ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১

হতো পূজা অর্চনাও

পটে আঁকা হতো দেব দেবীর মুখ

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:৫১, ১২ অক্টোবর ২০২৪

পটে আঁকা হতো দেব দেবীর মুখ

ঐতিহ্যবাহী পটচিত্রে দেবী অর্চনা

বাংলার লোকচিত্রকলার গৌরবময় ঐতিহ্য পটচিত্র। পটচিত্রের দেশজ রং, সরল অঙ্গন রীতি এখনো মুগ্ধ করে। কত কী যে আঁকা হয়েছে পটে! তবে শুরুটা হয়েছিল ধর্মীয়পট দিয়ে। ধর্মীয়পট কী? আসছি সে প্রশ্নে। তার আগে ‘পটচিত্র’ শব্দটি ভেঙে দেখা আবশ্যক হবে। ‘পটচিত্র’ মানে, পটে আঁকা চিত্র বা ছবি। ‘পট’ শব্দের অর্থ কাপড়। কাপড়ের ওপর দেশী রং দিয়ে এ ধরনের ছবি আঁকা হতো। আদি চর্চা এখনো অল্প বিস্তর চালু আছে। ভারতের পশ্চিম বঙ্গে অনেকেই আঁকেন। বাংলাদেশে সে তুলনায় কম। সারাদেশে খোঁজ করলে হয়তো কয়েকজন পাওয়া যাবে। তার পরও আশার কথা যে, ঐতিহ্যটি একেবারে হারিয়ে যায়নি।  
বাংলায় প্রচলিত পটটিত্র দু-ধরনের। একটি চৌকাপট নামে পরিচিত। অন্যটি বহুপট বা দীর্ঘপট। যখন কোনো রীতিসিদ্ধ শিল্পকলার অস্তিত্ব ছিল না তখন এ পটচিত্র প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যকে সযতেœ ধারণ করেছিল। বারো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত জোরালো ছিল এই চর্চা। যারা পট আঁকেন তারা পটুয়া নামে পরিচিত। অতীতে স্বশিক্ষিত শিল্পীরা বংশানুক্রমিকভাবে পটচিত্র আঁকার কাজ করতেন। চিত্র দেখিয়ে গানও করতেন তারা। গানে গানে কেচ্ছা-কাহিনী বর্ণনা করতেন। এখন গান করতে তেমন দেখা না গেলেও, কমবেশি পট আঁকা হয়। পটের বিষয়বস্তু বিচিত্র। গবেষকরা বিষয় বেঁধে পটকে ছয় ভাগে ভাগ করেছেন। এই যেমন, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, পরিবেশগত ও বিষয়নিরপেক্ষ পট। 
জানা যায়, গোড়ার দিকে বেশি জনপ্রিয় ছিল ধর্মীয় পট। এই অঞ্চলের মানুষ ধর্মভীরু। তাই ধর্মীয় বিশ্বাসকে টেকসই করে এমন গল্প ও পৌরাণিক কল্প-কাহিনী আলাদা গুরুত্ব পেত তখন। গাজীরপটের কথা তো সবার জানা। খুবই বিখ্যাত। মুসলমানদের গাজীরপটে গাজীকালু-চম্পাবতীর কাহিনী, গাজীপীরের বীরত্বগাঁথা অলৌকিক কর্মকা- তুলে ধরা হতো।  
অন্যদিকে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পটে স্থান পেত রামকাহিনী, কৃষ্ণকাহিনী। মহাভারত ও রামায়ণ উপাখ্যান থেকে চরিত্র খুঁজে নিয়ে উজ্জ্বল রঙে আঁকতেন পটুয়ারা। পটে আঁকা হতো দুর্গাপট ও লক্ষ্মীপট। মাটির প্রতিমা গড়ে পূজা করার সাধ্য ছিল না অনেকের। তারা তখন পটে আঁকা দেব-দেবীর ছবি সামনে রেখে পূজা করতেন। রঙিন দুর্গোৎসব সম্ভব না হলেও, শতভাগ ভক্তি নিয়েই পূজা হতো দুর্গাপটের। একইভাবে পট এঁকে দেবী লক্ষ্মীর অর্চনা করা হতো। 
তবে বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী শিল্পের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। হাতেগোনা কয়েক পটুয়া সীমাবদ্ধতার মধ্যেও চর্চাটি ধরে রেখেছেন। তাদেরই একজন মুন্সীগঞ্জের পটুয়া শম্ভু আচার্য। স্বনামধন্য শিল্পী তার পটে মহাভারত ও রামায়ণের বিভিন্ন চরিত্র চিত্রন করেন। তার সংগ্রহে থাকা একটি পটচিত্র হাতে নিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রে রাবণবধের মুহূর্তটি আঁকা হয়েছে। এর চারপাশে আলাদা আলাদা ফ্রেমে আরও বেশ কিছু ছবি। খ-চিত্রে ঘটনাবলী ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরার শিল্পীত প্রয়াস। তার আঁকা আরেকটি পটচিত্রে মহাভারতের উপাখ্যান। এখানে কুরুক্ষেত্রের অর্জুনকে খুঁজে পাওয়া যায়। পঞ্চপা-বের অন্যতম অর্জুন তার রথে চড়ে ছুটে চলেছেন। সঙ্গী হয়েছেন কৃষ্ণ। 
শম্ভুর পটের মূল রংটি লাল। এর পর চোখে পড়ে সবুজ আর নীল রঙের ব্যবহার। প্রাকৃতিক রং আর ফর্মের ভিন্নতার কারণে ছবি দুটি আলাদা আবেদন সৃষ্টি করে। পটুয়া বলছিলেন, এক সময় রামায়ণপট, মহাভারতপট খুব জনপ্রিয় ছিল। দুর্গাপূজার সময় রামায়ণ গান করা হতো। ম-পে পট ঝুলিয়ে তা দেখিয়ে বর্ণনা করা হতো রাবণবধের কাহিনী। পটে আঁকা হত দেবী মনসাকেও। 
জানা যায়, প্রধানত বাংলা অঞ্চল এবং উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে মনসা পূজা প্রচলিত ছিল। সর্পদংশনের হাত থেকে রক্ষা পেতে, সর্পদংশনের প্রতিকার পেতে, প্রজনন ও ঐশ্বর্যলাভের উদ্দেশে পূজা করা হত মনসার। একইভাবে দেবী মনসার পট দেখিয়ে বেহুলা লক্ষিন্দরের লোকপ্রিয় কাহিনী তুলে ধরা হত। পটে খুঁজে পাওয়া যেত  শীতলা দেবীকেও। রোগ মহামারি থেকে বাঁচতে পটে আঁকা শীতলা দেবির কাছে কৃপা চাইত মানুষ। পটুয়ারা শীতলা দেবীর ছবি এঁকে তা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখাতেন। এ সম্পর্কে আরও জানতে কথা হয় নড়াইলের জনপ্রিয় পটুয়া নিখিল দাশের সঙ্গে।

শিল্পী বলেন, অতীতে  বসন্ত রোগে ব্যাপক মৃত্যুর ঘটনা ঘটত। চিকিৎসা সহজ ছিল না। তাই বসন্ত দেখা দিলে শীতলা দেবীর পট আঁকতেন শিল্পীরা। একটি বাক্সের ওপর পট বসিয়ে গলায় সেটি ঝুলিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুরতেন। দেবীর পট দেখিয়ে চাল ডাল ইত্যাদি সংগ্রহ করতেন। এসব দিয়ে ছবির সামনে পূজার আয়োজন করে রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করা হতো। এসব কারণে ধর্মীয় পট বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল বলে জানান তিনি। 
অবশ্য বর্তমানে পটচিত্রের অনেক কিছুই বদলে গেছে। প্রাচীন অঙ্কন রীতি হুবহু ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। বংশপরম্পরায় পট আঁকছেন এমন শিল্পীও দুর্লভ। চর্চাটাই অনেক কমে গেছে। একইভাবে কমেছে দুর্গোৎসবের সময় ধর্মীয় পট আঁকা, প্রদর্শন এবং বিক্রি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কালীঘাটে ধর্মীয় পট এখনো অনেক আঁকা হয় বটে। বাংলাদেশে একদম কমে গেছে। ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনেই পটচিত্রের চর্চা অব্যাহত রাখা জরুরি বলে মনে করেন লোক গবেষকরা।

×