ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১

শুরু হলো নতুন ঋতু

কোন পাথারের ওপার থেকে আনল ডেকে হেমন্তকে...

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:০০, ১৬ অক্টোবর ২০২৪

কোন পাথারের ওপার থেকে আনল ডেকে হেমন্তকে...

হেমন্ত এসেছে। আমন ধানের শীষে জমতে শুরু করেছে শিশির।

হাওয়া আবারও বদলে গেল। শুরু হলো নতুন ঋতু। আজ কার্তিকের প্রথম দিন। আর কার্তিক মানেই হেমন্তের সূচনা। কবির ভাষায় : ‘সবুজ পাতার খামের ভেতর/হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/কোন্ পাথারের ওপার থেকে/আনল ডেকে হেমন্তকে।’ নতুন রং রূপে জেগে ওঠার স্বার্থেই প্রকৃতি ডেকে এনেছে প্রিয় ঋতুকে। এখন ধীরে ধীরে বদলাতে থাকবে চারপাশ। ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করবে।  
বাংলাদেশে ঋতু ছয়টি হলেও, বড় দাগে দুটি। একভাগে গরম। আরেক ভাগে শীত। আর মাঝখানে হেমন্ত। কার্তিক এবং অগ্রহায়ণ মিলে হেমন্তকাল। এ সময় গরম কমতে থাকে। আসি আসি করে শীত। এই যেমন, গত দুই মাস ভ্যাপসা গরমে ভালোই ভুগতে হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে অবস্থা এমন থাকবে না। রোদটা মিষ্টি হয়ে ধরা দেবে।

আবহাওয়া হবে স্নিগ্ধ শীতল। এখন থেকে যত দিন যাবে ততই সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কমতে থাকবে। পার্থক্য যত কমবে তত বাড়তে থাকবে শীত। হেমন্তে ভর করেই শীত আসে। ঋতুটিকে তাই শীতের বাহন বলা হয়। 
তার আগে হেমন্ত নিজের মতো করে সাজিয়ে নেবে প্রকৃতিকে। কবিগুরু লিখেছেন, ‘হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে/হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে।’ হিম শীতল আঁচল ক্রমে দেশজুড়ে বিস্তৃত হবে। ঝরতে শুরু করবে শিশির। হেমন্তের প্রকৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই শিশির। গ্রামাঞ্চলে, বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে এরই মধ্যে শিশির পড়তে শুরু করেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। জমিতে আমন ধান লাগানো হয়েছিল।

সেগুলো বড় হচ্ছে। কঁচি ধানের সরু পাতায় রাতভর জমা হচ্ছে শিশির বিন্দু। ধানের ডগা থেকে স্বচ্ছ জলের কণা গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে। শীতল হচ্ছে মাটি। সেখানে পা ফেললেই অদ্ভুত ঠান্ডা! কুয়াশার বুননও ক্রমে ঘন হচ্ছে। সকালে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সামনে তাকালে পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। দূরের অনেক কিছুই কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। 
রাজধানী ঢাকায়ও ঝরতে শুরু করেছে শিশির বিন্দু। রাজধানীর মানুষজন সাধারণত খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন না। উঠলে অপরূপ এ দৃশ্য ঠিক দেখতে পাবেন। কংক্রিটের নগরীতে ধানখেত নেই। তবে পার্কে উদ্যানে গাছ আছে। সেখানে খুব ভোরে গিয়ে গাছের পাতায় আঙুল ছোঁয়ালে শিশিরের অস্তিত্ব খুঁজে পাবেন। পায়ের নিচে চাপাপড়া ঘাসগুলোও শিশিরে ভেজা। খালি পায়ে ঘাস কিছুটা মারাতে পারেন। শিহরিত হবেন। সর্বোপরি শিশির বিন্দুর ওপর সূর্যের আলো এসে পড়তেই হীরকখ-ের মতো চিকচিক করে ওঠে। দেখতে ভুল করবেন না।        
হেমন্তে শিশিরের পাশাপাশি দেখা দেয় কুয়াশাও। পঞ্চগড় রংপুর চাঁপাইনবাবগঞ্জ নীলফামারিসহ বেশকিছু অঞ্চলে ভোরবেলায় কুয়াশা জমতে দেখা যাচ্ছে। এই কুয়াশার জাল, এই শিশির কণা জীবনানন্দের প্রিয় পঙ্ক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে কবি লিখছেন, ‘পা-ুলিপি কাছে রেখে ধূসর দ্বীপের কাছে আমি/নিস্তব্ধ ছিলাম ব’সে;/শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে;/নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি/উড়ে গেলো কুয়াশায়,-কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো...।’ 
হেমন্ত ফসলের ঋতু হিসেবে পরিচিত। এ সময় দেশে প্রচুর আমন চাষ হয়। বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা ধানের মন মাতানো
ঘ্রাণ। কবির ভাষায় : ‘ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।/দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।’ এই দান গ্রহণের মূল সময়টা অগ্রহায়ণ। অগ্রহায়ণে দিনভর চলে ধান কাটা। তারপর ফসল কাঁধে বাড়ি ফেরেন কৃষক। বাড়ির আঙ্গিনা নতুন ধানে ভরে ওঠে। নারীদেরও ধান মাড়াই, শুকিয়ে ঘরে তোলার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় খুশি মনে অংশ নিতে দেখা যায়। অগ্রহায়ণেই সারা বাংলায় চলে নবান্ন উৎসব। বাঙালির প্রধান ও প্রাচীনতম উৎসবগুলোর অন্যতম নবান্ন।

কোনো কোনো অঞ্চলে ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখা হয়। বাকি অংশ চাল করে সে চালে চলে পায়েস রান্না। এভাবে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হয় নবান্ন উৎসব। শুধু গ্রামে নয়, এখন শহরেরও থাকে নানা আয়োজন। গ্রামের মতো না হলেও প্রতি বছর ১ অগ্রহায়ণ রাজধানী ঢাকায় প্রতীকী নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। এভাবে শেকড়ের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার অনুপ্রেরণা হয়ে আসে হেমন্ত।

×