ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

পুতুলের জন্য

দিলরুবা নীলা

প্রকাশিত: ০১:১৪, ১৯ অক্টোবর ২০২৪

পুতুলের জন্য

তিথিরা আজকে নতুন বাসায় উঠেছে

তিথিরা আজকে নতুন বাসায় উঠেছে। বাসাটা ভীষণ সুন্দর। এখান থেকে তিথির স্কুল কিছুটা দূরে তারপরও মা এ বাসাটাই পছন্দ করেন কারণ এ বাসার ভাড়াটা একটু কম। ভাড়ার তুলনায় বাসাটা বেশ সুন্দর। তাছাড়া বাড়িওয়ালাও এখানে থাকেন না। পুরো বাড়িই ভাড়াটিয়াদের দখলে। 
বাসায় থাকবে দুজন। তিথি আর ওর মা।
তিথি এবার ক্লাস থ্রিতে পড়ে। পুরাতন বাসায় ওর আলাদা রুম না থাকলেও এ বাসায় ওর আলাদা রুম আছে। খুব গোছানো রুম। তিথির মা নিজ হাতে সুন্দর করে ওর রুমটা গুছিয়ে দিয়েছে। ছোট একটা খাট, একটি ড্রেসিং টেবিল, একটা পড়ার টেবিল, চেয়ার। যদিও রাতে তিথি এ খাটে ঘুমায় না। রাতে তিথি মায়ের সাথে ঘুমায়। তিথির তো বাবা নেই। ওর বাবা মারা গেছেন গত বছর। তখন তিথি ক্লাস টুতে পড়তো। বাবার কথা তিথি একদমই ভোলেনি। বাবা থাকতে ও বাবা-মায়ের মাঝখানে ঘুমাত। এখন সে মায়ের বুকে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকে। 
তিথির মা স্কুল শিক্ষক। তিথিও তার মায়ের স্কুলে পড়ে। এজন্য একটা বিশেষ সুবিধা হয়েছে। তাহলো তিথি তার মায়ের সাথে স্কুলে যায় আবার মায়ের সাথেই ফিরে আসে। মাকে ছেড়ে তার একা থাকতে হয় না। 
তিথির রুমে একটা খেলনা রাখার বিরাট বাক্স আছে। সেখানে একদম ছোটবেলা থেকে যেসব খেলনা দিয়ে সে খেলেছে তার সবই জমা করে রেখেছে। তিথি খুব লক্ষ্মী মেয়ে। সে কোনো খেলনাই নষ্ট করে না। সুন্দর করে খেলে আবার রেখে দেয়।
তিথি সাজতে খুব ভালোবাসে, রোজ বিকেলে ওর রুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে। ওর মা তার ঘরে বিছানায় শুয়ে আছে।
তিথি ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যায়। দেখে আয়নার ভেতরে ওর বয়সী একটা মেয়ে। বসে বসে কাঁদছে।
তিথি ভীষণ ভয় পেয়ে দৌড়ে মাকে ডেকে তোলে।
মা, মা তাড়াতাড়ি ওঠো।
তিথির মায়ের ঘুম ভেঙে যায়।
কী হয়েছে তিথি মা?
মা, আমার ঘরে এসো দেখবে।
তিথি মায়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে। মাকে দাঁড় করায় আয়নার সামনে।
কী হয়েছে তিথি মনি বলবে তো?
মা, আয়নার ভিতরে একটা মেয়ে আছে। 
আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। 
তিথি এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে।
আরে, কী বলো এসব? আয়নার ভিতরে মানুষ কী করে যাবে? তুমি নিশ্চয়ই ভুল দেখেছ। মা তিথিকে বোঝানোর চেষ্টা করে।
না, মা সত্যি। আমি সত্যিই একটা মেয়েকে দেখেছি।
তিথি মনি, তুমি তৈরি হয়ে নাও, আমরা ঘুরতে যাব।
মেয়ের মনকে শান্ত করার জন্য তিথির মা তিথিকে নিয়ে বাইরে বের হন। এই শহরে তার অনেক আত্মীয়-স্বজনের বাসা। কিন্তু আজ তার কোথায় যেতে মন চাইছে না। আজ সে তার মেয়েকে নিয়ে রিক্সায় করে ঘুরবে। শহর থেকে অনেক দূরে যাবে। আজ তার মেয়েটার মন ভীষণ অশান্ত। এ সময়ে মেয়েটার প্রকৃতির কাছে যাওয়া খুব প্রয়োজন।

বেশ কিছু দিন হয়ে গেল তিথিরা এ বাসায় আছে। সেই যে প্রথম একদিন যে আয়নার মধ্যে মেয়েটাকে দেখেছিল আর কোনোদিন দেখেনি। তিথিও ভুলে গিয়েছে সেদিনের কথা। একদিন তিথির মা একটু দোকানে গিয়েছে। তিথি বাসায় একটা। একা থাকতে শিখেছে তিথি। একা থাকলে সে বসে বসে ছবি আঁকে। 
ওইদিন একমাত্র খাটের উপর বসে ছবি আঁকছিল তিথি। হঠাৎ করে ওর মায়ের ঘর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। 
তিথি ভয় না পেয়ে এক পা, দু’পা করে এগিয়ে যায় মায়ের রুমে। 
দরজার সামনে এসেই তার চোখ ছানাবড়া। এতো সেই মেয়ে। যাকে সে আয়নার ভিতরে দেখেছিল। সেই মেয়েই মায়ের খাটের উপর পা তুলে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কিন্তু অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার হলো আজ তিথির মেয়েটাকে দেখে মোটেও ভয় লাগছে না। বরং মায়া লাগছে। আহা কী মিষ্টি দেখতে মেয়েটা! কী হয়েছে মেয়েটার কাঁদছে কেন? 
নিশ্চয়ই কোনো বিপদে পড়েছে। মা তিথিকে সব সময় বলে কেউ বিপদে পড়লে তাকে অবশ্যই সাহায্য করতে হয়। মায়ের কথাটা মনে পড়তেই তিথি মেয়েটার কাছে এগিয়ে যায়। 
খাটের এক পাশে গিয়ে বসে জিজ্ঞেস করে, কাঁদছ কেন তুমি? কী হয়েছে তোমার?
মেয়েটি চোখ তুলে তাকায় তিথির দিকে।
বাহ্ কী সুন্দর দেখতে মেয়েটি। এত সুন্দর মেয়ের কী দুঃখ থাকতে পারে? তিথি মনে মনে ভাবে।
আমার পুতুল হারিয়ে গেছে। মেয়েটি কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে জবাব দেয়।
পুতুল হারিয়ে গেছে মানে? কোথায়? তিথি অবাক হয়ে জানতে চায়।
এই বাড়িতে এই ঘরেই আমার একটা পুতুল ছিল। সে পুতুলটা ভারি সুন্দর। লাল-নীল রঙের ফ্রক পরা। আমি এই ঘরেই তাকে রেখে গিয়েছিলাম। সেটি কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। 
ওহ এই কথা। তোমার নামটা তো জানা হলো না। কী নাম তোমার? 
আমার নাম আরিশা। 
বাহ্ ভারি সুন্দর নাম। শোনো আরিশা তোমার পুতুল যদি এ বাড়িতে হারিয়ে থাকে তাহলে তুমি  অবশ্যই ফেরত পাবে। কেয়ারটেকার আংকেলকে বলব। তিনি তোমার পুতুলটি কোথাও দেখেছেন কিনা। 
আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে আমি আর কাঁদব না। আরিশা মিষ্টি করে হেসে বলে। ওরা কথা বলছে এমন সময় দরজায় কলিংবেলের আওয়াজ। 
আরিশা বোধ হয় মা এসেছে। তুমি একটু বসো আমি দরজা খুলে আসি। বলেই তিথি দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে। দেখে ওর মা দাঁড়িয়ে। 
মা একটা জিনিস দেখবে এসো। তিথি মায়ের হাত ধরে তার রুমে নিয়ে আসে কিন্তু এসে দেখে আরিশা নেই। চলে গেছে। 
কী দেখাবে তিথিমনি? দেখাও। 
না, মা কিছু না। তিথি মায়ের কাছে কিন্তু বলে না। তবে আরিশার জন্য মন খুব খারাপ হয় ওর। 
তিথিরা যে বাড়িতে থাকে। সে বাড়ির কেয়ারটেকার থাকেন নীচ তলায়। তিথি তার কাছে যায়। তখন সে ফুল গাছে পানি দিচ্ছিল। 
আংকেল, একটা কথা জানতে পারি। 
কী কথা গো, মা?
আংকেল, আরিশা কে? 
আরিশা! আরিশা এ বাড়ির মালিকের মেয়ে। তোমার মতোই বয়স ছিল। 
ছিল মানে? কোথায় এখন সে। 
আরিশা মনি এক বছর হলো আক্সিডেন্টে মারা গেছে। ও মারা যাওয়ার পর ওর মা বাবা দেশের বাইরে চলে গেছে।
তাহলে ওকে যে আমি দেখলাম। বসে বসে কাঁদছে।
হ্যাঁ, গো মা। ওর আত্মা এখানে ঘুরে বেড়ায়, আমিও দু’ একদিন দেখেছি। তবে ভয় পেয়ো না, মা, ও কারো কোনো ক্ষতি করে না। 
আচ্ছা আংকেল, ওর কি কোন পুতুল ছিল? প্রিয় কোনো পুতুল? নীল রঙের জামা গায়ে সেই পুতুল। 
হ্যাঁ, ছিল তো। আহা কী সুন্দর পুতুল। ওর মামা বিদেশ থেকে এনে দিয়েছিল। সারাক্ষণ ওই পুতুলটা হাতে করে রাখত আরিশা মামনি। 
সেই পুতুলটা এখন কই আংকেল? 
জানি না তো, মা। ওদের সব জিনিসপত্র স্টোর রুমে রেখে দেওয়া হয়েছে।
আমাকে একটু নিয়ে যাবেন। আংকেল?
আমি পুতুলটা খুঁজে দেখব।
চলো মা, আমার সাথে চলো।
কেয়ারটেকার আংকেল তিথিকে নিয়ে যায় স্টোর রুমে। 
সেখানে অনেক খুঁজে খুঁজে বের করে আরিশার পুতুল।
তিথি পুতুলটা নিয়ে ওর ঘরে ড্রেসিং টেবিলের কাছে রেখে দেয়।
রাতে কখন যে আরিশা এসে পুতুলটা নিয়ে যায়। তিথি সকালে উঠে আর পুতুলটা দেখতে পায় না।
আরিশা পুতুলটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছে এ কথা ভেবে তিথি আনন্দ পায়। কিন্তু যখন মনে পড়ে আরিশা কখনও আর এ বাড়িতে আসবে না তখন ওর ভীষণ কষ্ট হয়। তিথি জানে প্রিয় পুতুলটির জন্যই আরিশা বার বার এখানে আসত।

×