সংগৃহীত ছবি
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, যার ধনসম্পদ বেশি, সে বড়ো বলে বিবেচিত। অর্থসম্পদ মানুষকে সমৃদ্ধ জীবনযাপন করতে সাহায্য করে, নিজেকে বড়ো বলে ভাবার সুযোগ তৈরি করে দেয়। কিন্তু অর্থসম্পদ বেশি হলেই যে কেউ বড়ো বলে বিবেচিত হবে, তা নয়। যার মন বড়ো অর্থাৎ যিনি উদার, পরোপকারী, সৎ, তিনিই যথার্থ বড় মাপের মানুষ। এক গর্ভবতী নারীর জীবন বাঁচাতে রক্ত দিয়ে এমনই এক নজির গড়লেন অটোরিকশা চালক তরিকুল ইসলাম তরিক।
সোমবার (৭ অক্টোবর) ফেসবুক গ্রুপ ‘বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র’ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, প্রায় দুই বছর আগে বিয়ে করেছেন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন যুবক খালেদ মাহমুদ খান সোহাগ। শারীরিক নানা প্রতিবন্ধকতার তার দুই পা অচল। চলাফেরা করেন হুইল চেয়ারে। গর্ভবতী স্ত্রী আয়েশা খান স্বাস্থ্যগত জটিলতা থাকায় গত ৩ অক্টোবর দুপুর ১২টায় স্ত্রীকে জরুরি ভিত্তিতে টাঙ্গাইলের সোনিয়া ক্লিনিকে ভর্তি করান। ভর্তিতে দেরি হওয়া ও রোগীর অবস্থা বিবেচনায় সিজারের সময় নির্ধারিত হয় ওই দিন সন্ধ্যায়।
তার স্ত্রীর সিজারের দায়িত্বে থাকা ডা. সাদিয়া সিদ্দিকা ইথার জানান, সন্ধ্যার মধ্যে দুই ব্যাগ এ নেগেটিভ রক্ত লাগবে। এরপর গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না সোহাগ।
গত ১ অক্টোবর থেকেই সোহাগ পূর্ব প্রস্তুতিস্বরূপ পরিচিতজনসহ ফেসবুকের মাধ্যমে রক্তের সন্ধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সোহাগের হয়ে রক্ত চেয়ে ফেসবুকে একাধিকবার পোস্ট দিতে দেখা গেছে, জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবরসহ আরও অনেককেই, তবুও মিলেনি প্রত্যাশিত গ্রুপের রক্ত।
সোহাগ বলেন, ইতোপূর্বেই আমি এ নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত চেয়ে ফেসবুকে অনেক গ্রুপ, পেজে পোস্ট শেয়ার করেছি। তা থেকে অনেকেই আশা দিলেও বাস্তবে পাওয়া যাচ্ছিলো না কাউকেই। গত ৩ অক্টোবর দুপুরেও যখন কোনোভাবেই গর্ভবতী স্ত্রীর জন্য রক্তের জোগাড় হয়নি তখন এ অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়ি। কোনো কূল কিনারা না পেয়ে সহযোগিতার জন্য যোগাযোগ করি বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র প্ল্যাটফর্মের কর্ণধার গিরিধর দে-র সঙ্গে।
স্বেচ্ছাশ্রমে দেশ ও সমাজের কল্যাণে একযুগ ধরে কাজ করা উদ্যোক্তা, সংগ্রাহক ও সমাজ উন্নয়ন সংগঠক গিরিধর দে ঘটনার বিস্তারিত জেনে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। এরপর যোগাযোগ করেন টাঙ্গাইলে থাকা ‘বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র’ এর সদস্য লেখক মন্নুজান মুন্নী ও টাঙ্গাইলে অবস্থানরত স্থানীয় রক্তদাতা সংগঠনগুলোর সাথে। মুন্নী নিজে রক্ত জোগাড় করে দিতে না পারলেও কোনো ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত কিনে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এগিয়ে আসে আরেক সদস্য তানভীর সরকার টুটুল।
গিরিধরের অনুরোধে তৎক্ষণাৎ ব্লাড ব্যাংকে যান রক্তের খোঁজে কিন্তু কোথাও পাওয়া যায় না। অবশেষে কোথাও জোগাড় করতে না পেরে ‘বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র’ প্ল্যাটফর্মের ১২ লক্ষাধিক সদস্য বিশিষ্ট ফেসবুক গ্রুপে অন্তঃসত্ত্বা এক মায়ের জীবন বাঁচাতে টাঙ্গাইলের মানুষদের খোঁজ করে বিস্তারিত লিখে এ নেগেটিভ গ্রুপের ২ ব্যাগ রক্ত চেয়ে পোস্ট করেন গিরিধর। তার আহ্বানে অনেকে রক্ত দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
তবে আগ্রহীদের বেশিরভাগ ঘটনাস্থল থেকে দূরে থাকায় তাদের কাছ থেকে রক্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। এরপর গ্রুপে গিরিধরের পোস্ট নজরে আসে টাঙ্গাইলের নিম্ন পেশাজীবী তরিকুল ইসলাম তরিকের। তিনি পোস্টের বিস্তারিত জেনে যোগাযোগ করেন। রক্ত দিতে প্রস্তুত বলে জানান। পোস্টটি পড়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে ছুটে যান তরিক। বিকাল চারটায় তার রক্ত সংগ্রহ করা হয়।
তারিক টাঙ্গাইল সদরের পাঁচ কাহনিয়া গ্রামের দাইন্যা ইউনিয়নের বাসিন্দা ও পেশায় একজন অটোরিকশা চালক। সেদিনও অটো নিয়ে ক্লিনিক থেকে ২০ মিনিটের দূরত্বে ছিলেন তিনি। ফেসবুকে পোস্ট পড়েই তরিক তৎক্ষণাৎ ফোন করেন এবং রক্ত দিতে ছুটে আসেন। রক্ত সংগ্রহ করা হয় তার। এছাড়াও সেদিন পোস্ট পড়ে রক্ত দিতে হাসপাতালে ছুটে আসেন পলাশ গোস্বামী নামের আরও এক ব্যক্তি।
অবশেষে রক্ত পাওয়ার পর অপারেশন শুরু হয়। সফলভাবে অপারেশন সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে খালেদ মাহমুদ খান সোহাগ ও আয়েশা খান দম্পতির কোল জুড়ে সন্ধ্যা ৭টা ১২ মিনিটে পৃথিবীতে আসে এক ফুটফুটে মেয়ে সন্তান। পরদিন ৪ অক্টোবর বিকালে সোনিয়া ক্লিনিকে মা ও শিশুকে দেখতে যান টাঙ্গাইলে বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্রর সদস্য মন্নুজান মুন্নী। এ সময় তিনি সবার খোঁজখবর নেন এবং নবজাতক শিশুকে কোলে নিয়ে দোয়া ও শুভ কামনা জানান।
খালেদ মাহমুদ খান সোহাগ জানান, তাদের মেয়ের নাম রেখেছেন আনায়া আশরীন খান (সোহা)। নবজাতক ও তার মা উভয়ই সুস্থ আছে। সকলে কাছে তাদের মেয়ের জন্য দোয়া চেয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র প্ল্যাটফর্ম এবং তার কর্ণধার গিরিধর দে, রক্তদাতা তরিকুল ইসলাম তরিক ও প্ল্যাটফর্মটির সদস্য মন্নুজান মুন্নী, পলাশ গোস্বামী, তানভীর সরকার টুটুল সহ সকল সদস্যদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।
এসআর