.
হাওড় হচ্ছে জলপূর্ণ বিস্তৃত প্রান্তর। এটি অগভীর বিস্তৃীর্ণ জলাশয়। অনেকটা গামলা আকৃতির জলাভূমি। হাজার হাজার বছর পূর্বে যা ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের ধারণা ভূ-গাঠনিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হাওড়ের উৎপত্তি এবং মধুপুর সোপান গঠনের সঙ্গে এর যোগ রয়েছে বলেও মনে করা হয়।
হাওড়ের নামকরণ কি ভাবে হয়েছে তা জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, হাওড় শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘সাগর’-এর বিকৃত রূপ বলে ধারণা করা হয়। এই ‘সাগর’ শব্দ থেকে ‘হাওড়’ শব্দের উৎপত্তি। প্রতি বছর বর্ষায় মৌসুমি বৃষ্টির সময় হাওড় পানিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বর্ষাকালজুড়ে হাওড়ের পানিকে সাগর বলে মনে হয়। যেদিকে তাকানো যায় শুধু অথৈই জলরাশি। জলমগ্ন হাওড়ের জনপদগুলো দেখতে ছোট দ্বীপের মতো লাগে। ভরা বর্ষায় গ্রামগুলো থাকে জলে ডুবুডুবু। এ সময় লোকজন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে নৌকায় যাতায়াত করে। হাওড়ে সূর্য উদয় এবং সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখলে মনে হবে সাগর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
প্রচলিত অর্থে হাওড় হলো বন্যা প্রতিরোধের জন্য নদীতীরে নির্মিত মাটির বাঁধের মধ্যে প্রায় গোলাকৃতি নিম্নভূমি বা জলাভূমি। তবে হাওড় সব সময় নদী তীরবর্তী নির্মিত বাঁধের মধ্যে নাও থাকতে পারে। হাওড়ের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, প্রতি বছর মৌসুমি বর্ষায় বা স্বাভাবিক বন্যায় হাওড় প্লাবিত হয়। এক সময় মেঘনা ও এর শাখা নদীসমূহ দ্বারা গঠিত প্লাবনভূমির স্থায়ী ও মৌসুমি হ্রদ নিয়েই গঠিত হয়েছিল হাওড় অববাহিকা। যেখানে প্রচুর বৈচিত্র্যপূর্ণ জলজ উদ্ভিদ থাকত।
কিন্তু ক্রমান্বয়িক অবক্ষেপণের কারণে অববাহিকাগুলোর গভীরতা কমে গিয়ে চর জেগে সেখানে হোগলা, নলখাগড়ার ঝোপ-ঝাড় গজিয়ে ওঠে। এর ফলে একদিকে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর খাদ্য ও আশ্রয়ের আদর্শ স্থান হয়ে ওঠে হাওড় অঞ্চলগুলো। অন্যদিকে পরিযায়ী পাখিদের আকর্ষণীয় আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। আবার পরিযায়ী পাখিদের মলমূত্রে সমৃদ্ধ হয়ে উর্বর জলমহালগুলো উদ্ভিদ প্লান্টন ও দীর্ঘ লতাগুল্মের জন্ম দেয়। যা ইউট্রোফিকেশন প্রক্রিয়াকে অংশত সাহায্য করছে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলা নিয়ে মূলত হাওড়াঞ্চলের অবস্থান। জেলাগুলো হলো মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। দেশের বৃহৎ আকারের হাওড়গুলোর মধ্যে মৌলভীবাজার জেলায় বেশ কয়েকটি হাওড়ে মধ্যে প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট নানা সমস্যার কারণে ধ্বংসের দোর গোড়ায় থাকা সম্ভাবনাময়ী হাকালুকি হাওড়, হাইল হাওড় ও কাওয়াদীঘি এই তিনটি হাওড় এখনো তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। মৌলভীবাজারের হাওড়গুলোর প্রত্যেকটির জীববৈচিত্র্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী হাওড়াঞ্চলকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন- পাহাড়ের নিকটবর্তী অঞ্চল, যা সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার হাওড়গুলো। প্লাবনভূমির হাওড়, যেমন- নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হাওড়গুলো। গভীর পানিতে নিমজ্জিত হাওড়, যেমন সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা জেলার কয়েকটি হাওড়, কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলী উপজেলার হাওড়।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হাওড় রয়েছে সিলেট বিভাগে। এর মধ্যে হাকালুকি হাওড় ও টাঙ্গুয়ার হাওড় অন্যতম। হাকালুকি বাংলাদেশের তথা এশিয়ার মধ্যে সর্ববৃহৎ হাওড়। এর আয়তন ১৮ হাজার ১১৫ হেক্টর। এটি সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত।
মৌলভীবাজার জেলার তিনটি হাওড়ে মিঠা পানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। এ মাছগুলোর মধ্যে রয়েছে রুই, বাউশ, কাতলা, পাঙ্গাশ, বোয়াল, চিতল, মৃগেল, ঘনিয়া, বাতাসি, গলদা চিংড়ি, পাবদা, ফলি, বাইম, বাঘমাছ, কালিবাউশ, শিং, মাগুর, কৈ, রানী, মলা, দারকানা, পুঁটি, শোল, গজার, টাকি, চেলাপাতা, বাঁশপাতা, কাশখয়রা, বেলে, ভেদা এর মধ্যে অন্যতম।
এ ছাড়া রয়েছে বিরল প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ হিজল, তমাল, করচ, বরুণ, আড়ং, জারুল, কলমি ইত্যাদি। শীত মৌসুমে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে এই সমস্ত হাওরে। পাখিগুলোর মধ্যে রয়েছে গুটি ইগল, কুড়া ইগল, পানকৌড়ি, বেগুনি কালিম, বালিহাঁস, ভূতিহাঁস, রাজসরালি, পান ভুলানি, কাস্তেচড়া, মেটেমাথা টিটি, গিরিয়া হাঁস, ল্যাঞ্জা হাঁস। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির উভচর, সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেখা মেলে। বর্ষাকালে হাওড়ের যেদিকে চোখ যায় সাগরের মতো মনে হয়। শুধু দেখা যায় অভিরাম জলরাশি। শীতের মৌসুমে শুধু সবুজের সমারোহে ফসলের মাঠ।
বছরের প্রায় সাত মাস হাওড়গুলো পানির নিচে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে যায়। পানি শুকানোর সঙ্গে সঙ্গেই গজিয়ে উঠে হাওড়ে বিস্তীর্ণ প্রান্তরজুড়ে সবুজ ঘাস। এই সবুজ ঘাসের মধ্য দিয়ে খালি পায়ে হাঁটলে মনে হবে আপনি অনেক দামি কার্পেটের ওপর দিয়ে হাঁটছেন। সেই অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। এ সময় গবাদিপশুর বিচরণক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হয়। এই সবুজ ঘাসকে কেন্দ্র করে হাওড় পাড়ে শীত মৌসুমে গড়ে ওঠে অস্থায়ী গবাদিপশু লালন পালন কেন্দ্র। যাকে স্থানীয় ভাষায় বাথান বলে। হাওড় তীরবর্তী মানুষের জীবন-জীবিকার একমাত্র উৎস হচ্ছে মৎস্য আহরণ ও বোরো ধান চাষাবাদ।
হাওড়ে রয়েছে অসংখ্য সরু খাল। সেই খাল দিয়ে পানি সেচের মাধ্যমে যেমন বোরো ধান চাষ হয় তেমনি মৎস্য শিকারেরও উপযুক্ত ব্যবস্থা। সেই সরু খাল দিয়ে হাওড়ে আসা পানির সাথে প্রচুর পলিমাটি ফেলে যায়। এই মাটি ফসল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
হাকালুকি হাওড়
প্রবাদ আছে ‘হাওড় কইলে হাকালুকি আর সব কুয়া, বেটা কইলে মান মনসুর আর সব পুয়া (ছেলে)।’ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ সৌন্দর্য মৌলভীবাজার জেলা। এখানে রয়েছে উঁচু-নিচু অসংখ্য টিলা ও পাহাড়, রয়েছে সমতলভূমি। দেশের অন্যতম বৃহত্তম হাওড় হাকালুকি হাওড় যা দেশীয় প্রজাতির মৎস্য ভা-ারে ভরপুর। বিলুপ্ত ও বিপন্ন নানা প্রজাতির জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল। উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণির অভয়ারণ্য। রূপ মাধুর্যে মনোহর দৃষ্টি নন্দন হাকালুকি হাওড় বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ ও এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তর হাওড়। হাওড়টি মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলায়ে অবস্থিত।
নামকরণ
হাকালুকি হাওড়ের নামকরণ নিয়ে নানা জনশ্রুতি রয়েছে। কথিত আছে, বহু বছর পূর্বে ত্রিপুরার মহারাজা ওমর মানিক্যের সেনাবাহিনীর ভয়ে বড়লেখার কুকি দলপতি হাঙ্গর সিং জঙ্গলপূর্ণ ও কর্দমাক্ত এক বিস্তীর্ণ এলাকায় ‘লুকিয়ে দেওয়া’ অর্থাৎ লুকিয়ে থাকে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে কালক্রমে ওই এলাকার নাম হয় ‘হাঙ্গর লুকি বা হাকালুকি।’
প্রায় দুই হাজার বছর আগে ‘আকা’ নামে এক রাজা ছিলেন। তার রাজপ্রাসাদ বর্তমান হাকালুকি হাওড়ের মাঝখানে ছিল। প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রচ- এক ভূমিকম্প সংগঠিত হয়। সেই ভূমিকম্পে ‘আকা’ নামে সেই রাজা তার রাজবাড়ি মাটির নিচে তলিয়ে যায়। কালক্রমে এই তলিয়ে যাওয়া নিম্নভূমির নাম হয় ‘আকালুকি বা হাকালুকি।’
আবার আরও শোনা যায় যে, এক সময় বড়লেখা উপজেলার পশ্চিমাংশে হেংকেল নামে একটি উপজাতি বাস করত। হেংকেলদের বসবাস এলাকার নাম ছিল ‘হেংকেলুকি’। পরবর্তীতে এই হেংকেলুকিই ‘হাকালুকি’ নাম ধারণ করে।
অন্য একটি জনশ্রুতি আছে এক সময় হাকালুকি হাওড়ের কাছাকাছি বসবাসরত কুকি ও নাগা উপজাতি তাদের ভাষায় এই হাওড়ে নামকরণ করে ‘হাকালুকি’। হাকালুকি অর্থ লুকানো সম্পদ।
ভৌগোলিক অবস্থান
হাকালুকি হাওড় সিলেট ও মৌলভীবাজারের ৫টি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মিঠাপানির জলাভূমি। হাকালুকি হাওড় প্রায় ২৩৮টি বিল ও ১০টি নদীর সমন্বয়ে গঠিত এবং বর্ষাকালে এই হাওড়ে আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার হেক্টর। মাছের জন্য প্রসিদ্ধ হাকালুকি হাওরে শীতকালে অতিথি পাখিদের আগমনে মুখরিত হয়ে ওঠে। এ ছাড়াও এখানে প্রায় ১০০ প্রজাতির স্থানীয় পাখির দেখা মেলে। হাওড়ে বিস্তীর্ণ ভূমি, বিলনির্ভর মানুষের জীবনযাত্রা এবং অতিথি পাখির আহ্বানে ভ্রমণপিপাসুরা হাকালুকি হাওড়ে ছুটে আসেন।
পরিবেশগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষিত এই হাওড়ের আশপাশে প্রায় ৩,৯০,০০০ মানুষ বসবাস করেন। জলাভূমির যথাযথ ব্যবহার এবং সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বের কারনে এই জলাভূমিটির সুরক্ষার ওপর আন্তর্জাতিকভাবে মনোনিবেশ করা হয়েছে।
বিস্তারিত
হাকালুকি হাওড় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাওড়। মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে হাকালুকি হাওড় অবস্থিত। পূর্বে পাথারিয়া পাহাড় এবং পশ্চিমে ভাটেরা পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে বিশাল নিম্নাঞ্চল জুড়ে হাকালুকি হাওড় অবস্থিত। এটি এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি। এর আয়তন ১৮,১১৫ হেক্টর, তন্মধ্যে শুধু বিলের আয়তন ৪,৪০০ হেক্টর। এটি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা (৪০%), কুলাউড়া (৩০%), এবং সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জে (১৫%), গোলাপগঞ্জ (১০%) এবং বিয়ানীবাজার (৫%) জুড়ে বিস্তৃত। ভূতাত্ত্বিকভাবে এর অবস্থান, উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড়ে এবং পূর্বে ত্রিপুরা পাহাড়ের পাদদেশ। ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে উজানে প্রচুর পাহাড় থাকায় হাকালুকি হাওরে প্রায় প্রতি বছরই আকস্মিক বন্যা হয়। এই হাওড়ে ৮০-৯০টি ছোট-বড় ও মাঝারি বিল রয়েছে। শীতকালে এসব বিলকে ঘিরে পরিযায়ী পাখিদের বিচরণে মুখর হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। হাওড়ের স্থায়ী জলাশয়গুলোর পানিতে নিমজ্জিত, ভাসমান, জলজ, তৃণ এবং দূর্বাঘাস এবং নল খাগড়া জাতীয় উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যায়। শীতকালে মৎস্য আহরণ এবং অতিথি পাখিদের আগমন পর্যটকদের মনপ্রাণ সার্থক করে তোলে।
হাকালুকি হাওড়ে বিশাল জলরাশির মূল প্রবাহ হলো দুটো প্রধান নদী জুড়ী ও ফানাই। বর্ষাকালে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে হাওড় সংলগ্ন সমগ্র এলাকা প্লাবিত হয়ে সাগরের রূপ ধারণ করে। হাকালুকিতে কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। ওই ওয়াচ টাওয়ারগুলোর চূড়ায় উঠে পুরো হাওড় দেখার মজাই আলাদা। এই জলরাশি হাওড়ে উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। বর্ষাকালে হাওড় সংলগ্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে বিশাল রূপ ধারণ করে। এই সময় পানির গভীরতা হয় ১০ ফুট থেকে ৩৫ ফুট। হাকালুকি হাওরে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪১৭ প্রজাতির পাখি, এর মধ্যে ১১২ প্রজাতির অতিথি পাখি ও ৩০৫ প্রজাতির দেশীয় পাখি দেখা যায়। এ ছাড়া ১৪১ প্রজাতির অন্যান্য বন্যপ্রাণী, ১০৭ প্রজাতির মাছ, তার মধ্যে ৩২ প্রজাতি বিভিন্ন পর্যায়ে বিপন্নপ্রায়। এ ছাড়াও রয়েছে নানা ধরনের কীট-পতঙ্গ, জলজ ও স্থলজ ক্ষুদ্র অনুজীব। হাকালুকি হাওড়কে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা বিবেচনা করা হয়।
হাকালুকি হাওরে প্রচুর পরিমাণ মৎস্য সম্পদ রয়েছে। হাওড়ে বিলগুলো অনেক প্রজাতির দেশীয় মাছের প্রাকৃতিক আবাস। মৎস্যবিজ্ঞানীদের মতে, এই হাওড় হলো মাদার ফিশারি। এখানে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির মাছ রয়েছে। হাওড় এলাকায় প্রধানত পেশাদার জেলে, মৌসুমি জেলে ও খোরাকি জেলেদের বসবাস রয়েছে।
হাকালুকি হাওড় ভ্রমণের সময়
হাকালুকি হাওরে অতিথি পাখি দেখতে নবেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস হচ্ছে ভ্রমণের আদর্শ সময়। এ সময় হাওড়ে চারপাশ অতিথি পাখির কোলাহলে মুখর হয়ে থাকে। আর বর্ষাকালে হাওড় সমুদ্রের রূপ ধারণ করে। তাই বর্ষাকালে হাওড়ের মজা নিতে চাইলে জুন-আগস্ট এই সময় আসতে হবে।
কিভাবে যাওয়া যায়
ঢাকা থেকে ট্রেনযোগে আসলে কুলাউড়া রেলওয়ে জংশনে নামতে হবে। সড়কপথে মৌলভীবাজার সদর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই হাওড়ে আসার জন্য আপনাকে প্রথমে মৌলভীবাজার জেলায় অথবা কুলাউড়ায় পৌঁছাতে হবে। ঢাকা থেকে মৌলভীবাজার অথবা কুলাউড়ায় আসতে যে বাসে চলে আসতে পারেন সেই বাসগুলো হলো হানিফ, সৌদিয়া, শ্যামলী ও এনা পরিবহনের এসি নন এসি বাস। এ বাসগুলো ঢাকার ফকিরাপুল, গাবতলী, সায়দাবাদ, মহাখালী ও আবদুল্লপুর বাস টার্মিনাল থেকে আসে। এগুলোর কুলাউড়া পর্যন্ত ভাড়া সাধারণত ৭৫০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে।
ঢাকা থেকে ট্রেনে করে কুলাউড়া যেতে কমলাপুর কিংবা বিমান বন্দর রেলওয়ে স্টেশন হতে জয়ন্তিকা, কালনী, পারাবত, উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনকে বেছে নিতে পারেন আপনার ভ্রমণ সঙ্গী হিসেবে। শ্রেণিভেদে জনপ্রতি ট্রেনে ভাড়া ৪ শত থেকে ৮ শত টাকা।
যে পথেই আপনি কুলাউড়া আসেন না কেন সেখান থেকে মাইক্রোবাস, অটোরিক্সা ভাড়া করে সরাসরি হাওড়ে যাওয়া যায়। কুলাউড়া থেকে হাকালুকি হাওড়ে যেতে ৫শত টাকা থেকে এক হাজার পাঁচশত টাকার ভাড়া লাগে। বর্ষা মৌসুমে ২৫-৩০ জনের ধারণকারী নৌকাযোগে জুড়ীর কন্টিনালা ব্রিজের নিচ থেকে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা ভাড়ায় কয়েক ঘণ্টা ঘুরতে পারা যায়। তাছাড়া সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনে আসলে সিলেটের ঠিক আগের স্টেশন মাইজগাঁও এ নামতে হবে। মাইজগাঁও স্টেশন থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার। ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারে বেশ কয়েকটি মাঝারি মানের হোটেল রয়েছে। সেখানে হোটেলে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে নৌকাঘাটে এসে দামদর করে সারাদিনের জন্য তিন থেকে চার হাজার টাকায় কুশিয়ারা নদী দিয়ে হাকালুকি হাওড়ে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে পারেন।
ভ্রমণের সময় সঙ্গে নিন
বর্ষাকালে আসলে রেইন কোট, বড় ব্যাকপ্যাক, স্যান্ডেল, ক্যাপ শীতের সময়ে গেলে জ্যাকেট, কাদা-পানিতে চলন উপযোগী জুতা, গামছা, বাইনোকুলার, ক্যামেরা, প্রয়োজনীয় ব্যাটারি, পাওয়ার ব্যাংক, শুকনো খাবার ইত্যাদি।
‘আফাল’ আর ‘বলনের’
হাকালুকি হাওড় পাড়ের মানুষের কাছে এক অজানা ভয় এবং অভিশাপের নাম বিধ্বংসী ‘আফাল’ আর ‘বলন’। বর্ষায় যখন হাওড়ে পানিতে পূর্ণ থাকে তখন বাতাসের সঙ্গে বড় বড় ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। এই বড় বড় ঢেউ বা ‘আফাল’ আর ‘বলনের’ ঘূর্ণায়মান ঢেউয়ের তা-বে হাওড় পাড়ের বাড়ি ঘর ভেঙে যায়। বন্যা, জলাবদ্ধতা আর আফাল ও বলনে নিঃস্ব হন হাওড় তীরের মানুষ।
কোথায় থাকবেন
হাওড়ে বিল ইজারাদারদের অস্থায়ী কুটিরগুলোর পশে বিল ইজারাদারদের অনুমতি নিয়ে তাঁবু টাঙিয়ে অনায়াসেই হাওড়ে রাত্রীযাপন করতে পারবেন। হাওড় এলাকায় জোছনা রাতে তাঁবু ফেলে ক্যাম্পিং করার মুহূর্তগুলো আপনাকে আজীবন আনন্দ দেবে।
হাকালুকি হাওড়ে ভ্রমণের সময় নৌকার মাঝির সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় বাজার করে নিলে মাঝিই আপনাদের রান্না করে খাওয়াবে। এছাড়া নৌকায় উঠার সময় বিস্কুট, চা, পাউরুটি, খাবার পানি ইত্যাদি হালকা খাবার নিয়ে ভ্রমণ করতে পারেন। তাছাড়া হাওড়ে কর্মজীবী মানুষদের ম্যানেজ করতে পারেন। তবে অল্প টাকায় তাদের সঙ্গে হাওড়ে টাটকা মাছের ঝোল দিয়ে গরম ভাতের ব্যতিক্রমী স্বাদে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে পারবেন। এ ছাড়া হাওড়ে বেশ অল্পমূল্যে গরু অথবা মহিষের দুধ পাওয়া যায়। এছাড়া কুলাউড়া, বড়লেখা অথবা মৌলভীবাজার সদরে রাত্রীযাপন করতে পারবেন।
হাইল হাওড়
শ্রীমঙ্গল উপজেলা, মৌলভীবাজার জেলা সদর ও হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত একটি বৃহৎকার জলাভূমির নাম হাইল হাওড়। ১৪টি বিল ঘেরা হাইল হাওড়ে সর্বমোট আয়তন প্রায় ১০ হাজার হেক্টর। প্রচুর লতা ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ থাকার কারণে স্থানীয়দের কাছে এটি লতাপাতার হাওড় নামেও পরিচিত।
হাওড়ে চিরায়ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নীল আকাশ ও পানির মিতালী যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির বাস্তব রূপ। সে কারণে হাওড়ের বুকে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে সারাদেশের ভ্রমণকারীরা এই ভূস্বর্গে ছুটে আসেন। হাইল হাওড়ে অপরূপ সৌন্দর্যের পাশাপাশি জীববৈচিত্রেরও কোনো ঘাটতি নেই। হাইল হাওড়ে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও অন্যান্য প্রাণী দেখা যায় এখানে। এই হাওড়ে প্রায় ৯৮ প্রজাতির মাছ ও প্রায় ১৬০ প্রজাতির পাখির বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে হাইল হাওড়ে পূর্বে ৯৮ প্রজাতির মাছের আবাসস্থল থাকলেও বর্তমানে এদের মধ্যে ২১ প্রজাতি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং আরও ১১ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মাছগুলো হলো বাচা, ঘারুয়া, ছেপচালা, বাঘাইড়, ঢেলা, রিটা, বাঁশপাতা, রানী, নাফতানি, নাপিত কই, কাশখয়রা, তারা বাইম, বামোশ, বড় বাইম, তিতপুঁটি, নামা চান্দা, একথুটি, চাকা, শ্বেত সিং, শ্বেত মাগুর মাছ। পক্ষান্তরে বিলুপ্তপ্রায় মাছগুলো হলো- পাবদা, আইড়, বেদা, মিনি, ফলি, গজার, গুলশা, গুতম, বালিয়া, উফলা, বাঘাগুতম, দাড়কিনি, টাকি, চিতল, টাটকিনি ও তারা বাইন।
হাওড়ে চিরায়ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নীল আকাশ ও পানির মিতালী যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির বাস্তব রূপ। সে কারণে হাওড়ের বুকে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে সারাদেশের ভ্রমণকারীরা এই ভূস্বর্গে ছুটে আসেন। হাইল হাওড়ে অপরূপ সৌন্দর্যের পাশাপাশি জীববৈচিত্রেরও কোনো ঘাটতি নেই।
বিচিত্র রূপে জীববৈচিত্র নিয়ে হাইল হাওড়। এ হাওড় বর্ষা ও শীতে একেক রূপ ধারণ করে। হাইল হাওড়ে ভ্রমণে বর্ষা এবং শীতে বেড়ানোর উপযুক্ত সময়। এই দুই সময়ে বেড়ানো স্ব^াদ ভিন্ন ভিন্ন। বর্ষায় হাওড়ের চারিদিকে শুধু অথৈই জলরাশি আর শাপলা, শালুক, পদ্ম ফুল থরে থরে ফুটে আছে। পানি ভর্তি হাওড়ে ভেসে রয়েছে হিজল, তমাল, করছ। আর শীতকালে অতিথি পাখির কল কাকলিতে মুখরিত থাকে হাইল হাওড়। এরই সঙ্গে রয়েছে দেশী নানা প্রজাতির পাখি। তাদের জলখেলী, খুনসুটি, ডুবসাতার আর খাবার নিয়ে ঝগড়া অন্যরকম দৃষ্টি নান্দনিকতা। যদি নানা প্রজাতির হাজারও পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে একেবারেই কাছে থেকে পাখিদের রাজ্য হারিয়ে যেতে চান তাহলে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে হাইল হাওড় ভ্রমণ করতে পারেন।
শীত আসলেই পৃথিবীর শীত প্রধান দেশ থেকে অতিথি পাখি দল বেঁধে ওখানে আসে। কোনো কোনো বছর বাইক্কা বিলে শীতের অতিথি পাখির আনাগোনা বাড়ে আবারও কোনো কোনো বছর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হিসেবে পাখি বিশেষজ্ঞরা বলছেন অতিথি পাখিরা যেখানে নিজেদের খাবার ও নিরাপদ আবাসস্থলে থাকে সেখানেই তারা অস্থায়ী নিবাস গড়ে। অগ্রবর্তী দলের কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করে তারা ওখানেই ছুটে। বাইক্কা বিলের চারপাশে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাখির কিচিরমিচির শব্দ, ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়ানো ও বিলের পানিতে ঝাঁপাঝাঁপির দৃশ্য মন কাড়ে প্রকৃত প্রকৃতি প্রেমীদের। আর এসব অতিথি পাখি ও বিলের সৌন্দর্য অবলোকন করতে শীত মৌসুমে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসেন হাজারো দর্শনার্থী। পর্যটকরা পাখির কল-কাকলি ও বিলের ওয়ার্চটাওয়ারে চূড়ায় দাঁড়িয়ে মনভরে সৌন্দর্য উপভোগ করেন।
যেভাবে বাক্কাবিলের যাত্রা শুরু
২০০৩ সালে চাপড়া, মাগুড়া ও যাদুরিয়া বিলের ১০০ একর জলাভূমিতে বাইক্কা বিল নামে একটি স্থায়ী মাছের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে বিলটি মাছের পাশাপাশি পাখির নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে উঠে। বাইক্কা বিল অভয়াশ্রমটির জীববৈচিত্র্য ফিরে পাওয়া ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য শুরু থেকে সরকার বড়গাংগিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে। ফলে ক্রমান্বয়ে বিলে পাখি ও মাছের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে যায়। হাইল হাওড়ে বাইক্কাবিলে সর্বশেষ জরিপে ৩৯ প্রজাতির শীতের পাখির দেখা মিলে। এসব পাখির মধ্যে পানকৌড়ি, বেগুনিকালিম, ভুতিহাঁস, পাতিতেলি হাঁস, রাজসরালী, চখাচখি, বালিহাঁস অন্যতম। এখন বছরজুড়ে অতিথি পাখিরাও এখানে স্থায়ীভাবে আবাসস্থল গড়ে তুলছে। বিলের পাড়ে পাখিদের কৃত্রিম বাসা তৈরি করে দেওয়াতে সেখানে তারা নিরাপদে নিজেদের ঘর সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। বাইক্কাবিলের ব্যতিক্রমী আর্কষণীয় দৃশ্য হলো বিলের পাড়ে নানা প্রজাতির গাছ-গাছালি ও ঝোপ জঙ্গল। আর ওখানেই নিরাপদ বসবাস নানা প্রজাতির বনজ ও জলজ জীববৈচিত্র্যের।
হাইল হাওড় ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
সাধারণত বর্ষাকাল হাওড়াঞ্চল ভ্রমণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তবে যদি নানা প্রজাতির হাজারো পাখির কলকাকলিতে মুখর হতে চান তাহলে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে হাইল হাওড় ভ্রমণ করতে পারেন।
ঢাকার ফকিরাপুল কিংবা সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে হানিফ, শ্যামলী, এস আলম, এনা পরিবহনের সিলেটগামী বাস শ্রীমঙ্গল পৌঁছাতে পারবেন। ভাড়া লাগবে ৫৭০-৬৫০ টাকা। এছাড়া কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে পারাবত, জয়ন্তিকা, উপবন, কালনী প্রভৃতি আন্তঃনগর ট্রেনে চড়েও শ্রীমঙ্গল আসা যায়। শ্রেণিভেদে ট্রেনের টিকিটের ভাড়া লাগবে ২৭৫ টাকা থেকে ৯৩৮ টাকা।
শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজার সড়কে অবস্থিত কালাপুর বাজার হয়ে বরুনা-হাজীপুর পাকা রাস্তা ধরে হাজীপুর বাজারে চলে আসুন। যদিও স্থানীয়দের কাছে এই বাজারটি ঘাটেরবাজার নামে পরিচিত। ঘাটেরবাজার থেকে যে কোনো স্থানীয় যানবাহন কিংবা পায়ে হেঁটে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হাইল হাওড় পৌঁছাতে পারবেন মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগের সঙ্গে।
কোথায় খাবেন
হাওড় এলাকার মানুষদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় খরচ দিয়ে অথবা তাদের খাবার শেয়ার করে খেতে পারবেন। প্রয়োজনে বিস্কুট, পাউরুটির মতো শুকনো খাবার নিয়ে যেতে পারেন। তাছাড়া মৌলভীবাজার শহর অথবা শ্রীমঙ্গলেও খেতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন
হাইল হাওড়ে কাছেই মৌলভীবাজার জেলা শহর ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহরের অবস্থান। আর শ্রীমঙ্গলে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। যার মধ্যে পাঁচ তারকা হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান, রেইন ফরেস্ট রিসোর্ট, হোটেল প্লাজা, টি টাউন রেস্ট হাউস, হোটেল প্লাজা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আর মৌলভীবাজারে আছে পাঁচ তারকা মানের দুসাই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা, রাঙ্গাউঠি রিসোর্ট, রেস্ট ইন হোটেল, হোটেল নিদ শোভা, ওয়েস্টান প্লাজা, হোটেল কায়রান।
হাইল হাওড় ভ্রমণে পরামর্শ
হাইল হাওড় ভ্রমণে সুবিধার্থে হাজীপুর বাজারে গাইড পাওয়া যায়। যদিও এখানে গাইডের প্রয়োজন নেই তবু চাইলে গাইডের সাহায্য নিয়ে সহজে হাইল হাওড় ও বাইক্কা বিল ঘুরে দেখতে পারবেন।
কাউয়াদিঘী হাওড়
মৌলভীবাজার জেলা সদর ও রাজনগর উপজেলায় কাউয়াদিঘীর হাওড়ে অবস্থান। এটি একটি মিঠা পানির মৎস্য উৎপাদনের অন্যতম আধার। কাওয়াদিঘী হাওড়ে জল সবসময়ই কাক চক্ষুর মতো কালো বর্ণের বলে নামকরণ করা হয়েছে কাউয়াদিঘী। মৌলভীবাজার ও রাজনগরের মাছের চাহিদার প্রায় ৬০ ভাগ এই হাওড় থেকে আসে। জীব বৈচিত্রময় হাওড়টি বিধাতার এক অপরূপ সৃষ্টি। বর্ষায় হাওড়ের দিকে থাকালে মনে হয় একটি সমুদ্র। আর শীতকালে শীতের পাখির আগমন। সবকিছুই দেখার মতো।
বিচিত্র রূপে জীববৈচিত্র নিয়ে কাউয়াদিঘী হাওড় বর্ষা ও শীতে একেক রূপ ধারণ করে। বর্ষায় কাওয়াদিঘী হাওড়ে চারিদিকে শুধু কাক চক্ষু অথৈই জলরাশি আর শাপলা, শালুক, পদ্ম ফুল থরে থরে ফুটে থাকে। পানি ভর্তি হাওড়ে ভেসে থাকে হিজল, তমাল, করছ। আর শীতে অতিথি পাখির কল কাকলিতে মুখরিত থাকে কাওয়াদিঘী হাওড়। যদি নানা প্রজাতির হাজারো পাখির কলকাকলিতে মুখর হতে চান তাহলে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে কাওয়াদিঘী হাওড় ভ্রমণ করতে পারেন।
মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলায় কাউয়াদিঘী হাওড়ে আয়তন সাড়ে ২২ হাজার হেক্টর বিস্তৃত। কাউয়াদিঘী হাওড়ে সংযোগ ছিল কুশিয়ারা ও মনুনদীর সঙ্গে। এতে নদী থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মা মাছ কাউয়াদিঘী হাওড়ে এসে ডিম দেয়। সেই ডিম থেকে কোটি কোটি মাছের পোনা হতো। সেই পোনা মাছই নদী-নালা, খাল-বিল হাওড়ে ছড়িয়ে পড়তো এবং প্রাকৃতিকভাবে ভরপুর হতো। কাউয়াদিঘী হাওড়ে গভীরতা বেশি থাকায় এক সময় বড় বড় আকারের দেশীয় মাছের জন্য বিখ্যাত ছিল। ধীরে ধীরে কাউয়াদিঘী হাওড়ে নাব্যতা হারিয়ে ফেলায় হাওড়ে প্রাকৃতিক মাছ কমে যেতে থাকে।
হাওড়ে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় করণীয়
মৌলভীবাজারকে বন্যা হতে রক্ষা করতে ও হাওড়ে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিকল্পিতভাবে এ জেলার বড় নদী মনু, ধলাই, ফানাই, জুড়ী নদী, গোপলা ও কুশিয়ারাসহ জেলার হাওড়, খাল ও বিল খনন করতে হবে। বন্যা আসলে তাড়াহুড়া করে অস্থায়ী কিছু কাজ করে দেখানো হয়। পরবর্তীতে আর কোনো কাজ হয় না। সমস্যার কথা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা ভুলে যান। মাঝেমধ্যে খননের জন্য বরাদ্দ আসলেও এ কাজ পরিপূর্ণভাবে করা হয় না। বন্যার স্থায়ী সমাধান নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা নেই বলে চলে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৌলভীবাজারের হাওড়গুলোকে বন্যা কবল থেকে রক্ষা করতে হলে পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগী হতে হবে। বন্যা আসলে তাড়াহুড়া করে অস্থায়ী কিছু কাজ করে দেখানো হয়। পরবর্তীতে আর কোনো কাজ হয় না। সমস্যার কথা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা ভুলে যান। মাঝেমধ্যে খননের জন্য বরাদ্দ আসলেও এ কাজ পরিপূর্ণভাবে করা হয় না। হরিলুট হয়ে যায়।