ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২০ অক্টোবর ২০২৪, ৪ কার্তিক ১৪৩১

১৩১ দেশের অংশগ্রহণ, লাখো মানুষের পদচারণা

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২২:৪৭, ১৯ অক্টোবর ২০২৪

১৩১ দেশের অংশগ্রহণ, লাখো মানুষের পদচারণা

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে চলছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বইমেলা। নান্দনিকভাবে সাজানো একটি প্যাভিলিয়ন ঘুরে দেখছেন দর্শনার্থীরা

আমরা বাংলাদেশের মানুষরা বই-টই আর পড়ি কই? পাঠাভ্যাস একরকম শিকেয় তুলে রেখেছি। তবে অমর একুশে বইমেলা ঘিরে আমাদের যে আবেগ আগ্রহ তা অতুলনীয়। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমি এই মেলার আয়োজন করে। লেখক পাঠক প্রকাশকরা প্রাণের টানে ছুটে যান সেখানে। পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হন।

আর গোটা দুনিয়ার বই-সংশ্লিষ্ট মানুষেরা যে মেলায় বিপুল কৌতূহল নিয়ে যোগ দেন, সেটি ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা। বই নিয়ে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ আয়োজন। প্রতিবছর অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে আসরটি বসে। সেই ধারবাহিকতায় গত ১৫ অক্টোবর উদ্বোধন করা হয় ৭৬তম আসরের। নিয়ম অনুযায়ী, ১৬ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে মূল মেলা। 
বিস্তৃত আলোচনায় যাওয়ার আগে ইতিহাসটা একটু স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। গত বছর, মানে ২০২৩ সালে আয়োজিত মেলায় অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেই সুবাধে এর ইতিহাস এবং চরিত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছিল। অনেকে জেনে অবাক হবেন, আজ থেকে অন্তত ৫০০ বছর আগে বইয়ের শহর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট। সেই প্রেক্ষাপটে ১৯৪৯ সালে পাউল গির্জায় প্রথমবারের মতো মেলাটি আয়োজন করা হয়। ১৮ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলা মেলায় অংশ নেয় ২০৫টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। বই প্রদর্শিত হয় ৮৪৪টি।

ঐতিহ্য ধরে রেখে এখনও মেলা আয়োজন করছে জার্মান পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স অ্যাসোসিয়েশন। মেলাটির প্রকৃত নাম ‘ফ্রাঙ্কফুর্টার বুচমেসে।’ বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা।’ আমাদের অমর একুশে বইমেলার সঙ্গে এই মেলার বড়সড়ো পার্থক্য আছে। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা ঠিক বই কেনার মেলা নয়। ‘বুক ট্রেড ফেয়ার’ বা বইয়ের বাণিজ্য মেলা। বই ঘিরে যত রকমের ব্যবসা বাণিজ্য হতে পারে তার সবই প্যাভিলিয়নে বা স্ট্যান্ডে উপস্থিত করা হয়। প্রাধান্য পায় বইয়ের স্বত্ব ক্রয় বিক্রয়ের বিষয়টি। মাত্র পাঁচ দিনের আয়োজন গোটা দুনিয়াকে প্রায় এক করে ফেলে! 
আয়োজকদের পাঠানো ই-মেইল এবং ওয়েবসাইট থেকে জানা যাচ্ছে, এবারও জমজমাট মেলা। এ এম মাইনের মেসে ফ্রাঙ্কফুর্টকে বইয়ের পৃথিবী বলেই মনে হচ্ছে। কয়েকতলা বিশিষ্ট ছয়টি প্রদর্শনী হলে একযোগে মেলা আয়োজন করা হয়েছে। মাঝখানে খোলা মাঠ। চারপাশ থেকে একে ঘিরে আছে প্রদর্শনী হলগুলো। আলাদা আলাদা হলেও প্রতিটি হলঘর একটি অন্যটির সঙ্গে যুক্ত। দর্শনার্থীরা ম্যাপ হাতে নিয়ে নিজের মতো করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অকারণ ঘোরাঘুরি নেই। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত।

মেলায় এবার অংশ নিয়েছে বিশ্বের ১৩১টি দেশ। আর এক্সিবিটর সংখ্যা ৪ হাজার ৩০০। প্রথম তিন দিনের তথ্য বলছে, গতবারের তুলনায়  ট্রেড ভিজিটর সংখ্যা ৯ ভাগ বেশি ছিল। নিয়ম মেনে শেষ দুই দিন মেলা সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। আয়োজকদের হিসাব অনুযায়ী, মেলায় আসা মোট দর্শনার্থী সংখ্যা দাঁড়াবে ১ লাখ ১৪ হাজার।     
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় বাংলাদেশসহ অংশগ্রহণকারী প্রায় সব দেশ সরকারিভাবে ন্যাশনাল স্ট্যান্ড বা প্যাভিলিয়ন নিয়েছে। এর বাইরেও আছে অনেক স্ট্যান্ড প্যাভিলিয়ন। সবকটিতেই বই। ট্রেড ভিজিটরদের মধ্যে প্রকাশকরা ছাড়াও আছেন তাদের এজেন্ট, গ্রন্থাগারিক, বাণিজ্যিক এবং পেশাদার সংঘ সমিতির কর্তাব্যক্তিরা। যোগ দিয়েছেন সফটওয়্যার, মাল্টিমিডিয়া, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, কনটেন্ট প্রভাইডাররা। নিজ নিজ জায়াগায় বসে বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন তারা। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন ভাষায় লেখা বইয়ের স্বত্ব ক্রয় বিক্রয় করা হচ্ছে। বৈধভাবে অনুবাদের জন্য চুক্তি হচ্ছে। 
অবশ্য ব্যবসা গুরুত্ব পেলেও, আয়োজনটি শুধু ব্যবসায়ীদের নয়। প্রতিদিনের মেলায় অংশ নিচ্ছেন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত লেখক কবি অনুবাদক দার্শনিক শিক্ষাবিদ প্রতœতত্ত্ববিদ শিল্পী চলচ্চিত্র প্রযোজকসহ বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। মেলায় রাখা হচ্ছে আকর্ষণীয় অনেক ইভেন্ট। বিশেষ বক্তৃতা, প্রশ্ন উত্তর পর্ব, প্রদর্শনী, কিড্স ফেস্টিভ্যাল, অটোগ্রাফ সেশন আরও কত কী!  অংশগ্রহণকারী দেশ বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও বিচিত্র অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। আয়োজকদের দেওয়া তথ্য: পাঁচদিনে ১৫ ভাগে  ৬৫০টি অনুষ্ঠান হবে। এসব আয়োজনে অংশ নেবেন প্রায় ১ হাজার লেখক এবং বক্তা। 
বইমেলার এবার থিম কান্ট্রি ইতালি। ইতালি বিশেষভাবে নিজেদের তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছে। 
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ স্ট্যান্ড পেয়েছে ৬ নম্বর হলে। ৬ দশমিক শূন্য নম্বর স্ট্যান্ডে বই নিয়ে আছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। বাংলাদেশ স্টলের উদ্বোধনী দিন উপস্থিত ছিলেন বার্লিনে বাংলাদেশ দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স কাজী মুহাম্মদ জাবেদ ইকবাল, গ্রন্থকেন্দ্রের নতুন পরিচালক আফসানা বেগম এবং কবি সাজ্জাদ শরীফ। স্ট্যান্ডের দায়িত্বে আছেন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক নিজে। 
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা আজ রবিবার শেষ হবে।

×