ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১

বাবা-মাকে সময় দিন

শিউলী আহমেদ

প্রকাশিত: ২১:২৩, ৬ অক্টোবর ২০২৪

বাবা-মাকে সময় দিন

বাবার খোঁজ নিচ্ছেন ছেলে কবির

শুভর বাবা সরকারি চাকরি শেষে দুই মেয়েকে নিয়ে গ্রামে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। ছোট ভাইকে নিয়ে সে থাকতে শুরু করে চাচার বাসায়। তখন তার ¯œাতকোত্তর ফাইনাল পরীক্ষা। বাবার গ্রামে ফিরে যাওয়াটা সে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। পরীক্ষা দিয়েই তাই চাকরির চেষ্টা শুরু করেÑ বাবা-মাকে বোনদেরসহ আবার ঢাকায় নিয়ে আসতেই হবে। ৩/৪ বছরের মাঝেই সে বাবা-মাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। ততদিনে বড় বোনটার বিয়ে হয়ে গেছে।

অনেকদিন পর যোগাযোগ হলে জানতে পারলাম- ভাই-বোনগুলো সবাই ঢাকাতেই আছে, তারাও সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে বাবা-মাকে তার কাছেই রেখেছে। তার ভাষায়Ñ বাবা-মা হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে বড় নেয়ামত। শুভ তার দাদা-দাদিকে তাদের পরিবারেই পেয়েছে। তার বাবা যে কোনো প্রয়োজনে তাঁদের পরামর্শ নিতেন। তাঁদের খুব যতœ করতেন। দাদা-দাদিরও তাদের সঙ্গে খুব ভাব ছিল। তারা ভাই-বোনেরা সারাক্ষণ তাঁদের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে থাকতেন। বাসায় মুরব্বি থাকলে সংসারে আল্লাহর রহমতের ছায়া থাকে। তা ছাড়া বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা করতে পারা বিশাল সৌভাগ্যের বিষয়। পঞ্চাশোর্ধ শুভ তাই তাঁদের নিজের কাছে রেখে সেবা-যতœ করতে চান।
আমাদের দেশে একটা সময় বেশিরভাগ পরিবারগুলোই ছিল যৌথ। বাড়ির বয়োবৃদ্ধ দাদা-দাদিদের ঘিরে আমাদের অনেক আনন্দময় সময় কাটত। তাদের মনে করা হতো বাড়ির বটবৃক্ষ। তাদেরও শেষ বয়সটা ছেলে, বউ, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সুখেই কাটত। যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তারা ছিলেন সবার ভরসার জায়গা। কিন্তু কালের বিবর্তনে জীবিকার তাগিদে সেই যৌথ পরিবার ভেঙে এখন একক পরিবারে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামের পরিবার থেকে ছেলেমেয়েরা যখন জীবিকার তাগিদে শহরমুখী হয়, তখন স্বাভাবিকভাবে বয়োবৃদ্ধরা একটা সময় একা হয়ে যান।

কেউ শহরে এসে সন্তান আর নাতি-নাতনিদের সঙ্গে বসবাস করেন। কেউ আবার মাটির টানে থেকে যান গ্রামে। শেষ সময়টা কাটে তাদের ধর্মীয় কাজে আর আপনজনদের আবার কবে কাছে পাবেন সেই অপেক্ষায়। সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় তাদের পাঠান শহরে, কখনো বিদেশ-বিভুইয়ে। শেষ বয়সে তাদের একাকীত্ব আঁকড়ে ধরে। তবু চান সন্তান ভালো থাকুক।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ৬৫ বছর পার হলে তাকে প্রবীণ ধরা হয়। জীবনের সুবর্ণ সময় পার হয়ে এসে তারা যখন বার্ধক্যে উপনীত হয়, তখন আপনজনদের সঙ্গে সময় কাটাতে চান। কিন্তু সন্তানদের ব্যস্ততার জন্য তা আর মুখ ফুটে বলা হয় না, মেনে নেন নিজেরাই। যাদের একাধিক সন্তান আছে তারা আবার একেক সময় একেক সন্তানের বাসায় থেকে সবার সঙ্গে খুব সুন্দর সময় কাটান। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বাবা-মায়েরা মেয়ের চাইতে ছেলের সংসারে থাকতেই বেশি পছন্দ করেন।

তবে যারা তুলনামূলকভাবে শক্ত-সামর্থ্য তারা কিন্তু একা থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সন্তানদের বোঝা হতে চান না। তা ছাড়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেশিরভাগ সংসারেই স্বামী-স্ত্রী চাকরিজীবী হওয়ায় বাবা-মায়েরা তাদের বিরক্তও করতে চান না।
অক্টোবরের ১ তারিখ ছিল প্রবীণ দিবস। অনেকে এই দিবসগুলো মানতে নারাজ। তবে আমার কাছে কিন্তু বিশেষ দিবসগুলো ভালোই লাগে। 
আমরা সারা বছর যা-ই করি না কেন, দিবস উপলক্ষে একটা উৎসবে মাতি। সেই সুযোগে বাবা দিবস, মা দিবস, প্রবীণ দিবসÑ ইত্যাদি দিনগুলোতে হাজার ব্যস্ততায়ও তাদের নিয়ে একটু বিশেষভাবে সময় কাটাই। তবে বিশেষ দিনটা বিশেষভাবে কাটালেও, অন্য দিনগুলোতেও যেন আমরা আমাদের বাড়ির বয়োবৃদ্ধদের কিছুটা হলেও সময় দেই। চাকরিজীবীরা বাড়ি ফিরেই পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে যেন আমাদের বাবা-মায়েদেরও সমান সময় দিতে পারি, সেদিকে খেয়াল রাখবেন। মাঝে মাঝে তাদের নিয়ে কোথাও বেরিয়েও আসতে পারেন।

সারাদিন তারা কি করেছেন, কি খেয়েছেন, ঠিকমতো ওষুধ খেয়েছেন কি না, শরীরটা ঠিক আছে কি না- ইত্যাদি খোঁজ নিন। সারা দিনের ব্যস্ততায় সময় না পেলেও, রাতে খাবার সময় তাদের ডেকে পাশে নিন। মনে রাখবেন, তারা এই বয়সে অর্থ-সম্পদ, ভালো খাবার-পোশাক চায় না। আপনার সঙ্গ চায়, মনোযোগ চায়। কখনো তাদের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর ব্যবস্থা করে দিন। আবার তাদের বাসায় ডেকে এনে আড্ডার ব্যবস্থাও করে দিতে পারেন। ইদানীং বৃদ্ধাশ্রম বাড়ছে। অনেক ভালো পরিবারের বাবা-মাকেও দেখা যায় সেখানে। অনেকের সন্তান দেশের বাইরে থাকায় স্বেচ্ছায় সেখানে গিয়ে থাকছেন, নিরাপত্তার জন্যে। 
কেউ সন্তানদের বোঝা হতে চায় না বিধায় স্বেচ্ছায় যান। আবার অনেক সময় সন্তানরাই ঝামেলা মনে করে তাদের দিয়ে আসছেন বৃদ্ধাশ্রমে। সন্তানদের এক নজর দেখার আশায় কাটে তাদের দিন। একবার ভাবুন তো, কোনো এক সময় আপনার জীবনেও আসতে পারে এমন দিন! এক সময় অসহায়দের জন্যে ছিল এই বৃদ্ধাশ্রম। যাদের দেখার কেউ নেই বা থাকার জায়গা নেই। আমাদেরও কাম্য, শুধু অসহায়দের সহায় হিসেবেই যেন বৃদ্ধাশ্রম হয়। শেষ বয়সে কারও যেন সন্তান ও আপনজনদের ছেড়ে সেখানে থাকতে না হয়। মনে রাখবেন, তারা এক সময় নিজেদের সমস্ত সুখ-শান্তি, অর্থ বিসর্জন দিয়েছেন আপনার-আমারই সুখের জন্য।

×