কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা।
শারদ উৎসবের সময়টা আনন্দের হয়। আনন্দেরই হওয়ার কথা। কিন্তু এবার পূজার আগে আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের বাসাবাড়িতে, মন্দিরে হামলা হয়েছে। এখনো সেই আতঙ্ক পুরোপুরি কাটেনি। অনেকের মনে রাগ ক্ষোভ রয়ে গেছে। উৎসব আনন্দে তাই ভাটা পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ব্রিটিশ রাজের শাসনামলেও পূজার আনন্দে ভাটা পড়ার ঘটনা ঘটেছিল। গোটা দেশটাই তখন লুটেরাদের দখলে। সা¤্রাজ্যবাদী অপশক্তির অন্যায় অপশাসন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
এ অবস্থায় শারদ উৎসবে মেতে ওঠার পরিবর্তে প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছিল সর্বস্তরের জনগণ। অভিন্ন চেতনার জায়গা থেকে প্রতিবাদ জানালেন কাজী নজরুল ইসলাম। দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমনের প্রাক্কালে তিনি লিখলেন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ শীর্ষক কবিতা। হ্যাঁ, ¯্রফে একটি কবিতা। তবে নিজের সম্পাদিত ধূমকেতু পত্রিকায় এটি ছাপা হওয়ার পর পরই মহাআলোড়ন তুলল। ভিত কেঁপে উঠল ব্রিটিশ বেনিয়াদের। এতটাই কেঁপে উঠেছিল যে, তারা কবিকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠাতে দ্বিধা করেনি! কী লিখেছিলেন কবি?
দীর্ঘ কবিতা। সাহিত্যপ্রেমীরা নিশ্চয়ই পড়ে থাকবেন। বাকিদের জন্য প্রথম কয়েক পঙ্ক্তি তুলে ধরা যাক এখানে। নজরুল লিখছেন : ‘আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।/দেব-শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,/ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?’ অর্থাৎ, দেবীর মাঝে যে শক্তি সে শক্তি নিজের ভেতরে ধারণ করে ব্রিটিশদের অপশাসনের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ গড়ে তোলার আহ্বান ছিল কবিতায়। উৎসবের কবিতাকে তাই দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
সে সময় বিখ্যাত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা সম্পাদনা করছেন নজরুল। ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি ছাপা হয়। আর ২৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ‘আনন্দময়ীর আগমনে।’ আজকের দিনে হলে হয়তো কারও চোখেই পড়ত না। ফেসবুকে স্থূল চর্চায় ব্যস্ত সবাই। তবে ওই যুগে কবিতার ধার বোঝার মতো বিদগ্ধ পাঠক ঢের ছিল। সরকারও তাই কবি বা কবিতা ভয় পেত। মত প্রকাশের অধিকার তাদের কাছে পাত্তা পেত না।
তাই ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ ছাপা হয়েছিল যে সংখ্যায় সে সংখ্যাটি তারা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এটি ৮ নভেম্বরের কথা। ২৩ নভেম্বর ঘটায় আরও এক ন্যক্কারজনক ঘটনা। নজরুলকে ওই দিন সরকার বাহাদুরের পুলিশ কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয় কবিকে। ‘যুগবাণী’ শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থটিও বাজেয়াপ্ত করা হয়।
নজরুলকে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় ভারতজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। শুধু মাটির প্রতিমায় আটকে না থেকে মানুষ নিজের শক্তিতে নতুন করে জেগে ওঠার অনুপ্রেরণা পায়। নজরুল নিজেও দমে যাওয়ার পাত্রটি নন। কারাগারে বসেও দ্বিগুন জ্বলে ওঠেন। এই জ্বলে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যায় কবির ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ শিরোনামের রচনাটিতে। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এই জবানবন্দি প্রদান করেন তিনি। চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে দেওয়া লিখিত জবানবন্দিটিও আজ অমর সাহিত্য, অবিস্মরণীয় প্রতিবাদ হয়ে টিকে আছে।
জবানবন্দিতে নজরুল বলেন : ‘আমার ওপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত। আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচার সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে...।’
অবশ্য কোনো যুক্তিই গ্রাহ্য করেনি সা¤্রাজ্যবাদী শোশকগোষ্ঠী। তাদের নিয়ন্ত্রিত আদালত নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ঠাঁই হয় কবির। কিন্তু প্রতিবাদ অব্যাহত ছিল কারাগারের বাইরে ও ভেতরে। নজরুল কারাগারে থাকা অবস্থায় তাঁর প্রতি সমর্থন জানান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর অংশ হিসেবে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানয়ারি বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি প্রিয় নজরুলকে উৎসর্গ করেন তিনি।
মজার ব্যাপার হলো, এই আনন্দে আরও একটি দূর্দন্ত কবিতা লিখে ফেলেন বিদ্রোহী কবি। কোন সে কবিতা? খুব পড়েছেন। বৈরি সময়ে আতঙ্ক নিয়ে উদ্যাপনের মুহূর্তে আবার পড়ে নিন: ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে–/মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে...।’