ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১

সংগীত নৃত্যে আলো ঝলমলে একদিন

ছায়ানটের শরতের অনুষ্ঠান যেন জেগে ওঠার মন্ত্র

মোরসালিন মিজান 

প্রকাশিত: ২৩:৪০, ৫ অক্টোবর ২০২৪

ছায়ানটের শরতের অনুষ্ঠান যেন জেগে ওঠার মন্ত্র

ধানমন্ডির নিজস্ব ভবনে শনিবার ছায়ানটের শরৎ বন্দনা

সময়টা আগের মতো নেই। ‘মন্দ’ অর্থে নেই। ‘ভালো’ অর্থেও গ্রহণ করা যাচ্ছে না। সমাজে নানা বিভেদ। অনিশ্চয়তা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হুমকির মুখে। রাজনীতিতে টানাপোড়েন। সংস্কৃতি অঙ্গনে নীরবতা। সংগীত নৃত্য কবিতাসহ সুকুমার বৃদ্ধির নির্ভয় চর্চা কতটা সম্ভব? রীতিমতো প্রশ্ন উঠছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে জনআকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছিল তার বিপরীত ঢেউ প্রত্যক্ষ করছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। তাদের আশ্বস্ত করার, সাহস জোগানোর কেউ যেন নেই।

তবে শনিবার আপন শক্তিতে এই বন্ধ্যত্ব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে ছায়ানট। বাঙালির গর্বের প্রতিষ্ঠান সকালে নিজস্ব মিলনায়তনে শরৎ বন্দনার আয়োজন করে। গান নাচ আবৃত্তির ভাষায় শিল্পীরা প্রকৃতির রূপ পরিবর্তন  এবং এর সঙ্গে জনজীবনের সম্পর্কগুলো ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস গ্রহণ করেন। অনেক দিন পর এমন আলো ঝলমলে আয়োজন। ছায়ানট একে ‘উৎসব’ বলে না। তবে উৎসবের চেয়ে আলো ঝলমলে ছিল আয়োজনটি। জেগে ওঠার মন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে।    
মজার বিষয় হচ্ছে, মিলনায়তনে যখন অনুষ্ঠান শুরু হয় বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। বর্ষার আধিপত্য! অনুভূতির তবু হেরফের হতে দেননি শিল্পীরা। পরিবেশনা দিয়ে শরৎকে জাগ্রত করে রেখেছিলেন। মঞ্চের আলো জ্বলে উঠতেই নীল রঙের ছড়াছড়ি। শিল্পীদের পোশাকে নীল রং ছাড়াও ছিল সাদার উপস্থিতি। এভাবে শরতের চমৎকার একটা আবহ তৈরি করা হয়। প্রথম কানে আসে রবীন্দ্রনাথের গান। সম্মেলক কণ্ঠে শিল্পীরা গাইছিলেন : ওগো শেফালি-বনের মনের কামনা।/কেন সুদূর গগনে গগনে/আছ মিলায়ে পবনে পবনে...। কথা আর সুরের সঙ্গে যোগ হয় নৃত্যায়োজনও।

মুহূর্তেই উৎসবের আমেজ। এই আমেজ ক্রমে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অনুষ্ঠানে প্রথম একক গান করেন সেমন্তী মঞ্জরী। এ সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল গায়িকার কণ্ঠে ছিল : আলোর অমল কমলখানি কে ফুটালে,/নীল আকাশের ঘুম ছুটালে...। সেমন্তীর গানের গলা সকাল সকাল কী যে ভালো লাগে শ্রোতার! আর শেষের দিকে লাইসা আহমদ লিসার পরিবেশনাটি ছিল অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাওয়া। এই শিল্পীর কণ্ঠে যে কোনো গান প্রাণ পায়। আর যখন তিনি ‘বাজিল কাহার বীণা’র মতো বেজে ওঠেন তখন তো কথাই নেই।

শিল্পী তার চিরচেনা গায়কীর আশ্রয়ে গাইছিলেন, ‘লাগে বুকে সুখে দুখে কত যে ব্যথা,/কেমনে বুঝায়ে কব না জানি কথা।/আমার বাসনা আজি ত্রিভুবনে ওঠে বাজি,/কাঁপে নদী বনরাজি বেদনাভরে।’ বৃষ্টির দিনে সুখের মতো এই বেদনা বেজেছে উপস্থিত শ্রোতার মনে। অনুষ্ঠানে আরও দুটি একক গান করেন দীপ্র নিশান্ত এবং প্রিয়াঙ্কা ভট্টাচার্য্য। তাদের গাওয়া ‘কার বাঁশি নিশিভোরে’ ও ‘শরৎ-আলোর কমল বনে’ উপভোগ করেন শ্রোতা। ছোটদের পরিবেশনাগুলো ওদের মতোই মিষ্টি ছিল। বিশেষ করে নৃত্যায়োজন। প্রথম আয়োজনটি ছিল ‘দেখো দেখো, দেখো, শুকতারা’ গানের সঙ্গে। 
অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ থেকে আবৃত্তি করেন ডালিয়া আহমেদ। তার উচ্চারণ, আবেগ কবিগুরু শৈশবের শরৎ-স্মৃতিকে ধারণ করেছিল। বর্ণনাটি ছিল এ রকম : ‘এই শরতের প্রভাতের রৌদ্রে জানলার বাহির দিয়া গাছপালার দিকে চাহিয়া দেখিলেই আমার মনে পড়ে ছেলেবেলায় চারিদিকের প্রকৃতির শোভা কী একান্ত ভালো লাগিত! ভোরের বেলায় বাড়ির ভেতরের বাগানে গিয়া পথের দুই ধারে ফুটন্ত জুঁই ফুলের গন্ধে কী আশ্চর্য আনন্দ লাভ করিতাম! গাছের গোপন সবুজের মধ্য হইতে একটি আধফুটো জহরী-চাঁপা পাইলে কী যেন একটা সম্পদ লাভ করিতাম মনে হইত...।’ রফিকুল ইসলামও প্রিয় কবিতায় শরতের বন্দনা করেন।      
এভাবে গানে কবিতায় নাচে এগিয়ে চলে অনুষ্ঠান। আর শেষ হয় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া জাতীয় সংগীত দিয়ে। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসিÑ শিল্পী-শ্রোতা সকলের ভেতরের দেশপ্রেমকে নতুন করে জাগিয়ে দেয়। শরতের অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে জেগে ওঠার মন্ত্র!

×