার প্রতিটি ঋতুতেই বাঙালির আবেগ-আনন্দ পড়ে উপচে ভিন্ন ভিন্ন আমেজে। সেই দৃশ্যপটই পরিলক্ষিত হতে দেখা যায় হেমন্তের রৌদ্রছোঁয়া, শিশির স্নিগ্ধ দৈনন্দিন জীবনের ছন্দোবদ্ধ নিবিড় দিনযাপনে।

×