ঝলমলে দীঘির শান্ত স্নিগ্ধ অপরূপ সৌন্দর্যে প্রকৃতিপ্রেমীদের প্রাণ জুড়িয়ে যায়
শতাব্দীর মহাদুর্যোগ করোনায় (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়নি ঝলমলে দীঘিরপাড়ে বসবাসরত কোনো গ্রামবাসী। এখানে নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবা সকলেই বিশ্বাস করেন ঝলমলে দীঘির পানি পান করায় তাদের কেউ করোনায় আক্রান্ত হননি। স্থানীয় মানুষ মনে করেন, দীঘির ভেতরে ঝলমলেশ্বরী দেবী বাস করেন। লোকমুখে শোনা যায়, ভক্তি ও শ্রদ্ধায় মা ঝলমলেশ্বরী মন্দিরে কেউ কামনা করলে এখনো তার সেই বাসনা পূর্ণ হয়। এই দীঘিতে একসময় সোনার থালা-বাটি পাওয়া যেত। মোদ্দাকথা, একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের উৎকর্ষের এ সময়েও অগণিত মানুষের কাছে ‘ঝলমলে দীঘি’ যেন অপার রহস্যে ঘেরা। বিশ্বাসের প্রতীক।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বারো মাসের তেরো পার্বণ এই ঝলমলে দীঘির পাড়ে মেলে। দীঘির পূর্বপাড়ে দুর্গা ও মা ঝলমলেশ্বরী মন্দির রয়েছে। পশ্চিমপাড়ে রয়েছে কালীমন্দির ও উত্তরপাড়ে শ্রী শ্রী রাধা গোবিন্দ মন্দির। আর একপাড়ে আছে মসজিদ। যে যার ধর্ম পালন করছেন। সন্ধ্যা-সকাল মন্দিরে চলছে পূজা অর্চনা-আরতি। পাশাপাশি মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করছেন মুসল্লিরা। সম্প্রীতির প্রতীক হয়ে মাঝে রয়েছে ‘ঝলমলে দীঘি’। চারপাশে তীব্র লবণ। অথচ দীঘির পানি সুমিষ্ট। হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে এ দীঘির পানি পান করছেন। প্রতিদিন সহস্রাধিক পরিবার এই জল নিয়ে থাকেন। আবার প্রতিবছর এ দীঘিরপাড়ে প্রসিদ্ধ মেলা বসে। যা ‘ঝলমলে দীঘি মেলা’ নামে খ্যাত। এভাবেই চলছে যুগের পর যুগ।
বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলার হুড়কা ইউনিয়নে অবস্থিত এই ‘ঝলমলে দীঘি’। এটি দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ দীঘি হিসেবে পরিচিত। এই দীঘি ঘিরে অতীতকাল থেকে বিভিন্ন লোককথা বা কল্পকাহিনী মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে। তার কতটুকুই সত্যি বা কতটুকু কল্পনা তা কেউ জানে না। এ অঞ্চলটা এক সময় ঘন জঙ্গল ছিল। তখনকার দিনে এই ঘন জঙ্গলে কে বা কারা, কি কারণে এতবড় দীঘি খনন করেছিল তা এখনও অজানা।
তবে কল্পকাহিনী অনুযায়ী- ঝলমলে দীঘি, খানজাহান আলী (র) দীঘি, ঘোড়া দীঘিসহ এমন কয়েকটি দীঘি একই রাতে কেউ খনন করেছিলেন। যদিও তার কোনো প্রমাণ নেই। বাগেরহাট-খুলনা-মোংলা মহাসড়কের গোনা ব্রিজ থেকে পূর্বদিকে হুড়কায় ঐতিহ্যবাহী ঝলমলে দীঘি অবস্থিত।
কথিত আছে এই দীঘিতে থাকা ঝলমলেশ্বরী দেবীর কাছে আগে কিছু চাইলে তা তৎক্ষণাৎ মিলে যেত। পরে এক ব্যক্তি ছলচাতুরির কারণে তা বিলুপ্ত হয়। স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ কালিপদ মন্ডলের ভাষায়, এ এক আশ্চার্য দীঘি। তখন কোনো বাড়িতে পূজা-পার্বণ, বা কারো বাবা-মা মারা গেলে পুকুরপাড়ে এসে গলায় কাপড় জড়িয়ে হাত জোড় করে মানত করলে (প্রার্থনা) তাদের প্রয়োজনীয় মাছ, সোনার থালা-বাসকোসন উঠত (পাওয়া যেত)। শর্ত ছিল, কাজ শেষে আবার তা দীঘির জলে ভাসিয়ে দিতে হতো। কথিত আছে, এক ব্যক্তি তার বাড়িতে পার্বণের জন্য বাসনকোসন নিলেও কাজ শেষে সোনার একটি ঝিনুক রেখে দিয়েছিল। সেই থেকে এ দীঘিতে আর সেগুলো পাওয়া যায় না।
আসলাম মল্লিক বলেন, এই দীঘির পানি খেয়ে মানুষের রোগ ভালো হয়। আমাদের এখানে ডায়রিয়া, আমাশয়ের মতো কোনোরকম পানিবাহিত রোগ হয় না। পৃথিবীব্যাপী যখন মহামারি কোভিড-১৯ আক্রমণ করেছিল তখন এই হুড়কা গ্রাম ছিল এর প্রভাব থেকে সম্পূর্র্ণ মুক্ত। একটি মানুষও এই কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়নি। আশপাশের সব মানুষ এই দীঘির পানি খায়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে নানাপাত্রে এ পানি ভরে নিয়ে যায়।
স্থানীয় নারী নেত্রী গায়ত্রী রানী বিশ্বাস বলেন, এই দীঘির জল বৃষ্টির পানির মতো মিষ্টি। রোগ হয় না, বরং রোগ সারে, ডায়রিয়া হলে তা সেরে যায়, পানিবাহিত রোগ হয় না। এই দীঘির চারপাশে নোনাজল অথচ এ দীঘির পানি অতি মিষ্ট।
এই ঝলমলে দীঘি সুন্দরবন এলাকার কাছে অবস্থিত হওয়াতে এই এলাকার কোথাও মিষ্টি জল পাওয়া যায় না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ঝলমলে দীঘির জল মিনারেল ওয়াটারের মতো মিষ্টি। অশীতিপর অঞ্জলি রানী বিশ্বাসের ভাষায়, ওরে বাবা, এ যে কি মিষ্টি, এর পর আর কোনো মিষ্টি নেই। চারপাশে লবণ কিন্তু এর মধ্যি সব মধুময় জল। যুবক শহীদুল ইসলামের ভাষায়, আমাদের রামপালের অধিকাংশ মানুষ এই পানির ওপর নির্ভরশীল। এই পানি খুব সুস্বাদু। অথচ চারপাশে সব লবণে ভরা। বিভিন্ন হোটেলেও এই পানি সরবরাহ করা হয় রান্না এবং খাওয়ার কাজে ব্যবহারের জন্যে। এই এলাকার মানুষের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। এলাকার মানুষ মূলত কৃষিজীবী। অনেকে এই দীঘির জল অন্যত্র বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। শত শত মানুষ বড় বড় প্লাস্টিকের জার(পাত্র) ভরে প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার পানি নিলেও কখনও দীঘির পানি কমে না।
সত্তরোর্ধ্ব ইসলাম সেখ ও হরিপদ গোলদার বলেন, দীঘির চারদিকে একসময় ছোট ছোট পোড়ামাটির ইটের তৈরি বাঁধানো ঘাট ছিল। আমরা ছোটবেলায় তা দেখেছি। যা এখন বিলুপ্ত। তবে সরকারিভাবে দীঘির চারদিকে সিমেন্টের উঁচু প্রাচীর এবং ঘাট তৈরি করা হয়েছে। দীঘিটির দৈর্ঘ্য ১২৫ মিটার এবং প্রস্থ ১০০ মিটার। মদন মন্ডল বলেন, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী এক লোক একবার পদ্মফুল তুলতে দীঘিতে নেমে হারিয়ে যায়, একদিন একরাত পরে সে ফিরে আসে। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে বলত, বলতে মানা করেছে, তালি বিপদ হবে। কিন্তু এক পর্যায়ে সে বলে, তাকে খুব যতœ করেছে, সোলার থালা-বাসনে ভাল ভাল খেতে দিয়েছে। এ কথা বলার পরদিন সে মারা য়ায়।
কথিত আছে, হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থ গীতা এই দীঘির পানিতে পড়েছিল, কিন্তু একটুও ভিজেনি, যা বয়োজ্যেষ্ঠরা দেখেছেন। এমন অনেক লোককথা এখানে ‘ঝলমলে দীঘি’ নিয়ে প্রচলিত আছে। এ দীঘির গভীরতা এখনও প্রায় ৩০ ফুট। চারপাশের মনোরম স্নিগ্ধ-শান্ত পরিবেশ। পাড়ে একাধিক প্রাচীন বটবৃক্ষ রয়েছে, যা নানা প্রজাতির পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে সারাক্ষণ। তাই যে কোনো পর্যটক এখানে এলে পরিতৃপ্ত হন। ফেরেন প্রশান্তি নিয়ে।
রামপাল সদর দীঘি ॥ প্রাচীর কীর্তি হিসেবে পরিচিত এ দীঘির আয়তন প্রায় ১০ বিঘা। এই পুকুরের জল মিষ্টি। কমবেশি অনেকেই খাওয়ার জন্য নিয়ে থাকে। তবে আশপাশে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক বেশি হওয়ায় এই পুকুরের জল ব্যবহারে অনেকটাই কম। তবে নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে এই জল বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। পুকুরের চারপাশে সুন্দর পরিবেশে পাড় নির্মাণ ও ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে উপজেলা জাতীয় শহীদ মিনার ও একটি লাইব্রেরি রয়েছে। আর পূর্বপাড়ে উপজেলা জাতীয় দুর্গামন্দির রয়েছে। যেখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রতিটি উৎসব পালন করে থাকে।
কালেখারবেড় ঠাকুর আনী দীঘি ॥ ঐতিহ্যবাহী এ দীঘির আয়তন প্রায় ৫ বিঘার ওপর। এই পুকুরের জল মিষ্টি। আশপাশের মানুষের এই পুকুরের জল পান করে থাকে। তবে এই পুকুরটি অনেকটাই অসংরক্ষিত। দেখভালের অভাবে ক্রমেই জৌলুশ হারাচ্ছে। পুকুরের পূর্ব-দক্ষিণে শ্রী শ্রী নিরাপদ গোসাইয়ের আশ্রম অবস্থিত। পশ্চিমপাড়ে ইউনিয়ন পরিষদ ও উত্তরে শ্রী শ্রী দুর্গা মন্দির রয়েছে।
পেড়িখালি ফুলপুকুর দীঘি ॥ এ দীঘির আয়তন প্রায় ৫ বিঘা। এই পুকুরের জল মিষ্টি। এলাকার কয়েক গ্রামের মানুষ এই পুকুরের জলে নির্ভরশীল। পুকুরটির চারপাশে পাকা গাইড ওয়াল রয়েছে। পুকুরের দক্ষিণপাড়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পশ্চিমপাড়ে বড় বাজার রয়েছে। পানীয়-জলের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিনোদনের অন্যতম স্থান।
ঝনঝনিয়া দীঘি ॥ যার আয়তন প্রায় ৩ বিঘা। এই পুকুরের জল মিষ্টি। মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার হলেও কেউ খায় না। পুকুরটি সংরক্ষিত। পুকুরের পূর্বপাড়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। পশ্চিমপাড়ে প্রসিদ্ধ বাজার ও প্রাথমিক বিদ্যালয়। উত্তরে ঝনঝনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় অবস্থিত। এটি রামপালের অন্যতম পানির উৎস।
বাগেরহাটের নবাগত জেলা প্রশাসক আহমেদ কামরুল হাসানের ভাষায়, একথা সত্য, চারপাশ লবণাক্ত হলেও অধিকাংশ দীঘির পানি সুমিষ্ট। খলিফতাবাদে জীবন-জীবীকা-সংস্কৃতিতে এসব দীঘির অবদান অপরিমেয়। সম্প্রীতি ও জনহিতকর কাজের জন্য পীর খানজাহান (র) চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন, থাকবেন।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, প্রাক-মুসলিম যুগে খননকৃত এসব দীঘি সম্ভবত খানজাহান (র) স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সুপেয় পানির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে খনন ও পুন:খনন করেছেন। এ বিষয়ে অধ্যাপক ও গবেষক অধ্যক্ষ বুলবুল কবির বলেন, উপকূলীয় দুর্যোগপূর্ণ লবণাক্ত এ অঞ্চলে সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে এবং জলোচ্ছ্বাস ও জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষার জন্য ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধিতে গ্রায় ৬শ’ বছর আগে অসংখ্য দীঘি খনন করেন। যা আজও মানুষের কল্যাণে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা ও বরিশাল বিভাগের বিভাগীয় জাদুঘরের সহকারী পরিচালক মো. গোলাম ফেরদৌস জনকণ্ঠকে বলেন, পুরাকীর্তি হিসেবে প্রাচীন জলাশয় তথা দীঘিগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কালের বিবর্তনে বৈরী পরিবেশে বিলুপ্ত হলেও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে শত শত বছর ধরে প্রাচীন দীঘি ও জলাশয়গুলো টিকে আছে। মানবকল্যাণে অবদান রাখছে। বাগেরহাটসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আদি ঐতিহাসিক পর্বে খননকৃত প্রাচীন দীঘি ও জলাশয়ের অস্তিত্ব এখনও বিদ্যমান আছে। যা প্রাচীন মানব সভ্যতা ও মানব বসতির গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণক।
সচেতন নাগরিক কমিটি(সনাক) বাগেরহাটের প্রাক্তন সভাপতি অধ্যাপক চৌধুরী আব্দুর রব বলেন, ইতিহাস অনুযায়ী খান-উল-আলম উলুঘ খান-ই-জাহান (রহ) সুলতানী শাসন আমলে খ্রিস্টীয় ১৪ শতকের প্রথমদিকে বাগেরহাটে খলিফতাবাদ নগররাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। মানব প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যশোরের বারোবাজার থেকে শুরু করে ভাটি অঞ্চলজুড়ে ৩৬০টি মসজিদ নির্মাণের পাশাপাশি সমসংখ্যক দীঘি খনন করেছিলেন এই মহান সাধক। এ অঞ্চলের মুসলমানদের উপাসনার জন্য মসজিদগুলো এবং সুন্দরবনসংলগ্ন লবণাক্ত এ অঞ্চলে পানীয় জলের এ দীঘিগুলো সাধারণ মানুষের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। তাছাড়া দীঘি খননের মাটিতে আশপাশ উঁচু করায় জলোচ্ছ্বাস ও জলাবদ্ধতার কবল থেকে মানুষ অনেকাংশে রক্ষা পান।