ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১

আড়াই ইঞ্চির জিলাপি

ভেতরে মিষ্টি রসে টইটম্বুর বাইরে মচমচে

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ১৩ অক্টোবর ২০২৪

ভেতরে মিষ্টি রসে টইটম্বুর বাইরে মচমচে

শারদীয় উৎসব উপলক্ষে চলছে গরম গরম মচমচে জিলাপির বেচাকেনা

বাঙালি থেকে অবাঙালি- সবাই এই মজাদার মিষ্টির ভক্ত। আজও বহু মানুষের খাদ্যের তালিকাতেই থাকে গরম জিলাপি। আবার, মেলার মাঠে জিলাপি খুঁজে বেড়ান এমন মানুষও প্রচুর।
ভেতরে মিষ্টি রসে টইটম্বুর, বাইরে মচমচে। এমন জিলাপির আড়াই ইঞ্চির ঐতিহাসিক প্যাঁচ, আকার ও স্বাদের ওপর ভিত্তি করে এর নামেও ভিন্নতা এসেছে।
পবিত্র মাহে রমজানের ইফতারে যেমন জিলাপি ছাড়া চলে না তেমনি শারদীয় উৎসবসহ যে কোনো উৎসবে জিলাপির প্রচুর চাহিদা বাড়ে। বলতে গেলে যে কোনো উৎসব মানেই আড্ডা, ঘুরতে যাওয়ার পাশাপাশি খাওয়া-দাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 
মিষ্টির সঙ্গে বাঙালির প্রেম যুগ যুগের ... । তাই হাট-বাজার, উৎসব ঘিরে বসে মিষ্টির পসরা। সেখানেই গরম গরম জিলাপি আর দর্শনার্থীরা তা মচমচ করে কামড়িয়ে খাচ্ছেন। 
জিলাপির নামের যেন শেষ নেই। আমাদের দেশে চিনি-গুড়ের জিলাপির কদর বেশি। এর মাঝেও তৈরির কারুকাজে মিষ্টিশিল্পীরা নাম দিয়ে বসেন- রেশমি জিলাপি,  শাহি জিলাপি, বোম্বাইয়া জিলাপি, জাফরানি জিলাপি, চিকন জিলাপি ও আমৃতি। এসব জিলাপির দোকান বা রেস্টুরেন্ট অনুযায়ী দামে কিছুটা তারতম্য রয়েছে। তা তৈরিতে উপকরণের কিছুটা ভিন্নতা দেখা গেছে।
আবার এদিকে রসে পরিপূর্ণ, স্বাদে-গন্ধে মনমাতানো এই মিষ্টান্নের ইতিহাসটাও একটু প্যাঁচানোই বটে! এ বলে এ কথা তো ও বলে সে কথা। কোনো দিকেই পক্ষপাতিত্ব না রেখে বরং চলুন জেনে নেওয়া যাক জিলাপির এই ঐতিহাসিক প্যাঁচের সব গল্প।
জাহাঙ্গীরা-জলভল্লিকা-জলেবি-জালাবিয়া-জেলেবিয়া-কু-লিকা এবং জিলাপি বা জিলেপি। নামের ভিন্নতায়ও যেন প্যাঁচ লেগে আছে। 
জিলিপির খ্যাতি  যেমন বাংলাদেশে তেমনি ভারতসহ বিভিন্ন দেশেও এর খ্যাতি রয়েছে। এক এক জায়গায় হয়ত এক এক রকম নাম। কিন্তু বস্তুটি একই। আজ আমরা এত একাকার হয়ে গেছি এই পদটির সঙ্গে, যে বেশিরভাগ সময় ভুলেই যাই এর আসল উৎসের কথা। 
জিলাপির উৎপত্তিটা আসলে কোথায়। তার নিশ্চিত কোনো তথ্য এখনো অব্দি পাওয়া যায়নি। তবে প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী, জিলাপির সবচেয়ে পুরোনো লিখিত বর্ণনা পাওয়া যায়, মুহম্মদ বিন হাসান আল-বোগদাদির লিখিত ত্রয়োদশ শতাব্দীর রান্নার বইয়ে।
আবার ইতিহাসে আছে, এর আগেই জিলাপির আবিষ্কার করে মিসরের ইহুদি সম্প্রদায়। ইহুদিদের ধর্মীয় উৎসব হানুক্কাহ পালনে তৈরি করা হতো এক ধরনের প্যাঁচানো মিষ্টান্ন। তারা এই মিষ্টান্নের নাম দিয়েছিল জালাবিয়া। ধরা যেতে পারে, মূলত এই জালাবিয়া ছিল জিলাপির প্রাচীনতম নাম ও রূপ।
কালক্রমে জিলাপি ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত হয়েছে। জানা যায়, মোগল আমলে সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রিয় মিষ্টান্নগুলোর একটি ছিল জিলাপি। জিলাপির স্বাদে মুগ্ধ হয়ে তিনি এই মিষ্টির নাম রেখেছিলেন নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে জাহাঙ্গীরা । অর্থাৎ জিলাপির ইতিহাস খানিকটা রাজকীয়ও বটে।
ইরানে এই মিষ্টান্নের নাম  জেলেবিয়া। সে দেশ রমজান মাসে এই মিষ্টান্ন তৈরি করে দুস্থদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। তুরস্ক, লেবানন এমনকি গ্রিসেও এই প্যাঁচদার মিষ্টান্নটি ভিন্ন ভিন্ন রূপে বিদ্যমান এবং বেশ জনপ্রিয়।
এদিকে আবার বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে জিলাপির প্রবেশ মূলত মুসলিম বণিকদের মাধ্যমেই ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। খুব সম্ভবত পারসি ও তুর্কিদের প্রভাবেই খাদ্যটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ভারতবর্ষে। আবার এদিকে আরেক সূত্রে জানা যায়, পঞ্চদশ শতাব্দীতে ভারতে জিলাপির মতো এক মিষ্টান্নকে বলা হতো কু-লিকা। সংস্কৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থ গুন্যগুনবোধিনীতে জিলাপি তৈরির জন্য যে উপাদানের তালিকা পাওয়া, তার সঙ্গে আধুনিক জিলাপি তৈরির প্রক্রিয়ার মিল রয়েছে। আর এই গ্রন্থের সময়কাল ছিল ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ!
জিলাপির প্যাঁচ খোলার প্রচেষ্টা শেষে বোঝাই যাচ্ছে, ভারতবর্ষে কিংবা গোটা পৃথিবীতেই জিলাপি নতুন কোনো মিষ্টান্ন নয়। নামে ভিন্ন হলেও উপকরণ, আকার-আকৃতি ও স্বাদে জিলাপি স্বরূপে বিরাজ করছে ইতিহাসের পাতা, মানচিত্রের অলিগলিতে। আর এই ভবঘুরে স্বভাবের কারণেই বাংলায় পাড়ি জমিয়ে জনপ্রিয় হয়েছে জিলাপি বা জিলিপি।
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। আর সেই পার্বণের ভিড়ে তৈরি হয় এক একটি মেলা। রবিবার শেষ হলো শারদীয় উৎসব। পূজাম-পগুলো ঘিরে বসে ছোটো ছোটো তাঁবু খাটিয়ে  বিক্রেতারা। উনুন থেকে ধোঁয়া ওঠে; আর একটু একটু করে বাড়তে থাকে ভিড়। আমাদের সবার কাছেই এ অতি পরিচিত দৃশ্য। আর গরম গরম তেলে তৈরি হচ্ছে আড়াই প্যাঁচের জাদু। রস থেকে পাতে উঠে এলেই ষোলোকলা পূর্ণ। জিলাপির সঙ্গে আমাদের যে একেবারে আত্মার স¤পর্ক। যতদিন গেছে, জিলাপি প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে পড়েছে। 
জিলাপিতে কেন প্যাঁচ থাকে? এর পেছনে লুকিয়ে আছে রহস্য। আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশে জিলাপি একটি জনপ্রিয় খাবার। নানা স্বাদ-বৈচিত্র্যে পরিবেশন করা হয় জিলাপি। 
ঠিক আড়াই প্যাঁচেই আঙুলের কায়দায় এই মিষ্টি বানিয়ে ফেলেন কারিগররা।  বাঙালি থেকে অবাঙালিÑসবাই এই মজাদার মিষ্টির ভক্ত। প্রশ্ন, জিলাপির এমন আকৃতির কী কারণ। সে স¤পর্কে ¯পষ্টভাবে কিছুই জানা না গেলেও বিভিন্ন সূত্র অনুসারে, বিশেষভাবে পরিচিত করে তোলার জন্যই জিলাপি এমন প্যাঁচ দিয়ে বানানো শুরু হয়েছিল। 
আবার খাদ্য বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, আকারে লম্বা করলে জায়গা বেশি লাগবে বা ভেঙে যাওয়ার সম্ভবনা এড়াতেই জিলাপি এমন গোল প্যাঁচ দিয়ে প্রস্তুত করা হয়ে থাকে।

×