লালমনিরহাটে একই উঠানে মসজিদ ও মন্দির
মাত্র দশ হাতের ব্যবধানে পাশাপাশি জামে মসজিদ ও সার্বজনীন দুর্গা মন্দির। একপাশে আতরের সুঘ্রাণ, অন্য পাশে ধূপকাঠি। মসজিদে নামাজ পড়ছেন মুসল্লিরা, মন্দিরে পূজা দিচ্ছেন পূজারীরা। এভাবে তিন যুগেরও অধিক সময় ধরে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রেখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সরিকল ইউনিয়নের আধুনা শেনেরহাট এলাকার দুইটি ধর্মীয় উপাসনালয়। ধর্ম ভিন্ন হলেও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির অটুট বন্ধন দীর্ঘদিনের।
আধুনা শেনেরহাট জামে মসজিদের মাত্র ১০ হাত দূরত্বে আধুনা সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরের অবস্থান। দুই সম্প্রদায়ের আলাদা ধর্মীয় উপসনালয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্যেই চলছে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। মন্দির থেকে ভেসে আসছে দুর্গা পূজার ঢাকঢোল, উলু, শঙ্খধ্বনি ও মাইকের শব্দ। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিরোধ তো দূরের কথা, স্থানীয় মুসলিম নর-নারীরা প্রতিবেশী হিন্দুদের পূজা উদ্যাপনে সহায়তা করছেন। অনেকেই আবার প্রতিমা দেখতে আসেন পূজা মন্ডপে। উপভোগ করেন সন্ধ্যার আরতি। তবে মসজিদে আজানের সময় নীরবতা বজায় রাখেন পূজারী ও ভক্তরা।
একইভাবে উপজেলার বিল্বগ্রাম বাজার জামে মসজিদ ও ঈদগাহ মাঠের পাশেই রয়েছে বাজার মন্দির। সেখানেও দীর্ঘ বছর ধরে সম্প্রীতি বজায় রেখে ধর্ম পালন করে আসছেন দুই সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা। স্থানীয় বাসিন্দা বলেছেন, এখানে সবাই মিলেমিশে নিজ নিজ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করেন। তাদের পূর্ব পুরুষরাও এমনটি করে গেছেন। ছোটবেলা থেকেই তারা পূজা দেখতে মন্ডপে যান। আবার ঈদে কিংবা বিয়ের অনুষ্ঠানেও আসেন হিন্দু প্রতিবেশীরা। আধুনা দুর্গা মন্দিরের পূজারী উপেন চন্দ্র মন্ডল বলেন, মসজিদে কোন ওয়াক্তের কখন আজান হবে, কখন নামাজের জামাত শুরু হয়ে শেষ হবে, তার তালিকা আগেভাগেই মন্দিরের মধ্যে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে কারণে মসজিদে আজান শুরু হওয়ার আগ থেকে নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পুরো অনুষ্ঠানের বিরতি দেওয়া হয়। নামাজ শেষে আবার শুরু হয় পূজা-অর্চনা। তিনি আরও বলেন, আমাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ এ সম্পর্ক চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। কেউ কারও জন্য কখনো বিরক্তির কারণ হয়নি। বংশ পরম্পরায় দুই ধর্মের অনুসারীরা আগলে রেখেছেন সম্প্রীতির বন্ধন।
মন্দির কমিটির সভাপতি শংকর চন্দ্র দাস বলেন, বিগত অর্ধশত বছর ধরে আমরা আধুনা শেনের বাড়ি সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরে পূজা করে আসছি। বিগত তিন যুগ পূর্বে মন্দির থেকে মাত্র ১০ হাত দূরত্বে জামে মসজিদ গড়ে ওঠে। সেই থেকে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করে আসছি। এখানে কারও মধ্যে হিংসা কিংবা বিদ্বেষের কোনো চিহ্ন নেই।
আধুনা শেনের বাড়ি জামে মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মো. জাকারিয়া ইসলাম বলেন, আমি বিগত ছয়মাস যাবত এ মসজিদে ইমামতি করে আসছি। এখানে ধর্ম নিয়ে কেউ কোনো বাড়াবাড়ি করে না। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা আমাকে দেখলে কুশলাদি বিনিময় করে। আমিও তাদের খোঁজখবর রাখি। কারও মধ্যে কোনো বিভেদ নেই।
সম্প্রীতির অন্যান্য ও মেলবন্ধন পরিদর্শনে এসে কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও বরিশাল-১ আসনের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবাহান বলেন, এখানে সম্প্রীতি বজায় রেখে যার যার ধর্ম পালিত হচ্ছে, যা সামাজিক সম্প্রীতির নজির স্থাপন করেছে। বিএনপির চেয়ারপার্সনের নির্দেশে এ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধরে রাখতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। গৌরনদী মডেল থানার ওসি মো, ইউনুস মিয়া বলেন, পাশাপাশি মসজিদ-মন্দির স্থাপন করে এখানকার মানুষরা সম্প্রীতির যে নজির স্থাপন করেছেন তা বিরল। এখান থেকে আমাদের নতুন প্রজন্ম সম্প্রীতির শিক্ষা পাবে বলে মনে করছি। গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পৌর প্রশাসক মো. আবু আবদুল্লাহ খান গত ১০ অক্টোবর রাতে সরেজমিনে ওই এলাকা পরিদর্শন করে বলেন, দীর্ঘবছর থেকে একইস্থানে মসজিদ ও মন্দিরের অবস্থান। এখানে যে যার মতো ধর্ম পালন করে আসছেন। এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি অনন্য নিদর্শন। তাদের এ সম্প্রীতির বন্ধন দেশব্যাপী প্রেরণা জোগাবে।
লালমনিরহাট ॥ জেলা শহরের কালীবাড়ি এলাকার একই আঙ্গিনায় মসজিদ-মন্দির সম্প্রতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সেখানে একই প্রাঙ্গণে মসজিদের মাইকে হচ্ছে আজান আর আরেক পাশে দেওয়া হচ্ছে উলুধ্বনি। মসজিদের আগরবাতি বা আতরের গন্ধ একাকার হয়ে যায় মন্দিরের ধূপের গন্ধে। দেড়শ’ বছর ধরে সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে পাশাপাশি চলছে পৃথক দুটি ধর্মের উপাসনালয়। লালমনিরহাট জেলা শহরের কালীবাড়ি এলাকায় মসজিদ মন্দিরের অবস্থান। আলাদা ধর্মের মানুষের আলাদা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দুটির অবস্থান মাত্র ৬ ফুট ব্যবধানে। মন্দিরটির নাম কেন্দ্রীয় কালীবাড়ি শ্রীশ্রী দুর্গা ও কালীমন্দির আর মসজিদটির নাম পুরান বাজার জামে মসজিদ। ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতীক একই আঙ্গিনার মন্দির-মসজিদ দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা এখানে আসেন। তারা স্থানটি ঘুরে দেখেন। দুর্গা পূজায় দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় থাকে।
মন্দিরে আসা পূজারী আর মসজিদে আসা মুসল্লিরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলেন। এখানে এসে তারা ধর্মীয় সম্প্রীতির বন্ধনকে মানবতার বন্ধন হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। জানা যায় ১৮৩৬ সালে প্রথমে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়, পরবর্তীতে বাজার এলাকার মুসল্লিরা তাদের নামাজ আদায়ের করার জন্য ছোট মসজিদ ঘর নির্মাণ করেন পরবর্তীতে ওই মসজিদের নামকরণ করা হয় পুরান বাজার জামে মসজিদ।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পূজা শুরুর আগে মসজিদ ও মন্দির কমিটি সদস্যরা বসে সিদ্ধান্ত নেয় নামাজ ও পূজার অনুষ্ঠানে সূচি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। ফলে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে না। আজান থেকে নামাজের জামাত শেষ না হওয়া পর্যন্ত মন্দিরের মাইক, ঢাকঢোলসহ যাবতীয় শব্দযন্ত্র বন্ধ থাকে। নামাজ শেষ হলে মন্দিরের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়। এখানে কোনো বিশৃঙ্খলাও হয় না। শালীনতা বজায় রেখে একই উঠানে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করে আসছেন উভয় ধর্মের ধর্মাবলম্বীরা। কালীবাড়ি মসজিদের মুসল্লি কেরামত আলী বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে এখানে দুর্গাপূজাসহ অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিন্দুসম্প্রদায়ের লোকজন উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গেই করে আসছে। অন্যদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনও মসজিদে নামাজ আদায় করে আসছেন। এখানে ধর্ম পালনে কোনো রকম বাধা নেই। সবাই যার-যার ধর্ম পালন করছে সম্প্রীতির মাধ্যমে। পুরান বাজার জামে মসজিদের আরেক মুসল্লি ফখরুদ্দীন জানান, ঐতিহ্যবাহী পুরান বাজার মসজিদের পাশেই রয়েছে মন্দির। মসজিদের আগে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবুও এখানে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবশ্রেণির মানুষ যার যার ধর্ম পালন করে এখানে কোনো বিশৃঙ্খলাও হয় না।
কালীবাড়ি মন্দিরের প্রধান পুরোহিত শ্রী শংকর চক্রবর্তী জানান, ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এলাকার নামকরণও করা হয় কালীবাড়ি। পরে এখানে বাজার গড়ে উঠলে বাজারের ব্যবসায়ী ও শহরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মন্দিরের দেওয়াল ঘেঁষে প্রতিষ্ঠা করেন পুরান বাজার জামে মসজিদ। সেই থেকে এক উঠানে চলছে দুই ধর্মের দুই উপাসনালয়ের কার্যক্রম।
লালমনিরহাট পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম বলেন, শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে লালমনিরহাট পুলিশ বাহিনী বিভিন্ন উদ্যেগ গ্রহণ করেছে। কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ সতর্ক অবস্থায় আছে। আর পুরান বাজার জামে মসজিদ ও কালীবাড়ি মন্দিরের ঐতিহ্্য শ’ বছরের।
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার জানান, লালমনিহাটের একই আঙ্গিনায় মসজিদ ও মন্দির এটি একটি বিরল দৃষ্টান্ত, এখানকার মানুষ সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থানে বিশ্বাস করেন। যার প্রমাণ এক উঠানে কেন্দ্রীয় কালীবাড়ি মন্দির ও পুরান বাজার জামে মসজিদ।