ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১

বিদেশে ডাকা হয় ডেভিলস ট্রি নামে

যে গাছে ভূতের ভয়, বাস করে শয়তানও

মোরসালিন মিজান 

প্রকাশিত: ২১:৪৩, ১৪ অক্টোবর ২০২৪

যে গাছে ভূতের ভয়, বাস করে শয়তানও

.

অন্যান্য গাছের মতোই গাছটি। ডালপালা পাতা ফুল সবই হয়। উঁচু গাছ চারপাশে অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে থাকে। আর এখন তো ফুলে ফুলে গাছ ভর্তি হয়ে আছে। তার পরও একলা পথিক সংশয়-সন্দেহ নিয়ে গাছটির দিকে তাকান। নিচ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ভয়ে অনেকের বুক কেঁপে ওঠে। না, না। আফ্রিকার জঙ্গলে জন্ম নেওয়া মানুষখেকো গাছ এটি নয়। তবে অন্য দোষ আছে। বলা হয়ে থাকে, এই গাছে ভূত থাকে! বাস করে শয়তানও! সুযোগ বুঝে মগডাল থেকে ভূত নেমে আসবে- এমন একটা আশঙ্কা যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে কাজ করছে।

সত্যি সত্যি এই ভূত ক’জনের ঘাড় মটকে দিয়েছে সে তথ্য কারও কাছে নেই। না থাক, ভয়টুকু রয়েই গেছে। বিশেষ করে গ্রামের প্রবীণরা ভয় পাওয়ার বা ভয় ধরানোর নানা গল্প খুব আগ্রহ নিয়ে করে থাকেন। বহু মানুষের শৈশবের স্মৃতির সঙ্গে মিশে থাকা গাছটির নাম, হ্যাঁ, ছাতিম। ছাতিম গাছের প্রসঙ্গ উঠলে এমনকি শহরের আধুনিক মানুষটিও দিব্যি বলে বসেন, এই গাছে জানেন তো শয়তান থাকে! গাছের নিচ দিয়ে ভরদুপুরে বা মধ্যরাতে বাড়ি ফেরার সময় শয়তান তার সঙ্গে কী কী করেছিল সে ফিরিস্তিও প্রায় ঢাক-ঢোল পিটিয়ে দিতে পছন্দ করেন আক্রান্ত ব্যক্তি। 
ছাতিম গাছে প্রচুর ফুল হয়। এখন সেই মৌসুম। গাছ একেবারে ফুলে ফুলে ভর্তি হয়ে আছে। গন্ধ অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ায়। কিন্তু উগ্রগন্ধী। কারও কারও নাকে এসে লাগতেই মাথা ধরে। ব্যথা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু ছাতিমের কড়া গন্ধ নাকি খুব পছন্দ করে ভূতেরা! একই টানে ছুটে আসে শয়তান! দেশে শুধু নয়, বাইরেও ছাতিম গাছের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ! তাই বহু দেশে ‘ডেভিলস ট্রি’ নামে পরিচিত। ছাতিম গাছ তাই গাছের সয়-সম্মান কোনোদিন পায়নি!
কিন্তু বাস্তবে ঘটনাটা কী? আসলেই ছাতিম গাছে ভূত নাচে? ডালপালা নাড়ায় শয়তান? না, একদমই সত্য নয় এসব অভিযোগ। প্রমাণ মেলেনি। প্রমাণ খুঁজতে যাওয়া মানে সময় নষ্ট। ছাতিম অন্য সব গাছের মতোই একটি গাছ। গ্রামে খুব দেখা যায়। যে ক’টা গাছ গ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়, ছাতিম সেগুলোর অন্যতম। গল্প বা উপন্যাসে গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতির কথা বলতে গিয়ে জনপ্রিয় লেখকেরা এ গাছের কথা বারবার উল্লেখ করেছেন। কবিতায় এসেছে ছাতিম। রবীন্দ্রনাথের কথাই যদি বলি, কবিগুরু লিখেছেন, ‘ওই যে ছাতিম গাছের মতোই আছি/সহজ প্রাণের আবেগ নিয়ে মাটির কাছাকাছি।’ কবিগুরুর শান্তিনিকেতনে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ছাতিমের পাতা উপহার দেওয়ার রীতিও প্রচলিত ছিল একসময়। সেখানকার ছাতিমতলাও বেশ বিখ্যাত। বিভূতিভূষণের রচনায় ছাতিমের কথা বারবার এসেছে। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আরণ্যক’ পড়া আছে নিশ্চয়ই। সেখানে ছাতিমের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করে তিনি লিখেছেন, ‘পাহাড়ের উপরে ঘন বন ঠেলিয়া কিছুদূর উঠিতেই কিসের মধুর সুবাসে মনপ্রাণ মাতিয়া উঠিল, গন্ধটা অত্যন্ত পরিচিত-প্রথমটা ধরিতে পারি নাই, 
তারপরে চারিদিকে চাহিয়া দেখি-ধন্ঝরি পাহাড়ে যে এত ছাতিম গাছ তাহা পূর্বে লক্ষ্য করি নাই-এখন প্রথম হেমন্তে ছাতিম গাছে ফুল ধরিয়াছে, তাহারই সুবাস।’ একই লেখক তার অন্য একটি লেখায় ছাতিম ফুলের গন্ধকে ‘উগ্রসুবাস’ হিসেবে স্বীকার করেছেন।   
ছাতিম ফুল গুচ্ছাকারে ফোটে। দেখে মনে হয় পুষ্পস্তবক। প্রতিটি পুষ্পগুচ্ছ চার থেকে সাতটি পাতা দ্বারা বেষ্টিত থাকে। এ কারণে গাছটি সপ্তপর্ণ বা সপ্তপর্ণা নামেও পরিচিত। ছাতিম নামকরণের মূলেও রয়েছে এর পাতা। পাতাগুলো একসঙ্গে বিশাল ছাতার মতো। যতদূর তথ্য, ছাতা থেকেই ছাতিম নামকরণ করা হয়েছে। আর বৈজ্ঞানিক নাম অ্যালস্টনিয়া স্কলারিস। বাংলাদেশসহ চীনের গুয়াংজু প্রদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ছাতিমের আদি নিবাস। 
বাংলাদেশের গ্রামের কথা বলা হয়েছে আগেই। রাজধানী শহর ঢাকায়ও কিন্তু ভালো সংখ্যায় আছে গাছটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, রমনা পার্ক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, হাতিরঝিল- যেখানেই যান না কেন ছাতিম গাছ পেয়ে যাবেন। খুঁজতে হবে না। বাতাসে ফুলের গন্ধটা অনুসরণ করুন। আশেপাশেই গাছটি আছে। দেখে নিন সময় করে। ছাতিমের পুুষ্পিত মঞ্জরি আপনাকে মুগ্ধ করবে। 
খ্যাতিমান উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মা ছাতিম ফুলের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘ফুলেরা অনুজ্জ্বল, সবুজাভ সাদা, অনাকর্ষী, তবু ছত্রাকৃতি মঞ্জরির প্রাচুর্যে পুষ্পিত ছাতিম সুশ্রী। অত্যুগ্র গন্ধে নেশার ঝাঁজ রয়েছে।’ পরের বলাটি আরও চমৎকার, তিনি লিখেছেন, ‘এমন প্রখর বলিষ্ঠ আত্মঘোষণার সামর্থ্য খুব কম গাছেরই আছে।’ 
অর্থাৎ, গাছটির সবকিছুকেই ইতিবাচকভাবে দেখেছেন এই নিসর্গপ্রেমী। তার লেখায় ভূত প্রেত বা শয়তানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পাওয়ার যৌক্তিক কারণও নেই। তাই ভয়ডর মন থেকে ঝেড়ে ফেলে গাছটিকে আপন করে নিতে পারেন আপনিও। ছাতিম গাছ ঘিরে শৈশবের মজার মজার স্মৃতিগুলো বেঁচে থাক। বেঁচে থাক গাছটিও। 

×