ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দ্রোহ-দাহ স্বপ্নযাত্রা

সংস্কৃতি প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দ্রোহ-দাহ স্বপ্নযাত্রা

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দ্রোহ-দাহ স্বপ্নযাত্রা শীর্ষক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশনা

বৃষ্টিঝরা বিকেলে শোষণ ও বৈষম্যহীন স্বদেশের প্রত্যয়ে উচ্চকিত হলো একঝাঁক শিল্পিত কণ্ঠস্বর। সুরের আশ্রয়ে উচ্চারিত হলো গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার। গানে গানে ব্যক্ত হলো নতুন দিনের বারতা। সমবেত সংগীত পরিবেশনার সঙ্গে নাচের ছন্দেও ছিল সেই একই আহ্বান। নাচ-গানের সমান্তরালে ছিল কবিতার শিল্পিত উচ্চারণের আবৃত্তি পরিবেশনা। শুধু কি তাই? বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা থেকে মূকাভিনয় কিংবা ব্যান্ড সংগীতের পরিবেশনায় বর্ণিল রূপ নেয় গোটা আয়োজন।

শুক্রবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘দ্রোহ-দাহ স্বপ্নযাত্রা’ শীর্ষক নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশার প্রতিচ্ছবিময় আয়োজনটি। এ অনুষ্ঠানের আয়োজন ৩১টি সাংস্কৃতিক সংগঠনের মোর্চা গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্য। এ অনুষ্ঠানে প্রতিক্রিয়াশীল একটি চক্র দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিপন্থি কার্যক্রমের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে বলে আয়োজক সংগঠনের পক্ষ থেকে উষ্মা প্রকাশ করা হয়। 
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালনের মাধ্যমে এই সাংস্কৃতিক সমাবেশের সূচনা হয়। এ সময় উদীচীর শিল্পীরা গেয়ে শোনায় ‘এমন দেশে জনম মোদের বলিব কী আর ভাই’ শিরোনামের গান। পরে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের শিল্পীরা পরিবেশন করেন কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ শীর্ষক উদ্দীপনামূলক সংগীত। 
অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন উদ্বোধন করেন অভ্যুত্থানের শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বাবা শহিদুল ইসলাম ভুঁইয়া এবং প্রবীণ কৃষক নেতা ও প্রখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী রণজিৎ বাওয়ালী। উদ্বোধনী বক্তব্যে গণঅভ্যত্থানে শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বাবা শহিদুল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, ছাত্ররা  বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে। সেই সংগ্রাম করতে গিয়ে আমার একমাত্র সন্তান নিহত হয়েছে। তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব আপনাদের। 
সাংস্কৃতিক পর্বে লাঠি খেলায় অংশ নেয় চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের শিল্পীরা। নৃত্য পরিবেশন করে কত্থক নৃত্য সম্প্রদায়। দলীয় সংগীত পরিবেশ করেন বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, প্রগতি লেখক সংঘ, গণসংস্কৃতি কেন্দ্র, সংহতি সংস্কৃতি সংসদ, মাদল, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও সংজোয়ারের শিল্পীরা। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করেন সমাজ অনুশীলন কেন্দ্র ও সমাজ চিন্তা ফোরামের বাচিক শিল্পীরা। ব্যান্ডদলের পরিবেশনা রক ও র‌্যাপ ধারা সংগীত পরিবেশন করে ছিল সমগীত, গঞ্জে ফেরেশতা, ডিমোক্রেজি ক্লাউনস, নীল, টিম অ্যাজ অমিক্স, বেতাল, ভাটিয়াল শহুরে, দ্য কমরেডসের শিল্পীরা। ম. আবু হারুন টিটোর নির্দেশনায় ঢাকা ড্রামা মূকাভিনয় পরিবেশন করেন।
সমাবেশের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান লাল্টু। ঘোষণাপত্রে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতির সুযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাজার, মন্দির, ভাস্কর্য ভাঙচুর, ধর্র্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নির্যাতন, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, নারী নিপীড়ন, বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকদের লাঞ্ছনাসহ সকল নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়।

একইসঙ্গে মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে পিটিয়ে মানুষ হত্যা, পাহাড়ে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মাঝে সংঘাত সহিংসতা এবং খুনাখুনি করে প্রাণহানির ঘটনায় অপরাধীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানানো হয় ঘোষণাপত্রে। মফিজুর রহমান পরে ১২ দফা দাবি উত্থাপন করেন সমাবেশে। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে- সংস্কৃতিচর্চার অবাধ ও মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা; সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় গণতন্ত্রায়ণ নিশ্চিত করা; শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অনুদান প্রদানে গঠিত কমিটি পুনর্গঠন করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা; সংস্কৃতি খাতে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া। 
আলোচনা পর্বে প্রগতি লেখক সংঘের কোষাধ্যক্ষ দীনবন্ধু দাশ ও চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, এ দেশের মানুষের আকাক্সক্ষা হলো দেশ চলবে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। এর বাইরে যদি দেশ পরিচালনা করার পরিকল্পনা করা হয় তবে দেশের মানুষ তা কখনও মেনে নেবে না। মুক্তিযুদ্ধের মূল কথা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার। বলা হয়েছিল এই রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক দেশ। এই অঙ্গীকার থেকে দেশ কখনও বিচ্যুত হতে পারে না; মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কখনও ভূলুণ্ঠিত হতে পারে না। 
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন উদীচীর সহ-সভাপতি জামশেদ আনোয়ার তপন, যশোরের ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক কৃষক নেতা রণজিৎ বাওয়ালি, শহীদ আসাদ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান মিলন। তারা বলেন, আমরা যেমন বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করছি, তেমনিভাবে আমরা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের চেতনাও ধারণ করব। আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সামনের পথ রচনায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কোনো সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কাছে আমরা মাথা নত করব না।

×