ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় শরৎ উৎসবে নৃত্য পরিবেশনা
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে চলছে এখন শরৎকাল। যদিও গত কয়েকদিন ধরে মেঘ-বৃষ্টির খেলায় শরতের প্রকৃত রূপটি যেন ঢাকা পড়েছে। তাই বলে স্নিগ্ধতার প্রতিচ্ছবিময় ঋতুটি বিদায় নেয়নি প্রকৃতি থেকে। বরং একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, বৃষ্টির ঘনঘটা কমলেই নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘের ভেলা। কোনো এক নদীর কিনার কিংবা উন্মুক্ত প্রান্তরে উঁকি দিচ্ছে গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুল। হৃদয়ে ভালোলাগার অনুভব ছড়ানো প্রিয় এই ঋতুর বন্দনায় সরব হলো শুক্রবার ছুটির দিনের সকালটি। সেই সুবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলার মঞ্চে বরণ করে নেওয়া হয় মায়াবি এই ঋতুকে। গানের সুরে, নাচের ছন্দে কিংবা কবিতার শিল্পিত উচ্চারণে প্রকাশিত হলো শরতের প্রতি অপার অনুরাগ। বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক পরিবেশনার সঙ্গে বক্তার কথনে সজ্জিত সে শরৎ উৎসবে হিংসার বিপরীতে ব্যক্ত হয়েছে সম্প্রীতির সমাজ গড়ার আকাক্সক্ষা। উচ্চারিত হয়েছে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রেক্ষাপটে বৈষম্যহীন স্বদেশ গড়ার প্রত্যয়। সময়ের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে এ উৎসবের আয়োজন করে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী।
সাত সকালে যখন অধিকাংশ শহরবাসী নিদ্রাচ্ছন্ন তখন আপন সংস্কৃতির অনুরাগী কিছু মানুষ সমবেত হয়েছিলেন চারুকলার বকুলতলায়। তাদের স্বাগত জানিয়ে সরোদের সুরে শরৎ উৎসবের সূচনা হয়। পরিবেশনাটি উপস্থাপন করেন যন্ত্রসংগীত শিল্পী মো. ইউসুফ খান। এরপর মঞ্চে হাজির হয় একঝাঁক শিশু-কিশোর। সীমান্ত খেলাঘর আসরের এই শিল্পীরা কবিগুরুর সৃষ্টির নির্যাসে মেতে ওঠে শরতের বন্দনায়। সকলে মিলে গেয়ে ওঠেÑ আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা/নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই ...। এরপর গেন্ডারিয়ার কিশলয় কচি-কাঁচার মেলা পরিবেশিত গানের শিরোনাম ছিল ‘শরৎ এলেই দূর আকাশে’। এ ছাড়াও খুদে শিল্পীদের গান ও কবিতার পরিবেশনায় অংশ নেয় সুরবিহার ও শিল্পবৃত্তের ছোট্ট বন্ধুরা। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গীতবাণীর সম্মিলনে শ্রোতার হৃদয় রাঙিয়ে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী গেয়েছে ‘দেখো দেখো শুকতারা আঁখি মেলে চায়’ ও ‘এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী’ শীর্ষক সংগীত। দলীয় সংগীত পরিবেশনায় উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী পরিবেশন করে ‘আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে’। নির্ঝরণী সংগীত একাডেমির শিল্পীরা শুনিয়েছেন ‘এসো হে সজল শ্যামল ঘন দেয়া’। সমস্বরের শিল্পীরা পরিবেশন করে ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’।
এ ছাড়া একক কণ্ঠে সংগীত পরিবেশন করেন ফাহিম হোসেন চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান প্রিয়াংকা গোপ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান অনিমা রায়, তানভীর আলম সজীব, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, স্নিগ্ধা অধিকারী, নবনীতা জাইদ চৌধুরী অনন্যা, ফেরদৌসী কাকলী ও রোমানা আক্তার। বৃন্দ নৃত্য পরিবেশন করে স্পন্দন, ধৃতি নর্তনালয়, বাংলাদেশী একাডেমি অব ফাইন আর্টস, নৃত্যাক্ষ ও কত্থক নৃত্য সম্প্রদায়ের শিল্পীবৃন্দ। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ‘এখানে আকাশ নীল’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন বাচিক শিল্পী রফিকুল ইসলাম। উৎসবের মূল পর্বে অংশ নেন চারুশিল্পী অধ্যাপক সুশান্ত অধিকারী, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি কাজী মিজানুর রহমান ও সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সহসভাপতি অধ্যাপক ড. নিগার চৌধুরী। উৎসবের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আয়োজক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট? ঘোষণাপত্রে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও আগামীর প্রত্যাশার সম্মিলন ঘটিয়ে মানজার চৌধুরী বলেন, চিরন্তন শারদীয় উৎসবে এবার মিশে আছে বেদনার সুর।
আমরা সশ্রদ্ধভাবে স্মরণ করি নবপ্রভাতের স্বপ্নবহ ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে আত্মাহুতি দানকারী শহীদদের, ব্যথিত চিত্তে লক্ষ্য করি ঘৃণা অসহিষ্ণুতা ও হিংসার বিস্তারে দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু। বৈষম্যহীন মুক্ত স্বাধীন সম্প্রীতির সমাজের স্বপ্নবহ আন্দোলন জীবনে নানাভাবে পল্লবিত হোক, সেই প্রত্যাশাও মিশে থাকে শরৎ-আবাহনে। কারণ, শারদোৎসব মেলবন্ধন রচনা করে মানবের সঙ্গে প্রকৃতির, জীবনের সঙ্গে মহাজীবনের, সমকালের সঙ্গে চিরকালের। বাংলার মাটির ও প্রকৃতির এমন উৎসব তাই নব-আনন্দে জেগে-ওঠার বাণীমন্ত্র যেমন শোনায়, তেমনি আমাদের দায়িত্ববান করে তোলে প্রকৃতি-সংহারী পদক্ষেপ প্রতিরোধে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে, সেইসঙ্গে মানবসমাজ ও জীবনের চালচিত্রে বিভিন্নতার রং-রূপ-রস রক্ষা করে সম্প্রীতির জয়গান গাইতে। শরৎ-উদ্যাপন হোক মানবিক মিলনোৎসবে মুখরিত, আন্দোলিত, ধ্বনিত হোক জীবনের জয়গান।
আগামী প্রজন্মের কাছে আপন প্রকৃতিকে মেলে ধরার বারতায় সুশান্ত অধিকারী বলেন, আমরা যারা গ্রামে বেড়ে উঠেছি, তারা শাপলার বিলে সাঁতার কেটেছি। কাশবনে ঘুরে বেড়িয়েছি। তাদের অনুভবে শরৎ ধরা দেয় অনন্য রূপে। শহরের শিশুদের কাছে হয়তো এই রূপ অচেনা। আমাদের অভিভাবকদের দায় রয়েছে, আমাদের সন্তানদেরকে প্রকৃতির এই রূপ-বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানানোর। গ্রামে এখনো কিছু কিছু প্রকৃতির বৈচিত্র্য দেখা যায়। এই রূপ-বৈচিত্র্যের সঙ্গে আমাদের সন্তানদের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।
নিগার চৌধুরী বলেন, শরৎ ঋতু আমাদের মাঠে নতুন ফসলের বার্তা আনে, যা ঘরে তুলে নবান্ন উৎসব করি। শুদ্ধ সুন্দর শুভ্রতায় এই শরৎ সকলের জীবনে মঙ্গল বয়ে আনুক।